আর কমিউনিস্ট লেখক আজিজুল হক লিখলেন, ‘শারীরিক এবং মানসিকভাবে দেউলিয়া লেখিকা লজ্জা বিসর্জন দিয়ে রাস্তায় নেমেছেন। পোশাক পরে আছেন নেহাত অভ্যাসবশত। ..এটা নাকি বাক স্বাধীনতা। ভাদুরে কুকুর রক্ষা সমিতির দাবি, পাগলা কুকুরদের খ্যাক খ্যাক করে তেড়ে আসার অধিকারটাও হিউম্যান ফ্যাসিজমের বিরুদ্ধে কুকুরীয় স্বাধীনতা। কারুর যদি যা খুশি বলার স্বাধীনতা থাকে, অন্য কারুর হাতের স্বাধীনতা থাকতেই পারে। গলাটা টিপে দেওয়ার স্বাধীনতাই বা থাকবে না কেন! কোনো মহিলা যদি নিজের দেহকে পাবলিক ইউরিনাল করে সাজিয়ে তুলে ধরেন, কী বলবেন? সুলভ কমপ্লেক্স হলে পে এণ্ড ইউজ। এতে হইচই করার কী আছে? .. নিষিদ্ধ নয়, বর্জন করুন এই বর্জ্য পদার্থ। রাস্তায় বর্জ্য পদার্থ পড়ে থাকলে কেউ লাথি মারে না। হয় ডিঙিয়ে যায়, না হয় সাফাইকর্মী ডাকে। সাফাইকর্মীরা সাফ করুক। প্রতিরোধ গড়ে উঠুক ছাপাখানায়। বাইণ্ডারদের কারখানায়। জবাব এটাই। ..সুস্থ সংস্কৃতির জন্য যারা গলা ফাটান, তাঁরা কোথায়? কোথায় গেলেন সেই কর্মী বাহিনী, যারা প্রকাশক, মুদ্রক, এবং বাঁধাইখানার সামনে পিকেট করে আমাদের সংহতি বিনষ্টকারী বর্জ্য পদার্থটিকে (বই বলতে ঘৃণা হয়) বর্জনের জন্য আন্দোলন গড়ে তুলবেন?’
আজকাল পত্রিকার সম্পাদক অশোক দাশগুপ্ত লিখেছেন, ‘তসলিমার দ্বিখণ্ডিত দুটি কারণে জঘন্য, বর্জনীয়। প্রথমত রুচি, অশালীনতা, অবাধ চরিত্রহনন। মামলা হয়েছে ঢাকায়, কলকাতায়। রাজ্য সরকার সে জন্য নিষিদ্ধ ঘোষণা করেনি। কিন্তু আমরা এই প্রথম কারণটিও একটু দেখব। ক. সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় বলেছেন, প্রাপ্ত বয়স্ক পুরুষ ও প্রাপ্ত বয়স্ক নারী যদি স্বেচ্ছায় কোনও সম্পর্ক স্থাপন করেন, তা একধরনের চুক্তি, যে কোনও একজন নিজের স্বার্থে তা প্রচার করতে পারেন না। অন্তত, উচিত নয়। খ. ফুটপাতের হলুদ মলাটের বইয়ে হয়তো আরও রগরগে বর্ণনা থাকে, কিন্তু সেখানে সব চরিত্র কাল্পনিক, জীবিত, পরিচিত ব্যক্তিদের টেনে আনা হয় না। গ. কোনো লেখক বা লেখিকা তার পরিচিত ব্যক্তিদের নাম করে যা খুশি লিখেছেন, কেন মানতে হবে সে সব সত্যি? কী করে বলা যাবে যে অতিরঞ্জিত বা বিকৃতি নেই? ঘ. তসলিমা নিজে না হয় চালচুলোহীন, সামাজিক দায়দায়িত্বের ধার ধারেন না, যাঁদের সম্পর্কে লিখেছেন, সত্যি অথবা মিথ্যে, তাঁদের সামাজিক সম্মান নেই? তাঁদের সন্তান নেই? পারিবারিক বৃত্ত নেই? .. তসলিমার ৩৯৩ পাতার আবর্জনাকে যদি বা উপেক্ষা করা যায়, ২ পাতার প্ররোচনামূলক অসভ্যতাকে ক্ষমা করা যায় না। শঙ্খ ঘোষ বা সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় কোনো বই নিষিদ্ধ ঘোষণার পক্ষে নন। কিন্তু এই একটি বইকে ওঁরা ব্যতিক্রম মনে করছেন।’
.
বিষ মাখানো নিন্দা আর ঘৃণার তীর যখন দুই বাংলা থেকে ছোঁড়া হচ্ছিল, তখনই দেশ পত্রিকা থেকে আমাকে অনুরোধ করা হয়েছিলো প্রতিক্রিয়া লিখতে। লিখেছিলাম, নিউইয়র্কে বসে, এক মধ্যরাতে। ঠিক এভাবেই লিখেছিলাম —
‘Freedom is always and exclusively freedom for the one who thinks differ ently.’ –Rosa Luxemburg
জীবনের অনেকগুলো বছর পেরিয়ে যখন দেখি পিছনের দিনগুলো ধূসর ধূসর, আর সেই ধূসরতার শরীর থেকে হঠাৎ হঠাৎ কোনো ভুলে যাওয়া স্বপ্ন এসে আচমকা সামনে দাঁড়ায় বা কোনো স্মৃতি টুপ করে ঢুকে পড়ে আমার একাকী নির্জন ঘরে, আমাকে কাঁপায়, আমাকে কাঁদায়, আমাকে টেনে নিয়ে যায় সেই দিনগুলোর দিকে –তখন কী জীবনের সেই অলিগলির অন্ধকার সরিয়ে সরিয়ে কিছু শীতার্ত স্মৃতি কুড়িয়ে আনতে আমি না হেঁটে পারি! কী লাভ হেঁটে! কী লাভ স্মৃতি কুড়িয়ে এনে! যা গেছে তা তো গেছেই! যে স্বপ্নগুলো অনেককাল মৃত, যে স্বপ্নগুলোকে এখন আর স্বপ্ন বলে চেনা যায় না, মাকড়সার জাল সরিয়ে ধুলোর আস্তর ভেঙে কী লাভ সেগুলোকে আর নরম আঙুলে তুলে এনে! যা গেছে, তা তো গেছেই। জানি সব, তবুও আমার নির্বাসনের জীবন আমাকে বারবার পিছনে ফিরিয়েছে, আমি আমার অতীত জুড়ে মোহগ্রস্তের মতো হেঁটেছি। দুঃস্বপ্নের রাতের মতো এক একটি রাত আমাকে ঘোর বিষাদে আচ্ছন্ন করে রেখেছে। তখনই মেয়েটির গল্প বলতে শুরু করেছি আমি।
একটি ভীরু লাজুক মেয়ে, যে মেয়ে সাত চড়েও রা করেনি, পারিবারিক কড়া শাসন এবংশোষণে ছোট্ট একটি গণ্ডির মধ্যে বড় হয়ে উঠেছে, যে-মেয়ের সাধ-আহ্লাদ প্রতিদিনই ছুঁড়ে ফেলা হয়েছে আবর্জনার স্তূপে, যে-মেয়েটির ছোট্ট শরীরের দিকে লোমশ লোমশ লোভী হাত এগিয়ে এসেছে বারবার, আমি সেই মেয়ের গল্প বলেছি। যে-মেয়েটি কিশোর বয়সে ছোট ছোট কিছু স্বপ্ন লালন করতে শুরু করেছে, যে-মেয়েটি হঠাৎ একদিন প্রেমে পড়েছে, যৌবনের শুরুতে বিয়ের মতো একটি কাণ্ড গোপনে ঘটিয়ে আর দশটি সাধারণ মেয়ের মতো জীবন যাপন করতে চেয়েছে, আমি সেই সাধারণ মেয়েটির গল্প বলেছি। যে-মেয়েটির সঙ্গে প্রতারণা করেছে তার স্বামী তার সবচেয়ে ভালোবাসার মানুষ, যে মেয়েটির বিশ্বাসের দালানকোঠা ভেঙে পড়েছে খড়ের ঘরের মতো, যে-মেয়েটি শোকে, সন্তাপে, বেদনায়, বিষাদে কুঁকড়ে থেকেছে। চরম লজ্জা আর লাঞ্ছনা যাকে আত্মহত্যা করার মতো একটি ভয়ংকর পথে নিয়ে যেতে চেয়েছে, চুরমার হয়ে ভেঙে পড়া স্বপ্নগুলো জড়ো করে যে-মেয়েটি আবার বাঁচতে চেয়েছে, নিষ্ঠুর নির্দয় সমাজে নিজের জন্য সামান্য একটু জায়গা চেয়েছে, যে-মেয়েটি বাধ্য হয়েছে সমাজের রীতিনীতি মেনে পুরুষ নামক অভিভাবকের কাছে নিজেকে সমর্পণ করতে, আর তার পরও যে মেয়েটির ওপর আবার নেমে এসেছে একের পর এক আঘাত, যে-আঘাত গর্ভের জ্বণটিকে নষ্ট করে দেয়, যে আঘাত প্রতি রাতে তাকে রক্তাক্ত করে, যে-আঘাত তার, কুটিলতার, অবিশ্বাসের আর, অসহ্য অপমানের আমি সেই দলিত দংশিত দুঃখিতার গল্প বলেছি মাত্র। দুঃখিতাটি তার শরীরে আর মনে যেটুকু জোর ছিল অবশিষ্ট, সেটুকু নিয়ে আবার উঠে দাঁড়িয়েছে, দাঁড়াবার জন্য সামান্য জায়গা পেতে কারও দ্বারস্থ হয়নি এবার, একাই লড়েছে সে, একাই বেঁচেছে, নিজেই নিজের আশ্রয় হয়েছে, এবার আর কারও কাছে নিজেকে সমর্পণ করেনি, বঞ্চিত হয়েছে বলে যোগিনী সাজেনি, কারও ছিঃ ছিঃর দিকে ফিরে তাকায়নি এই ফিরে না তাকানোর গল্প আমি বলেছি। সমাজের সাত রকম সংস্কারের ধার ধারেনি মেয়ে, বারবার তার পতনই তাকে দাঁড়াতে শিখিয়েছে, বারবার তার হোঁচট খাওয়াই তাকে হাঁটতে শিখিয়েছে, বারবার তার পথ হারানোই তাকে পথ খুঁজে দিয়েছে। ধীরে ধীরে নিজের ভেতরে যে-নতুন একটি বোধ আর বিশ্বাসকে সে জন্ম নিতে দেখেছে, তা হল, তার নিজের জীবনটি কেবল তারই, অন্য কারও নয়। এই জীবনটির কর্তৃত্ব করার অধিকার কেবল তারই। আমি মেয়েটির সেই গড়ে ওঠার গল্প বলেছি যে পরিবেশ প্রতিবেশ তাকে বিবর্তিত করেছে, তাকে নির্মাণ করেছে, পিতৃতন্ত্রের আগুনে পুড়ে যে-মেয়ে শেষ পর্যন্ত দগ্ধ হল না, পরিণত হল ইস্পাতে, সেই গল্প।