.
স.
অভিজ্ঞতার জন্য সবার অন্তত এক বার নির্বাসনের জীবন ভোগের প্রচন্ড দরকার।
পরাধীনতার কিছু না পোহালে স্বাধীনতা কী জিনিস কী করে বুঝবে, কেই বা বুঝবে। মর্যাদা দেবে কেন! স্বাধীনতা পেতে লড়াই করছি শৈশব থেকে প্রায়, আমি বুঝি এর গভীর অর্থ, আবশ্যকতা কত। জীবন দেখেছি বলে প্রাণপণে জীবন ফেরত চাই অনেকের মতো নাহলে নিতাম পরাধীনতায় ঠাই। স্বাধীনতা ভোগ যারা প্রতিদিনই করছে জানেনা এর আসল মানেটা আসলে খুবই সামান্য কিছু কি না। পরাধীনরাও গৃহস্থঘরে মরে পচে গলে যায়, সারাজীবনেও জানতে পারেনা কী যে তারা অসহায়।
যুদ্ধ করেই বোঝাতে চাইছি যুদ্ধ করতে হয়, স্বাধীনতা চাই সবাইকে দিতে, কেবল আমাকে নয়, নিজে না ভাঙলে, নিজের শেকল কেউই ভাঙেনা এসে, প্রয়োজনে পাশে মানুষ কোথায় দাঁড়াবে যে ভালোবেসে! ধর্মতন্ত্র আমাকে ফাঁসিয়ে মিথ্যেকে দিল জয়। লক্ষ নারীকে পুরুষতন্ত্র বন্দি করেছে ঘরে, বিক্রি হচ্ছে শত শত লোক ধর্মান্ধের কাছে। স্বাধীনতা আজ দুর্লভ খুব দুর্ভাগাদের দেশে।
.
হ.
একটা সরল সোজামানুষকে নিয়ে রাজনীতিকরছো তোমরা, তার সত্য কথাবলা তোমাদের সহ্য হচ্ছে না, তার সততা তোমাদের আর পছন্দ হচ্ছে না। তাকে রাজ্য ছাড়া করেছে, আচমকা তাকে তার ঘর থেকে উঠিয়ে নিয়ে গেছে মিথ্যে ভয় দেখিয়ে বিমান বন্দরে, ঘর বাড়ি যেমন ছিল, ওভাবেই এখনও পড়ে আছে, যে বইটা পড়ছিলাম, সেটা ওভাবেই খোলা, লেখার খাতাটাও ওভাবে, কলমের নিব খোলা থেকে থেকে কালি শুকিয়ে গেছে সম্ভবত, লেখকের কলমের কালি শুকিয়ে ফেলতে চাইছো তোমরা। লেখককে তার লেখার ঘরে যেতে দিতে চাইছো না, লেখককে বন্দি করেছো, যেভাবে কোনও ঘৃণ্য হত্যাকারীকে বন্দি করো। যেভাবে ফাঁসি দেওয়ার জন্য রেখে দাও দাগী আসামীকে, সেভাবে আমাকে রেখে দিয়েছে, কোথায় কোন গুহায় রেখেছো কাউকে জানতে দিচ্ছো না, পৃথিবীর কাউকে না, আমাকেও না।
লেখককে ভাবতে দিতে চাইছো না, লেখককে লিখতে দিতে চাইছো না, লেখককে বাঁচতে দিতে চাইছো না, তোমাদের না-চাওয়াগুলো স্পষ্ট দেখছে পৃথিবী। ভাবনা কী। তোমাদের বশীভূত লেখকেরা, পোষ্য ঐতিহাসিকেরা স্বর্ণাক্ষরে তো লিখেই রাখবে ইতিহাসে তোমাদের নাম!
.
ড়.
আমি এখন একটা ঘরে বাস করি, যে ঘরে বন্ধ একটা জানালা আছে, যে জানালা আমি ইচ্ছে করলেই খুলতে পারি না। ভারি পর্দায় জানালাটা ঢাকা, ইচ্ছে করলেই আমি সেটা সরাতে পারি না। এখন একটা ঘরে আমি বাস করি, ইচ্ছে করলেই যে ঘরের দরজা আমি খুলতে পারি না, চৌকাঠ ডিঙোতে পারি না। এমন একটা ঘরে বাস করি, যে ঘরে আমি ছাড়া প্রাণী বলতে দক্ষিণের দেয়ালে দুটো দুস্থ টিকটিকি। মানুষ বা মানুষের মতো দেখতে কোনও প্রাণীর এ ঘরে প্রবেশাধিকার নেই। একটা ঘরে আমি বাস করি, যে ঘরে শ্বাস নিতে খুব কষ্ট হয় আমার।
আর কোনও শব্দ নেই চারদিকে, শুধু মাথা ঠোকার শব্দ। জগতের কেউ দেখে না, শুধু টিকটিকিদুটো দেখে, বড় বড় চোখ করে দেখে, কী জানি কষ্ট পায় কিনা–মনে হয় পায়। ওরাও কি কাঁদে, যখন কাঁদি? একটা ঘরে আমি বাস করি, যে ঘরে বাস করতে আমি চাই না। একটা ঘরে আমি বাস করতে বাধ্য হই, একটা ঘরে আমাকে দিনের পর দিন বাস করতে বাধ্য করে গণতন্ত্র, একটা ঘরে, একটা অন্ধকারে, একটা অনিশ্চয়তায়, একটা আশংকায় একটা কষ্টে, শ্বাসকষ্টে আমাকে বাস করতে বাধ্য করে গণতন্ত্র। একটা ঘরে আমাকে তিলে তিলে হত্যা করছে ধর্মনিরপেক্ষতা।
একটা ঘরে আমাকে বাধ্য করছে প্রিয় ভারতবর্ষ…..
ভীষণ রকম ব্যস্তসমস্ত মানুষ এবং মানুষের মতো দেখতে প্রাণীদের সেদিন দু’সেকেন্ড জানি না সময় হবে কিনা দেখার, ঘর থেকে যেদিন জড়বস্তুটি বেরোবে, যেদিন পচা গলা একটা পিন্ড। যেদিন হাড়গোড়। মৃত্যুই কি মুক্তি দেবে শেষ অবধি? মৃত্যুই বোধহয় স্বাধীনতা দেয় অতপর চৌকাঠ ডিঙোনোর! টিকটিকিদুটো ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকবে সারাদিন, ওদেরও হয়তো দুঃখ হবে মনে। গণতন্ত্রের পতাকা পেঁচিয়ে প্রিয় ভারতবর্ষের মাটিতে আমাকে পুঁতে দেবে কেউ, কোনও সরকারি লোক সম্ভবত। সেখানেও ঘর পাবো, যে ঘরে চৌকাঠ নেই ডিঙোতে চাওয়ার, সেখানেও ঘর পাবো, যে ঘরে শ্বাসকষ্ট নেই।
.
ঢ়.
কখনও কোনওদিন যদি অন্তরিন হতে হয় তোমাকে, যদি শেকল পরায় কেউ পায়ে, আমাকে মনে কোরো। যদি কোনওদিন যে ঘরটিতে তুমি আছো সে ঘরের দরজা ভেতর থেকে নয়, বাইরে থেকে বন্ধ করে কেউ চলে যায়, মনে কোরো। সারা তল্লাটে কেউ নেই তোমার শব্দ শোনে, মুখ বাঁধা, ঠোঁটে শক্ত সেলাই। কথা বলতে চাইছো, কিন্তু পারছে না। অথবা কথা বলছো, কেউ শুনতে পাচ্ছে না, অথবা শুনছে, শুনেও গা করছে না, মনে কোরো। তুমি যেমন খুব চাইবে কেউ দরজাটা খুলে দিক, তোমার শেকল সেলাই সব খুলে দিক, আমিও তেমন চেয়েছিলাম, মাস পেরোলেও কেউ এ পথ মাড়ায়নি, দরজা খুলে দিলে আবার কী হয় না হয় ভেবে খোলেনি কেউ। মনে কোরো।
তোমার যখন খুব কষ্ট হবে, মনে কোরো আমারও হয়েছিলো, খুব ভয়ে ভয়ে সাবধানে মেপে মেপে জীবন চললৈও আচমকা অন্তরিন হয়ে যেতে পারে যে কেউ, তুমিও। তখন তুমি আমি সব একাকার, দুজনে এক সুতো তফাৎ নেই, তুমিও আমার মতো, তুমিও অপেক্ষা করো মানুষের, অন্ধকার কেঁপে আসে, মানুষ আসে না।