.
ম.
যাদের সঙ্গে বাস করবে বলে আমি অন্ধকূপে পড়ে আছি, অপেক্ষা করছি, এক একটা মুহূর্ত এক একটা যুগের মতো যদিও দীর্ঘ, করছি। যাদের সঙ্গে বাস করবো বলে ত্যাগ করছি আনন্দ উৎসব, জীবন যাপন, সমাজ সংসার, স্বাধীনতা, যাদের সঙ্গে বাস করবো বলে শরীর ক্ষয় করছি, ভেঙে গুঁড়ো হতে দিচ্ছি মন। যাদের সঙ্গে বাস করবো বলে প্রতিদিন জল ফেলছি চোখের, নিঃসঙ্গতার গায়ে সারারাত ধরে টুপটুপ ঝরে পড়ছে সে জল, ভেসে যাচ্ছে বয়স, যাদের সঙ্গে বাস করবো বলে বুকের মধ্যে বিশাল এক প্রত্যাশার প্রাসাদ গড়েছি, তারা কারা? তারা কি আমাকে মনে করে একবারও? কখনও হঠাৎ? কোনও দিন? কাঁদের সঙ্গে বাস করবো বলে ভয়ংকর দাতালের বিরুদ্ধে এক বিন্দু পিঁপড়ে হয়েও লড়াই এ নেমেছি? তারা কি আমার মতো ভালোবাসা জানে? আদৌ কি তারা ভালোবাসে?
.
য.
আমাকে কোনও একদিন কোনও বরফের দেশে, নির্বাসনে পাঠাবে ভারতবর্ষ। জমে যেতে যেতে একটু তাপ চাইবো, সামান্য উত্তাপ, দূর পরবাসে কে আছে যে দেবে কিছু স্মৃতিই যদি একমাত্র বাঁচায় আমাকে। সেইসব দিনই যদি উত্তাপ দেয়, দেবে।
আমার মধ্য কলকাতার আকাশ ছাওয়া বেড়াল-বেড়াল-বাড়িটাতে, বিকেল বেলা সুস্মিতা আসতেন কিছু না কিছু নিয়ে, কোনওদিন রাবড়ি, কোনওদিন ধনে পাতার আচার। গল্প বলতেন জীবনের, পাহাড় পর্বত ডিঙিয়ে কী করে তিনি তিনি হলেন। স্বাতী আর স্বপ্নার তুমুল তারুণ্য, উরি উচ্ছ্বাস, ঢোলের মতো বাজতো ঘরদোরে। শর্মিষ্ঠা নামের মেয়ে কত কত কবিতা আওড়ে সন্ধেগুলো উজ্জ্বল করেছে। বড় ভালোবেসেছিল শিবানী, বড় স্বজন ছিল শর্মিলা। বর্ধমান থেকে জয়প্রকাশ চলে আসতেন, হাতে সীলভোগ, হাতে মিহিদানা, মুখে সলজ্জ সম্ভাষণ। হঠাৎ উদয় হয়ে সকৌতুকে জীবন বলতো রঞ্জন। সুমিতাভে মগ্ন হওয়া সেই তীব্র বর্ষাগুলো। আর সেইসব সুব্রতময় দিন!
বরফে জমতে থাকা আমার শীতার্ত নির্বাসনে সেইসব দিনই যদি উত্তাপ দেয় দেবে। জঙ্গিপুর থেকে গিয়াসউদ্দিন আসতেন, চব্বিশ পরগনা থেকে মোজাফফর, আমাদের চোখের সরোবরে স্বপ্ন সাঁতার কাটতো,অবিশ্বাস্য সব সুন্দরের স্বপ্ন।
দেশ থেকে দাদা আসতো একতাল শৈশব নিয়ে, কাঁধে করে উঠিয়ে আনতো দেশের বাড়ি, দাদার গা থেকে গন্ধ বেরোতো হাসনুহানার। হাসনুহানার ওই গন্ধই যদি উত্তাপ দেয়, দেবে। দূর পরবাসে জমে জমে বরফ হতে থাকা আমাকে কে বাঁচাবে আর, যদি স্মৃতিই না বাঁচায়।
.
র.
বিখ্যাতদের সঙ্গে ওঠাবসা আমার কখনও ছিল না। নামী নামী লোকেরা আমার আশেপাশে খুব একটা ঘেঁসেনি কোনওদিন, অথবা সন্তর্পণে আমিই দূরে দূরে থেকেছি ভয়ে বা সংকোচে। আমার মতো করে তাই বাস করতে পারতাম শহরে, আমার মতো করে মাটিতে মাটির মানুষের সাথে। সহজ সাধারণরাই সাধারণত আমার স্বজন, বাজারের ঝকাওয়ালা, তরকারিওয়ালা, মাছ কাটার টগবগে ছেলেরা, মাছওয়ালা, চায়ের দোকানের বেজায় ভদ্রলোকটি, ধনঞ্জয় ধোপা, আর সেই মল্লিকপুর থেকে আসা মঙ্গলা, সোনারপুরের সপ্তমী, এদের ছেড়ে কোথায় কার কাছে যাবো? ওদিকে দুর্গা প্রতিমার মতো মুনা, কল্যাণী থেকে ছুটে আসা গার্গী, মানসী মেয়েটির ওই একবার ছুঁয়ে দেখতে চাওয়া, ছেড়ে কোথায় কোন নির্বাসনে যাবো আমি? উঠোনের ঘাসে ফুটে থাকা মনকাড়া ফুল, ‘মালিদা মালিদা, ও ফুলের নাম কী?’ একগাল হেসে মালিদা কতদিন বলেছে, ‘ও ফুলের তো দিদি কোনও নাম নেই।
দিগন্ত অবধি কত মাঠ জুড়ে কত সুগন্ধ ছড়ানো কত নামহীন ফুল,ছেড়ে কোথায় কার কাছে যাবো?
.
ল.
যারা দিচ্ছে কারাগারে আমাকে পাহারা, তাকায় বিস্ময় নিয়ে মাঝে মধ্যে তারা, কী কারণে পড়ে আছি একা একা জেলে জগৎ সংসার দূরে বহুদূরে ফেলে! বুঝতে পারেনা তারা, চোখের তারায় হয়তো কফোঁটা জল কাঁপে করুণায়! কানে কানে বারবারই প্রশ্ন করে যায় কে বাঁচে এভাবে স্বাধীনতাহীনতায়? আমি কি বুঝিনা বুঝি? একা অন্ধকারে বসে থেকে দুরারোগ্য ব্যাধি বাড়ে হাড়ে। কী করে এতটা ধৈর্য কোথায় পেলাম? ধৈর্যের পরীক্ষা হলে কার বদনাম! কে কার পরীক্ষা নেবে, মানবে কে হার! আমাকে করেছে বন্দি ক্ষুব্ধ সরকার। পরীক্ষা আমার নয়, তাদের এবার, কতদিনে করে দেখি বিষফোঁড়া পার। ধৈর্যের যা কিছু বাঁধ, ভেঙে সর্বনাশ, লাভ নেই টেনে ধরে ইস্পাতের রাশ! আপাতত করে নিচ্ছে ধর্মবাদ চাষ! পরেরটা পরে হবে, পরে রাজহাঁস। চুনোপুটি ধৈর্য ধরে বছর যাওয়াবে, তিমিরা সইবে কেন! আস্ত গিলে খাবে। আমার না হয় আশা আজকাল ক্ষীণ। ধর্মবাদের ফসল কোনও একদিন তাদের তুলতে হবে নিজেদের ঘরে, ভরে যাবে সবকটা ঘর বিষধরে। কালসাপগুলো পোষা দুধ কলা দিয়ে, একেকজনকে খাবে গিলে বা চিবিয়ে। সেদিনের কিন্তু খুব বেশি নেই বাকি, যেদিন জানবে তারা নিজেদেরই ফাঁকি দিয়ে গেছে দিন দিন, মনোবলহীন, তুখোড় রাজনীতিক, দূরদৃষ্টিহীন।
.
ষ.
আমি জেলে থাকি তাতে কার কী! এরকম কত লোক জেলে আছে! অন্যায় করিনি তাতেই বা কী! কত নিরপরাধ মরে পড়ে আছে কতখানে! ফাঁসি হয়ে যায় কত নির্দোষের, যাবজ্জীবনও হচ্ছে তো প্রতিদিনই। আমি কারাগারে এ আর এমন কী! এ তথ্য নতুন নয়। অনেক লেখককে শাসকেরা ভুগিয়েছে বিভিন্ন দেশে। খুব কিছু অভিনব নয় কারাগার-বাস। এরকম বলে দায়িত্ব এড়ান বড় বড় লোক। হঠাৎ কখনও রহস্যময় মৃত্যুটি এসে গেলে খবর বেরোবে, আপদ মরেছে অবশেষে। তাতেই বা কারও কিছুই কি যায় আসে। কজন দাঁড়াবে জানতে মৃত্যুর কারণ, প্রতিবাদ মিছিলে সাকুল্যে কুড়িজন হবে তোক? অভিজ্ঞতা আমাকে সমৃদ্ধ করেছে বটে, ক্ষমতাকে কম বেশি সবাই আমরা চিনি। নির্বাসনে না গেলে মানুষ কি চেনা যায়। এই মেরুদন্ডহীনের দেশে ভাবতে লজ্জা হয় ভালোবেসে বাস করি। হাতে গোনা কিছু সৎ ও সাহসী মানুষ হৃদয়ে রয়ে যাবে যতদিন বাঁচি, এই দেশ থেকে আর প্রাপ্তির কিছু নেই।