.
জ.
মিনু নেহাত বেড়াল নয়। আমার কন্যা। কন্যাটিকে ফেলে আসতে হয়েছে কলকাতায়, নাওয়া খাওয়া বন্ধ করে বসেছিল দীর্ঘদিন, এখনও মলিন মুখে জানালায় বসে থাকে, দিন গোনে। শীত কাটাতে হল একা একা, নরম লেপের তলায় আমার উষ্ণতা পেতে পেতে এ বছর আর ঘুমোনো হল না ওর। আমার অপেক্ষা করে ওর শীত গেল, ছুটির গরমকাল যেন না যায়! যে-করেই হোক আমাকে ও চায়, ফিরে পেতে চায় নির্ভাবনার সেইসব দিন।
গড়িয়াহাট থেকে তুলে আনা শিশুটি কয়েকবছরে ধীরে ধীরে বুকের ধন হয়ে উঠেছিল। স্বজন বলতে এক আমিই ছিলাম ওর, জগৎ বলতে এক আমিই। আমার কিশোরী কন্যাটি তার ঘর বাড়ি, তার বিছানা বালিশ ছেড়ে রোদ্দুরে ভেসে যাওয়া প্রিয় বারান্দাটি ছেড়ে, খেলনা-ইঁদুর ছেড়ে মন-মরা বসে আছে স্যাঁতসেঁতে অন্ধকারে, দিনশেষে চোখ ভেসে যেতে থাকে চোখের জলে। কলকাতা, আমাকে দাওনি, আমার নিরাশ্রয় কন্যাটিকে আশ্রয় দিও, আমাকে রাখোনি, আমার অনাথ কন্যাটিকে দেখে রেখো।
.
ঝ.
কূপমন্ডুকের দল বিপক্ষে গেলেও, কট্টরপন্থীরা আস্ফালন করলেও, কবন্ধরাঘিরে ধরলেও, মানুষ থাকে পাশে, শুভাকাঙ্ক্ষীরা থাকে। যখন রাজ্য তাড়ায়, যখন ক্ষমতা বিপক্ষে যায়, যখন রাষ্ট্রযন্ত্র বিরুদ্ধে দাঁড়ায়, মানুষ সরতে থাকে, মানুষ পালায়। শুভাকাঙ্ক্ষী বলে পরিচিতরাও নিরাপদ আড়াল খোঁজে, প্রতিষ্ঠান সরে যায়, বেসরকারি ক্ষুদ্র দলও ক্ষুদ্র গর্তে লুকোয়, স্বনামধন্যরা চোখ বুজে থাকে। বন্ধু বলে যাদের চিনি, তারাও আচমকা অন্যত্র ব্যস্ত হয়ে পড়ে।
হাতে গোনা কিছু মানুষ শুধু পাশে থাকে, নির্ভেজাল কিছু মানুষ। সাহস আর সততা সম্বল করে সত্যিকার কিছু স্বার্থহীন বন্ধু থাকে পাশে।
ওরা আজ মিছিল করছে, ওরা মোমবাতি হাতে হাঁটছে সন্ধের শহরে, জোট বেঁধে বিচার চাইছে অবিচারের। কে বলেছে এই সংগ্রাম একার আমার? বাক স্বাধীনতা রক্ষা হলে এদেশের মানুষেরই হবে, এ আমার একার নয়, স্বপ্নবান মানুষের সবার সংগ্রাম। এই দুঃসময় আমার একার নয়, আমাদের সবার দুঃসময়। যদি কোনওদিন জয় হয় মুক্তচিন্তার–ব্যক্তি আমার চেয়ে শতগুণ হবে ভারতবর্ষের জয়।
এ আমার একার কিছু নয়, আমার পাশে ওরা নয়, বরং ওদেরই পাশে, ওই অবস্থান ধর্মঘটের পাশে, অনশনের পাশে, ওই মিছিলের মানুষের পাশে, ভারতবর্ষের পাশে, আমি আছি, দূর কারাবাস থেকেও আছি, ঘোর অনিশ্চয়তা আর অন্ধকার থেকেও আছি পাশে।
ঞ.
বেঁচে আছি!
.
ট.
তোমাকে তোমার বাড়ি থেকে ছিনতাই করে নিয়ে গেছে ওরা, তোমার জীবন থেকে তোমাকে কেড়ে নিয়ে বন্দি করেছে ব্যালটবাক্সে। কোনও স্বজনের একটি হাতও, সামান্য সুযোগ নেই, একবার স্পর্শ করো, তোমারই জীবনের কণামাত্র তোমার অধিকারে নিয়ে তোমার সুযোগ নেই একবার যাপন করো। মানো বা নাই মানো, অন্যের সম্পত্তি এখন তুমি, তোমার কিছুই আর তোমার নেই, একঘর হাহাকার ছাড়া তোমার জন্য বরাদ্দ একফোঁটা কিছু নেই। স্বাধীনতা সাত সমুদ্র তের নদীর ওপারের ভুতুড়ে জিনিস।
ওদের ইচ্ছে তুমি উন্মাদ হও, স্নায়ুতন্ত্রে যদি খুব শক্তি ধরো, উন্মাদ হতে যদি না-ই পারো, তবে দেশ ছাড়ো, যে করেই হোক ছাড়ো, এ দেশ তোমার নয়। মাটি কামড়ে কতদিন কে-ই বা পড়ে থাকতে পারে! এত ঘৃণা, এত থুতু, এত লাথি কতদিন সইতে পারে মাথা উঁচু করে বাঁচতে শেখা মানুষ। ওরা চাইছে, উন্মাদ যদি না-ই হও, দেশ যদি না-ই ছাড়ো, অন্তত মরো।
তুমি সাফ কথা জানিয়ে দিয়েছে গতকাল, যা হয় তা হোক, আপাতত কোনওটিরই সম্ভাবনা নেই। কৃতজ্ঞতা জানিয়ে বিনীত কণ্ঠে বলেছে, দিনে দিনে তোমাকে অসম্ভব সহিষ্ণু করে গড়ে তোলার পেছনে অবদান ওদেরই। এখন আগুনে পোড়ালেও তুমি পুড়ে পুড়ে আর দগ্ধ হবে না, বড়জোর যদি কিছু হও ইস্পাত হবে।
.
ঠ.
আমি তো মানুষ ছিলাম, সমাজ সংসার ছিল, স্বপ্ন ছিল। বারান্দার ফুলগাছ, বাজার হাট, বিকেলবেলার থিয়েটার, বন্ধুর বাড়ি–আর সবার মতো আমারও ছিল। হঠাৎ কিছু লোক তুড়ি মেরে মুহূর্তে আমাকে নিষিদ্ধ বস্তু বানিয়ে দিল!
কার কী নষ্ট করেছিলাম আমি? কিছুই তো ছিল না আমার, শুধু ওই স্বপ্নটুকু ছিল, ওই স্বপ্ন সম্বল করে বেঁচে ছিলাম সুখে দুখে, নিজের মতো। ব্যস্ত শহরের ভিড়ে, রোদে ভিজে, আর সব মানুষের মতো আমার ওই সামান্য বেঁচে থাকাটুকু–কেন কেড়ে নিতে হবে কারও!
নিষিদ্ধ বস্তুকে গর্তে পুরে রেখেছে রাজার লোকেরা। ধর্ম-ধ্বংস-করা ডাইনিকে অবশেষে পাকড়াও করা গেছে ঢাড়া পিটিয়ে পুরো বিশ্বকে জানিয়ে দিচ্ছে খবর, ধর্মান্ধদের হ্যাঁ করা মুখে ঢেলে দিচ্ছে সুস্বাদু খাদ্য, সন্ত্রাসীদের জিভ থেকে ঝরানো হচ্ছে গনগনে লাভা।
কারও খেলার জিনিস তো নয়। আমার জীবন তো জীবন! জনতার আদালত বলে কোনও আদালত কোথাও কি নেই?
.
ড.
বাড়িটা তুই, আছিস কেমন? তোর বুঝি খুব একলা লাগে? আমারও তো, আমারও খুব। রাত্তিরে কি ভয় করে না? জানলাগুলো হঠাৎ করে ধড়াস করে খুলে গেলে? কেউ এসে কি দরজা নাড়ে? ধুলোয় ধূসর ঘরবারান্দায় কেউ ঢোকে কি, ভয় জাগে যে? চোর ডাকাতের বাড় বেড়েছে। নাকি হাওয়াই ঢোকে, ঝড়ো হাওয়া! হাওয়াই বা কোথায় এখন, সম্ভবত আমিই ঢুকি, মনে মনে আমিই বোধহয়। হেঁটে বেড়াই ঘরগুলোতে, অন্ধকারে চিনতে পারিস। পায়ের আওয়াজ বুঝিস কিছু? বাড়িটা তুই, লেখার ঘরটা দেখে রাখিস, সবকিছুই তো ওই ঘরে রে, জীবনটাই লেখার জীবন, ন-আলমারি বইপত্তর, লেখাপড়ার দুনিয়াটা, ওসব ছেড়ে ভালো থাকি! মনে মনে আমিই বোধহয় অশরীরী ঘুরি ফিরি ফেলে আসা ঘরদুয়ারে চোখের জল ফেলে আসি! বারান্দার গাছগুলোতে জল যে দেবে, কেউ তো নেই! চোখের জলে বাঁচবে না গাছ? চোখে আমার এক নদী জল, এক সমুদ্র চাস যদি বল, পাঠিয়ে দেব, বাড়িটা তুই, বেঁচে থাকিস। তোকে ছাড়া নির্বাসনে এক মুহূর্ত মন বসে না, বেড়ালটাও বাড়িতে নেই, খাঁ খাঁ করছে বাড়ির ভেতর, ধুলোয় তুই ডুবে আছিস, আঁচল দিয়ে মুছে দেব, চোখের জলে ধুয়ে দেব, অপেক্ষা কর, বাড়িট। তুই। তুই কি আর শুধুই বাড়ি। তুই তো আমার হারানো দেশ। তুই তো আমার মাতৃভাষা। তুই কি আর শুধুই বাড়ি! এক যুগেরও বেশি সময় বুকের ভেতর তোকে লালন করেছি তুই জানিস তো সব। দীর্ঘকালের স্বপ্ন তুই, স্বপ্ন বলেই তোকে ডাকি, বাড়িটা তুই, বেঁচে থাকিস, আমায় একটু বাঁচিয়ে রাখিস।