.
ঢ.
আশাগুলো একটু একটু করে চোখের জলের মতো টুপটাপ ঝরে পড়ছে, আশাগুলোকে উড়িয়ে নিচ্ছে নিরাশার লু হাওয়া। এই কঠোর নির্বাসনে স্বজন বন্ধু থেকে বিচ্ছিন্ন। কোনও অপরাধ না করে আমি অপরাধী, যে কোনও মুহূর্তে মৃত্যুদন্ড ঘোষিত হবে। একটু আশার আশায় সারাদিন বসে থাকি, কোনও ফাঁক ফোকর দিয়ে যদি ভুল করেও ঢোকে। সারারাত জেগে থাকি, ধুলোর ওপরও উপুড় হয়ে আশা বলে কিছু যদি আচমকা চিকচিক করে, খুঁজি। কিছু নেই। জীবন পেতে আছি, পারো তো কিছু আশা দিও, সামান্য হলেও ক্ষতি নেই, দিও। মিথ্যে করে হলেও দিও, তবু দিও।
.
ণ.
অপরাধীরা বড় নিশ্চিন্তে যাপন করছে তাদের জীবন, ধাপ্পাবাজি, ধর্মব্যবসা, সবকিছুই দেদার চলছে, বুক ফুলিয়ে পাড়ায় হাঁটছে, আরও কী কী অপরাধ করা যায়, তার মতলব আঁটছে, অপরাধীরা চমৎকার আছে ভারতবর্ষে, তাদের গায়ে টোকা দেওয়ার দুঃসাহস কারও নেই।
তারা অন্যায় করেছে বলে, শাস্তি তারা নয়, আমি পাচ্ছি, আমি শাস্তি পাচ্ছি যেহেতু তারা আমার বিরুদ্ধে অন্যায় করেছে। তারা আমাকে দেশ ছাড়ার হুমকি দিয়েছে বলে,আমাকে দেশ ছাড়তে বাধ্য করার ব্যবস্থা চলছে সাতমাস ধরে। আমাকে হত্যা করার বেআইনি ফতোয়া জারি করেছে বলে, দেশের আইন ভেঙেছে বলে, তারা নয়, শাস্তি পাচ্ছি আমি।
অপরাধ করিনি বলে এখনও অপেক্ষা করছি। দেখছি হেঁচকা টান দিয়ে নিরপরাধের গোটা জীবনটা তুলে কোথাও কোনও অজ্ঞাতস্থানে ঝুলিয়ে রাখতে কতদিন পারে দেশ। দেখছি একশ কোটি মানুষের দেশের কতদিন লাগে অবশেষে মানবিক হতে!
এ দেশ আমার পূর্বপুরুষ বা পূর্বনারীর মাতৃভূমি বলে নয়, এরই জল-হাওয়ায় আমার বেড়ে ওঠা বলে নয়, এরই সংস্কৃতি আমাকে সমৃদ্ধ করেছে বলে নয়। আমি মানুষ বলে দাবি, মানুষের হয়ে দাবি –ভারতবর্ষকে ভালোবেসে এই দাবি–অপরাধীকে শাস্তি -দেওয়া যদি নীতি হয়, তোক, নিরপরাধকে নির্যাতন করার নীতি যেন না হয় এ-দেশের।
.
ত.
অথৈ অন্ধকারে, অদ্ভুত অজ্ঞাতবাসে পড়ে থাকা অসার আমার কাছে কেউ নেই আসে। চাঁদের দিকে চাতক পাখির মতো চেয়ে থাকি, মানুষের কাছে, আশ্চর্য, চাঁদও শিখেছে ফাঁকি। জীবনে অমাবস্যা ঢেলে দিয়ে পূর্ণিমা পালায়,পেছনে দৌড়ে দৌড়ে কত ডাকি, আয়, ফিরে আয়। চাঁদের কী আসে যায়! মানুষের কাছে দুদন্ড ইদানীং মানুষই থাকে না, দূরত্ব খোঁজে আত্মার আত্মীয়, জন্ম জন্ম চেনা।
দক্ষিণ থেকে উতল হাওয়ারা ছুটে ছুটে ছুঁতে আসে, হাওয়াই ভরসা ছিল অতপর অজ্ঞাতবাসে। হা কপাল! হাওয়াও উজাড় করে হাহাকার দিল, জীবনে যা কিছু ছিল বা না-ছিল, নিল। আকাশের কাছে কিছুই চাই না, ও আর কী দেবে? দিলে এক শূন্যতা দেবে। ও আমার যথেষ্ট আছে, ও নিয়েই আছি, ও নিয়েই ভারতবর্ষের অজ্ঞাতবাসে বাঁচি।
.
থ.
তোমরা সবাই মিলে কিছু একটা দোষ আমার বার করো, কিছু একটা দোষ তোমরা সবাই মিলে বার করো, না হলে অকল্যাণ হবে তোমাদের। সবাই মিলে তোমরা বলো কী কারণে আমাকে নির্বাসন দিয়েছে। আমার জন্য কোথাও মড়ক লেগেছে। কোথাও শিশুমৃত্যু, ধর্ষণ বা গণহত্যার মতো কোনও অপরাধ আমি করেছি, এরকম কিছু একটা বলল, নির্বাসনের পক্ষে অন্তত দুটো তিনটে যুক্তি হলেও দাঁড় করাও। যতদিন না জুৎসই কোনও দোষ ধরতে পারছো, যতদিন না কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে ঘৃণার আঙুল তুলে দেখাতে পারছে কুলাঙ্গারকে, ততদিন কী করে ক্ষমা করবে নিজেদের! কিছু একটা দোষ পেলে আমিও স্বস্তি পেতাম। নির্বাসনকে অতটা নির্বাসন বলে মনে হত না। কিছু একটা দোষ বার হোক আমিও চাই, শুভাকাঙ্ক্ষী ভেবে তোমাদের ফের আলিঙ্গন করতে আমিও চাই।
কী দোষে আমাকে সমাজচ্যুত করেছে, বলো। কিছু একটা দোষ বার করো, দোষ বার করে দোষ-স্থলন করো নিজেদের। ইতিহাসকে কেন সুযোগ দেবে কুটি করার! একখন্ড মধ্যযুগ এনে সভ্যতাকে কেন কলঙ্কিত করেছে, কিছু কারণ বার করো এর। না যদি পারো, আমাকে বাঁচাতে নয়, তোমাদের বাঁচাতেই আমাকে মুক্তি দাও..
.
দ.
অন্নদাশংকর রায় একবার বলেছিলেন, ‘বাংলাদেশ তসলিমার মা, পশ্চিমবঙ্গ তসলিমার মাসি’। মায়ের চেয়ে মাসির দরদ বেশি ছিল, একটা সময় এমন কথাও বলতো লোকে।
বন বাদাড় আর নদ পেরিয়ে, মাসির কোলে এসেছিলাম কাঁদতে আমি মায়ের শোকে।
মাসিই কিনা কোল দিল না, কাঁদার জন্য কাঁধ দিল না, মাসির প্রিয় বুনো ফুল, হঠাৎ হল চক্ষুশূল। সকাল সন্ধে মাসিই তাড়ায়, মাসিই বলে মর গে যা, কোথায় যাবে অনাথ মেয়ে, কোন মুলুকে খুঁজবে মা?
.
ধ.
আমি ভালো নেই, তুমি ভালো থেকো প্রিয় কলকাতা। ভালো নেই আমি, এভাবে কেউ কোনওদিন ভালো থাকেনি কোথাও। এভাবেই তুমি আমাকে রেখেছো কলকাতা, এভাবেই নির্বাসনে, এভাবেই একঘরে করে। এভাবেই অন্ধ কূপে। পায়ের তলায় পিষছে প্রতিদিন, প্রতিদিন পিষছো পায়ের তলায়। গলাটিপে ধরেছো কথা বলেছি বলে, হাত কেটে নিয়েছো লিখেছি বলে। কাউকে হত্যা করিনি, কারও অনিষ্ট করিনি, কারও দিকে পাথর ছুঁড়িনি, মানবতার পক্ষে কিছু অপ্রিয় সত্য উচ্চারণ করেছি বলে আমাকে তোমার পছন্দ নয়। আমাকে উৎখাত করেছে আমার মাতৃভাষা থেকে, উৎখাত করেছে আমার মাটি ও মানুষ থেকে, উৎখাত করেছো জন্ম-জন্মান্তরের ইতিহাস থেকে, উৎখাত করেছো ঘর বাড়ি বাসস্থান থেকে, পৃথিবীতে আমার সর্বশেষ আশ্রয় থেকে। আমি ভালো নেই তাতে কী! তুমি ভালো থেকো, তুমি বড় বড় কবির শহর, সাহিত্যিকের শহর, দার্শনিক শুভবুদ্ধির শহর, ভারতবর্ষের সবচেয়ে প্রগতিশীল শহর তুমি, কলকাতা, তুমি তো সংস্কৃতির পীঠস্থান, কলকাতা, তুমি ভালো থেকো। তুমি সুখে থেকো প্রিয় কলকাতা, নাচে গানে থেকো, উৎসবে আনন্দে, মেলায় খেলায় থেকো সুখে। তুমি তো মহান, তুমি বিরাট, তুমি অট্টহাসি হাসো, জগৎ দেখুক।