আনন্দবাজার অন্য সময় সঙ্গে থাক বা না থাক, কলকাতা থেকে আমাকে তাড়াবার শুরু থেকে পাশে আছে। স্টার আনন্দতে এ নিয়ে খবর হচ্ছে, আলোচনা হচ্ছে। আমার সাক্ষাৎকারও নিলেন সুমন দে। আনন্দবাজার থেকে মিলন দত্ত বড় একটা সাক্ষাৎকার নেবেন। হায়দারাবাদ থেকে ফেরার পর আমাকে কী করে আটকে রাখা হয়েছিলো বাড়িতে, কী বলেছিলো কে, কীভাবে আমাকে কলকাতা থেকে বিদেয় করা হল, শুরু থেকে সব শুনতে চান তিনি। প্রশ্ন করা হচ্ছে, আমি উত্তর দিয়ে যাচ্ছি। হঠাৎ একটা গুঞ্জন। ফোনেই শুনতে পাচ্ছি মিলন দত্তকে কেউ ডাকছেন। কথা বলছেন। আলোচনা করছেন। শেষ পর্যন্ত আমাকে মিলন দত্ত জানিয়ে দিলেন, অভীক বাবু বলেছেন সাক্ষাৎকার বন্ধ করতে, কারণ প্রণব বাবুর সঙ্গে তার কথা হয়েছে, প্রণব বাবু বলেছেন এখন যেন আমার কোনও খবর, সাক্ষাৎকার ইত্যাদি মোটেও প্রচার করা না হয়, তিনি কথা দিয়েছেন দিন পনেরোর মধ্যে আমাকে কলকাতায় ফিরিয়ে আনছেন।
ওদিকে স্টার আনন্দও সব আলোচনা বন্ধ করে দিল। আমার পক্ষে জনমত গড়ে ওঠার সম্ভাবনার এখানেই ইতি টানা হল।
.
২৮ নভেম্বর
‘তসলিমা নাসরিন প্রসঙ্গে সকলকে, বিশেষত মুসলমান বুদ্ধিজীবীদের, একটা কথা ভেবে দেখতে অনুরোধ করবো। ভদ্রমহিলা তার মতবিরোধীদের ইট মারেননি, গাড়ি পোড়াননি, খুন করে দেওয়ার কথাও বলেননি। তবে বিশেষত মুসলমান মেয়েদের ওপর নির্যাতন প্রসঙ্গে তিনি যা লিখেছেন তা বুদ্ধিজীবীদের একাংশের মতে ইসলামবিরোধী। কিন্তু তাঁকে তাঁর কথা বলতে না দিলে তসলিমার সমালোচকরাও অনুচ্চারিত ইসলাম বিরোধী বক্তব্যের সমুচিত জবাব দিতে পারবেন না। এতে গণতন্ত্র বিপন্ন হবে। গণতন্ত্র না থাকলে সবার আগে, এবং সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে ধর্মীয় সংখ্যালঘুরাই। তাই তসলিমার স্বাধীনভাবে এবং অকপটে লেখার অধিকার রক্ষার দাবি শেষ বিচারে গণতন্ত্র রক্ষারই সংগ্রাম।‘ –সুনন্দ সান্যাল
প্রণব মুখার্জি লোকসভায় আমার প্রসঙ্গে বলবেন। সে গতকাল থেকেই জানা। বসে আছি অপেক্ষায়। বারোটায় বলবেন। সাড়ে বারোটায় বলবেন। এরকম শুনছিলাম। যা বললেন তা হল –“Throughout history, India has never refused shelter to those who have come and sought our protection. This civilisational heritage which is now a government policy, will continue and India will provide shelter to Ms Nasreen. Those who have been granted shelter here have always undertaken to eschew political activities in India or any action, which may harm India’s relation with friendly countries. It is also expected that the guest will refrain from activities and expressions that may hurt the sentiments of our people. While these guests are in India the Union and the state governments provide them protection –this policy will also apply in Ms Taslima Nasreen’s case”
দাদা বললো, ‘একেবারে রিয়েল ডিপ্লোমেট’।
যে ডুবছে, সে একটা খড়কুটো চায়। আমাকে যে তাড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে না এ দেশ থেকে, আমাকে যে থাকতে দেওয়া হবে, এই খবরটিই আমার কাছে সবচেয়ে বড় খবর। . আমি আশা করেছিলাম অন্য এক বিবৃতির যার বাংলা করলে এরকম দাঁড়ায় –‘ভারত এমন একটি দেশ, যে উদার, অতিথিপরায়ণ, পৃথিবীর নানা দেশের নানা সংস্কৃতির মানুষকে বিভিন্ন সময়ে বরণ করে নিয়েছে এবং ঋদ্ধ হয়েছে। তসলিমা একজন নির্যাতিত এবং নির্বাসিত লেখক, বাংলা তাঁর মাতুভুমি। পুর্ব বাংলায় না হলেও পশ্চিম বাংলায় বাস করার তাঁর এই ইচ্ছেকে আমরা স্বাগত জানাই। ভারত একটি ধর্মনিরপেক্ষ দেশ, ভারত পৃথিবীর সবচেয়ে বড় গণতন্ত্র। এখানে যারা বাস করছে, সবারই গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে নিজের মত প্রকাশের অধিকার আছে। কিন্তু ২১শে নভেম্বর কলকাতার রাস্তায় যা ঘটেছে, তা বর্বরতা ছাড়া আর কিছু নয়। সেকুলার গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের প্রথম এবং প্রধান শর্ত, মত প্রকাশের স্বাধীনতা। মত প্রকাশের অধিকার এবং বাক স্বাধীনতা আর সবার মতো তসলিমা নাসরিনের আছে। সুতরাং তাঁর মত প্রকাশের অধিকার ছিনিয়ে নেবার উদ্দেশ্যে যারা রাস্তায় নেমেছে এবং লুঠপাট, আগুন জ্বালানো এবং জনগণের জীবন নিরাপত্তাহীন করে তুলেছিল, তাদের অগণতান্ত্রিক আচরণের কারণে তাদের বিরুদ্ধে সরকার অবশ্যই ব্যবস্থা নেবে এবং ভবিষ্যতে যেন এ ধরনের অশুভ কাজ থেকে বিরত থাকে সে ব্যাপারে প্রশাসন সতর্ক থাকবে। সেকুলার গণতন্ত্রের ভাবমূর্তি নষ্ট না হয়, এ ব্যাপারে প্রত্যেককে সচেতন থাকতে হবে। তসলিমা নাসরিনকে পশ্চিমবঙ্গ থেকে কেন তার ইচ্ছের বিরুদ্ধে জোর করে অন্য রাজ্যে স্থানান্তর করা হল, সে ব্যাপারে তদন্ত চলবে। এবং দোষী ব্যক্তিদের শাস্তির ব্যবস্থা হবে। এবং ২১ নভেম্বরের তান্ডবকারীদেরও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা হবে। তসলিমাকে আগামীকাল কেন্দ্র থেকে কলকাতায় পাঠানো হবে। কেন্দ্র চাইছে পশ্চিমবঙ্গে তসলিমার পূর্ণ নিরাপত্তা। শুধু তাই নয়, পশ্চিমবঙ্গের বাইরেও তাঁর পূর্ণ নিরাপত্তা তাঁকে দেবে ভারত সরকার এবং রাজ্য সরকার। শুধু তসলিমা নয়, এদেশের সব নাগরিকের, অতিথিদের, এবং আশ্রয়প্রার্থীদের ক্ষেত্রে ভারতের নিয়ম একই, ভিন্ন নয়।’