.
ন.
একজন স্বাধীনতা সংগ্রামী প্রতিদিন এক থোকা গোলাপ পাঠাতেন আমার কলকাতার বাড়িতে। তিনি এদেশের স্বাধীনতার জন্য সংগ্রাম করেছিলেন, গণতন্ত্রের জন্য করেছিলেন, বাক স্বাধীনতার জন্য সংগ্রাম করেছিলেন তিনি, তাঁর কাছ থেকে আমি গোলাপ পেয়েছি প্রতিদিন। ক্ষমতার চাবুক মেরে যারা আমার মনকে রক্তাক্ত করছে, জীবনকে, জীবনের সব স্বপ্নকে প্রতিদিন রক্তাক্ত করছে, তারা শুধু আমাকে নয়, ওই স্বাধীনতা সংগ্রামীকেও রক্তাক্ত করছে চাবুক মেরে, প্রতিদিন। তারা জানেনা স্বাধীনতা সংগ্রামীর ওই গোলাপের রঙ রক্তের চেয়েও লাল। এখন আর গোলাপ নয়, এখন এক ঠিকানাহীন ঠিকানায় প্রতিদিন আমার জন্য মনে মনে চোখের জল পাঠান তিনি, এই জল দিয়ে আমার ক্ষতগুলোর শুশ্রূষা করি। গোলাপের স্মৃতি থেকে বিশুদ্ধ সুগন্ধ বাতাস নিয়ে এই স্বাসরোধ করা পরিবেশে খাস নিই। এই স্বাধীন দেশের গোপন কুঠুরিতে পরাধীনতার শক্ত-শেকলে বাঁধা নির্বাসিত নিঃস্ব নারী, তাকে আজ মুক্ত করার শক্তি নেই কোনও স্বাধীনতা সংগ্রামীরও। স্বাধীনতা হয়তো এ জীবনে আমার দুরূহই হবে পাওয়া। ওই গোলাপগুলোকে ডাকবো স্বাধীনতা বলে, ওই চোখের জলগুলোই আমার স্বাধীনতা।
.
প.
সারা বছর বসে থাকি এই মেলাটি আসবে বলে। এই মেলাটির অলি গলির ভিড়ের মধ্যে নতুন বইয়ের গন্ধে ঘ্রাণে, ধুলোবালির ধূসর হাওয়ায়, হারিয়ে যাওয়ার স্বপ্ন দেখি। এই মেলাটি আসবে বলে আকাশপারের উতল হাওয়ায় ইচ্ছে মতো ঘুড়ি ওড়াই। বছর বছর এই মেলাটি আসে বলেই স্যাঁতসেঁতে এক ঘরের কোণেও খুব গোপনে ভীষণ সুখে, স্বপ্নসহ বেঁচে থাকি। আমার তো আর পুজো-আচ্চা, ঈদ-বড়োদিন নেই, আমার একটি মেলাই আছে, প্রাণের মেলা,এই একটি মেলায় মানুষ দেখি কাছের মানুষ, সাত-নদী-জল সাঁতরে তবু একটুখানি ছুঁতে আসে। এই মেলাটিই ধর্মকর্ম, ধূপের কাঠি, ধানদুব্বো। এই একটি পরব, একটি সুখ-ই, নিজের জন্য তুলে রাখি। শিল্প-মেলায় আগ্রহ নেই, জুয়োর মাঠ, ব্যবসা পাতি, সন্ধে হলে উৎসবে নেই, ককটেলে নেই। এই একটি মেলাই একমাত্র। এই মেলাটিই শৈশব দেয়, কৈশোর দেয়, ব্রহ্মপুত্র পাড়ের সেসব এঁটেল মাটির আনন্দ দেয়। এই মেলাটির সারা গায়ে মাতৃভাষা, মাথার ওপর স্নেহসিক্ত মায়ের আঁচল। এই মেলাকেই অন্য অর্থে জীবন বলি।
এটিও তুমি কেড়ে নিলে? স্বদেশহারা স্বজনহারা সামান্য এই সর্বহারার সবটুকু সুখ বুকের ওপর হামলে পড়ে আঁচড়ে কামড়ে এক থাবাতে ছিনিয়ে নিতে পারলে তুমি ভারতবর্ষ? দাঁত বসিয়ে কামড় মেরে ছিঁড়েই নিলে যা-ছিল-সব? হৃদয় বলতে কিছুই কি নেই ভারতবর্ষ? হৃদয় তবে কোথায় থাকে ভারতবর্ষ?
.
ফ.
আজ যদি বেঁচে থাকতেন গান্ধিজী, যে করেই হোক বন্দি শিবির থেকে আমাকে উদ্ধার করতেন। নিরাপদে বাড়ি পৌঁছে দিতেন। এ আমি হলফ করে বলতে পারি, দিতেন। হৃদয় বলে যেহেতু তার কিছু ছিল, তিনি দিতেন। বাড়ির ঘর দোর উঠোন আঙিনায় নিশ্চিন্তে হাঁটাহাঁটি, উছলে পড়া খুশি, বিন্দু বিন্দু স্বপ্ন দিয়ে সাজানো সংসার-সমুদ্রে আমার সঞ্জীবনী সাঁতার দেখে বড় সস্নেহে হাসতেন তিনি। হৃদয় বলে যেহেতু কিছু ছিল তাঁর, হাসতেন। আমাকে আমার মতো যাপন করতে দিয়ে আমার জীবন, আমি নিশ্চিত, তিনি স্বস্তি পেতেন। গান্ধিজী যদি বেঁচে থাকতেন আজ, দেশের দুর্দশা দেখে তার দুঃখ হত। কালসাপের মতো ফঁসে ওঠা অসহিষ্ণুতার সন্ত্রাস বন্ধ করতে দেশব্যাপী অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দিতেন তিনি। নিশ্চয়ই দিতেন। আমাকে আর কতটুকু, মূলত দেশটাকেই বাঁচাতেন।
.
ব.
বরং বাঘ টাঘ নিয়ে বলো, কৃষ্ণসার হরিণ নিয়ে কথা বলে। মানুষের কথা বলোনা, মানুষ খুব ভয়ংকর। বাঘকে খাঁচাবে তো রক্ষে নেই। হরিণের গায়ে হাত তুলেছো কী মরেছো। মানুষকে খোঁচালে চলে, বোমা মেরে উড়িয়ে দিলেও ঠিক আছে। যে মানুষ যুক্তি দেখায়, তর্ক করে, ভাবে, ভাবনাটা ছড়ায়, তারা মানুষ তো নয়, আগুন।
আগুন যে করেই হোক নেভাতে হয়। যে মানুষগুলো জন্তুর মতো, ভাবনা নেই, বেশ আছে, খায় দায় ঘুমোয়, যেভাবে অন্যরা চলে, সেভাবে চলে। ওদের বাঁচিয়ে রাখো। জন্তুরা খায় দায় ঘুমোয়, আর জঙ্গলের শোভাবর্ধন করে। এই চিন্তাশক্তিহীন লোকগুলোও লোকালয় শোভিত করে আছে বহুকাল। এরাই থাকুক বেঁচে। দুধে ভাতে। চিন্তকদের কথা ছাড়ো, কৌশলে বন্দি করো ওদের, পারলে মেরে ফেলো!
ওদের কথা নয়, বরং অন্য কথা বলল। হরিণ টরিণ।
.
ভ.
একটা কথা আমার মুখ থেকে শুনবে বলে সবাই বসে আছে। একটা বাক্য শুনবে বলে বসে আছে, দুটো শব্দ শুনবে বলে, দুটো মাত্র শব্দ। আতঙ্কে,ভয়ে, বিবর্ণ হয়ে, কাঠ হয়ে, যেন বলে ফেলি একদিন, গুডবাই ইন্ডিয়া। দিন যাচ্ছে, সপ্তাহ শেষ হচ্ছে, মাস পেরোচ্ছে, মাসের পর মাস। আমার মুখের দিকে কয়েকশ রক্তচক্ষু, কয়েকশ বছর আগে বন্ধ হয়ে থাকা পুরোনো ঘড়ির কাঁটার মতো স্থির, ডানে বামে ওপরে নিচে সর্বত্র বাদুরের কানের মতো উৎসুক কান, জগতের সবচেয়ে মধুর শব্দদ্বয় শুনবে বলে, গুডবাই ইন্ডিয়া। আমি এখনও উচ্চারণ করছি না শব্দদুটো, এখনও বিশ্বাস করছি সত্যে। সততায়। বিশ্বাস করছি সৌন্দর্যে। শিল্পে। সহমর্মিতায়।
যেদিন আমাকে উচ্চারণ করতে হবে শব্দদুটো, যদি আমাকে করতেই হয়–দু’চারটে ঘৃণাই যেদিন উথলে উঠে সুনামি ঘটাবে, যদি ঘটায়ই মনুষ্যত্ব পায়ে পিষে ধর্মান্ধতার নিশান ওড়াবে মানুষ শহর নগর জুড়ে যেদিন –যেদিন আমারই রক্তের ওপর আমি লাশ হয়ে ভেসে থাকবো, ঠুকরে খাবে একপাল শকুন আমার ফুসফুস যেদিন আমাকে উচ্চারণ করতেই হবে শব্দদুটো, সেদিন যেন গভীর রাত্তির হয়, আমাকে যেন দেখতে না হয় দেশটির মুখ, দেখতে না হয় দুপুরের শান্ত পুকুর, আমগাছতলা, উঠোনের রোদ্দুর, যেন ভুলে যাই দেশটির সঙ্গে কখনও আমার কোনও আত্মীয়তা ছিল। আমি এখনও উচ্চারণ করছি না শব্দদুটো, এখনও প্রাণপণে পাথর করে রেখেছি জিভ। আমি উচ্চারণ করতে চাইছি না–এখনও চাইছি ভালোবাসার জয় হোক।