হ্যাঁ এরকম হবে মনে মনে ভেবেছিলাম। কিন্তু যা হল তা ঠিক কী হল, বুঝে পাচ্ছি না। একটাই স্বস্তি পাচ্ছি তা হল রেসিডেন্স পারমিটই আর দেওয়া হবে না–এমন কিছু বলা হয়নি।
.
৩০ নভেম্বর
‘সিঙ্গুর, নন্দীগ্রাম পুলিশ আর পার্টির ভাড়াটেদের বন্দুকনির্ভর নির্মম দখলদারির পর্ব পেরিয়ে তসলিমা ইস্যুতে এসে একটা দমকা হাওয়াতে উড়ে গিয়েছে সিপিএম-এর এতদিনের সযত্ন লালিত ধর্মনিরপেক্ষতার মুখোশটা।
.. তসলিমা দেশে দেশে, রাজ্যে রাজ্যে এভাবেই ছিন্নমূল ঘুরতে থাকুন, আর আমরা কড়ায় গণ্ডায় ভোটের হিসেব করি। নিক্তিতে মেপে দেখি, তসলিমা এখানে থাকলে তাদের লাভ বেশি,
বিদেয় হলে। কী করলে, কী বললে মুসলিম ভোট টানা যাবে। কোন ইস্যুতে মৌলবাদের কথায়। ঘাড় নাড়তে হবে, কোন ইস্যুতে রাস্তায় নেমে মৌলবাদের বিরুদ্ধে মিছিল করে চেঁচাতে হবে, সবই ভোটের নিক্তিতে ওজন করা।‘–আশিস ঘোষ
সকালে এনামুল কবীর ফোন করলেন বীরভূম থেকে। না, এখন অবধি কোনও রাজনৈতিক দল বলেনি সিপিএম যা করেছে ভুল করেছে, এভাবে কোনও লেখিকাকে তাড়িয়ে দেওয়াটা অন্যায়।
আজ দ্বিখণ্ডিত থেকে কিছু বাক্য বাদ দিয়ে দিলাম। সারা দেশে এই চরম দুঃখের খবরটি হৈ হৈ করে ছাপা হল।
.
২ ডিসেম্বর
ক্যান্টনমেন্টের প্রধান একদিন দেখা করে গেছেন। সম্মান দেখিয়ে গেছেন। সজ্জন শিক্ষিত ভদ্রলোক। বললেন, লজ্জার লেখকের সঙ্গে দেখা হবে কোনোদিন, এ কল্পনাও করেননি। সবাই আমার নাম জানেন লজ্জা’র লেখক হিসেবে। লজ্জা পড়েননি, ভারতবর্ষের শিক্ষিত শ্রেণীর মধ্যে এমন লোক কমই আছে। পেঙ্গুইন ঘোষণা করেছে, লজ্জা ভারতবর্ষের মুদ্রণশিল্পের ইতিহাসে সবচেয়ে বিক্রিত বই।
ভদ্রলোকের নামের পদবী, সেন। বাঙালি ভেবে কী খুশিই না হয়েছিলাম। পরে শুনলাম, উনি বাঙালি নন।
.
৪ ডিসেম্বর
‘She does not have any choices. She is just like a person who has now got the protection of the mafia which is the state in some way. She has nowhere to go. She has no protection. She just has to blunder her way through this kind of humiliation and I really feel for her’. –Arundhati Roy
আজ দাদার বিয়ের পঁচিশ বছর পূর্তি উৎসব। প্রতিবছর এই দিনটি দাদা উদযাপন করে। কিন্তু দিল্লির এই অজ্ঞাতবাসে উদযাপনের কিছু নেই। আজ সকালে দাদা স্নান করে তৈরি হয়ে রইলো। দুপুরের খাবার খেয়েই রওনা হয়ে গেল। দিল্লি থেকে কলকাতা গেল। বিকেল পাঁচটায় কলকাতায় নামবে। আমরা একসঙ্গে কলকাতা থেকে এসেছিলাম, দাদা একা ফিরে গেল। আমি যেতে পারলাম না। আমার যাওয়া সম্ভব নয়। দাদার চলে যাওয়ার দিকে তাকাতে ইচ্ছে করেনি। বুক ফেটে যাচ্ছিল। দাদাও কষ্ট পাচ্ছিল হয়তো। কিন্তু এখানে থেকেই বা কী করবে! ভালো লাগে এভাবে লুকিয়ে থাকতে!
.
৫ ডিসেম্বর
‘Secularism is not appeasing fundamentalism and terrorism. The November 21 incidents could have led to communal riots in Kolkata. Fundamentalism, whether Muslim or Hindu is a challenge which must be taken very seriously. The Taslima Nasreen issue is no longer about Taslima Nasreen the writer. It has revealed a much larger conspiracy in the making.
It was a test case, and the CPM’s decision has conveyed to the Islamic fundamentalists that they have won the round one!’ -Bhaskar Roy.
আজ উল্লেখ করার মতো তিনটে জিনিস পেলাম, দ্য হিন্দুর সম্পাদকীয়, আনন্দবাজারের উপসম্পাদকীয় আর একটি ঘটনা, সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণণের বইয়ে মুহম্মদ নবীর একটি ছবি ছাপানো হয়েছে বলে কলকাতায় বিক্ষোভ শুরু হতেই দিল্লির প্রকাশককে ক্ষমা চাইতে হয়েছে। হিন্দু লিখেছে, এই ২৯৫(ক)ই তো বাংলাদেশে আমার বিরুদ্ধে প্রয়োগ করেছিল সরকার। সেই পনেরো ষোলো বছর থেকে বাক স্বাধীনতাবিরোধী আইনটিকে বাদ দেওয়ার কথা বলছি। আমার এবং আমার মতো দু’একজনের কথা কে শোনে।
আজকের আনন্দবাজার পত্রিকার লেখাটি দেখে হ্যাঁ হয়ে গেলাম। কদিন আগেই আমাকে সমর্থন করেছে, আর আজ একশ’ আশি ডিগ্রি ঘুরে গেল! হতবাক হতে হয় আমাকে। বাকরুদ্ধ বসে থাকি। কল্যাণ সান্যাল আমার বিরুদ্ধে একটি উপসম্পাদকীয় লিখেছেন। বিতর্কের জন্য যদি ছাপানো হয়ে থাকে লেখাটি তাহলে কোনও আপত্তি নেই। সুস্থ বিতর্ক সবসময়ই ভালো। কিন্তু যদি এ বাক-স্বাধীনতার বিপক্ষে অবস্থান হিসেবে হয়, তাহলে নিশ্চিতই আশংকার কারণ বৈকি। আমি অনুমান করি, আমার পক্ষে লেখা কোনও নিবন্ধ বা চিঠি এখন আনন্দবাজার ছাপাবে না বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছে। কল্যাণ সান্যালের বক্তব্য শিল্প মানেই শুদ্ধ নয়, রাজনীতি মানেই দূষিত নয়। সিপিএমের রাজনীতি দূষিত নয়, আমার লেখা শুদ্ধ নয়। আমার লেখা যেহেতু শুদ্ধ নয়, আমাকে রাজনীতিকরা বা ক্ষমতাবানরা তাড়িয়ে দিতেই পারে, এতে কোনও অসুবিধে নেই। আরও লিখেছেন, আমার লেখার ধরন এবং মর্মবস্তু কোনওটাই তিনি পছন্দ করেন না। পছন্দ করেন না, সুতরাং যেন তাড়িয়ে দেওয়াটায় অন্যায় কিছু নেই। তিনি সিপিএমের বিরোধিতা করছেন নন্দীগ্রামের ব্যাপারে। কিন্তু আমার ব্যাপারে তিনি সরকারের পক্ষ নিচ্ছেন। আমার একটা ধারণা হয়. কল্যাণ সান্যালের মতের পক্ষে বেশির ভাগ শিল্পী সাহিত্যিক বুদ্ধিজীবী, তা না হলে আমার বিরুদ্ধে যে অন্যায় সিপিএম সরকার করেছে, তার কোনও প্রতিবাদ নেই কেন?