.
খ.
একটু মানুষ দেখতে দেবেন? রাস্তার মানুষ? মানুষ হাঁটছে, হাসছে, মানুষ ডানদিকে যেতে গিয়ে কী মনে হল বাঁদিকে হেঁটে গেল, মানুষ মাঠে, দোকানে, সিনেমায়, জলসায়, থিয়েটারে। মানুষ দৌড়োচ্ছে। মানুষ গাড়িতে, বাসে, ট্রামে, ট্রেনে, মানুষ চলছে, দেবেন?
একটু মানুষ দেখতে দেবেন? বাড়িঘরের মানুষ, ভালোবাসছে, স্বপ্ন-দেখছে মানুষ? ভাবছে। দেবেন দেখতে?
‘জানালার ফাঁক ফোকর দিয়ে যেটুকু ছিটেফোঁটা মেঘ বা রোদ্র দেখা যায়, তা দেখেই বাঁচতে হবে’, ‘মানুষ’, ওঁরা বলে দিয়েছেন ‘হবে না। আমার মানবজীবন এভাবেই পার করতে হবে মানুষবিহীন।
.
গ.
নিজের দেশই যদি তোমাকে দেশ না দেয়, তবে পৃথিবীতে কোন দেশ আছে তোমাকে দেশ দেবে, বলো! ঘুরে ফিরে দেশগুলো তো অনেকটা একইরকম, শাসকের চেহারা চরিত্র একইরকম। কষ্ট দিতে চাইলে একইরকম করে তোমাকে কষ্ট দেবে, একইরকম আহাদে সুঁই ফোঁটাবে, তোমার কান্নার সামনে পাথর-মুখে বসে মনে মনে নৃত্য করবে। নাম ধাম ভিন্ন হতে পারে, অন্ধকারেও ঠিকই চিনবে ওদের চিৎকার, ফিসফিস, হাঁটাচলার শব্দ শুনে বুঝবে কারা ওরা, যেদিকে হাওয়া, সেদিকে ওদের দৌড়ে যাওয়ার সময় হাওয়াই তোমাকে বলবে কারা ওরা। শাসকেরা শেষ অবধি শাসকই।
যতই তুমি নিজেকে বোঝাও কোনও শাসকের সম্পত্তি নয় দেশ, দেশ মানুষের, যারা ভালোবাসে দেশ, দেশ তাদের। যতই তুমি যাকে বোঝাও এ তোমার দেশ, তুমি একে নির্মাণ করেছো তোমার হৃদয়ে, তোমার শ্রম আর স্বপ্নের তুলিতে এঁকেছো এর মানচিত্র। শাসকেরা তোমাকে দূর দূর করে তাড়ালে কোথায় যাবে! কোন দেশ আর দরজা খুলে দাঁড়ায় তাড়া খাওয়া কাউকে আশ্রয় দিতে! কোন দেশ তোমাকে আর কোন মুখে দেশ দেবে বলো!
তুমি কেউ নও এখন আর, মানুষও বোধহয় নও। হারাবার তোমার বাকিই বা কী আছে! এখনই সময় জগৎকে টেনে বাইরে এনে বলে দাও, তোমাকে ওখানেই দাঁড়াবার জায়গা দিক, ওখানেই ঠাঁই দিক, দেশের সীমানা ফুরোলে ‘কারও মাটি নয়’ অথবা নো ম্যানস ল্যান্ড বলে যেটুকু মাটি থাকে, সেই অবাঞ্ছিত মাটিই, সেটুকুই না হয় আজ থেকে তোমার দেশ হোক।
.
ঘ.
ভারতবর্ষ শুধু ভারতবর্ষ নয়, আমার জন্মের আগে থেকেই ভারতবর্ষ আমার ইতিহাস। বিরোধ আর বিদ্বেষের ছুরিতে দ্বিখন্ডিত হওয়া, ভয়াবহ ভাঙন বুকে নিয়ে উধ্বশ্বাস ছোটা অনিশ্চিত সম্ভাবনার দিকে আমার ইতিহাস। রক্তাক্ত হওয়া ইতিহাস, মৃত্যু ইতিহাস। এই ভারতবর্ষ আমাকে ভাষা দিয়েছে, আমাকে সমৃদ্ধ করেছে সংস্কৃতিতে। শক্তিময়ী করেছে। স্বপ্নে। এই ভারতবর্ষ এখন ইচ্ছে করলেই কেড়ে নিতে পারে সব ইতিহাস, আমার জীবন থেকে আমার অস্তিত্ব, আমার স্বপ্ন থেকে আমার স্বদেশ।
নিঃশেষ করতে চাইছে বলে আমি আজ নিঃস্ব হব কেন! ভারতবর্ষ তো জন্ম দিয়েছে। মহাত্মাদের। আজ তাঁরা হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন আমার দিকে, এই অসহায়, এই অনাথ, এই অনাকাঙ্খিত আমার দিকে। দেশের চেয়েও দীর্ঘ এই হাত, দেশ কাল ছাপিয়ে এই গোটা কয় হাত আমাকে জাগতিক সব নিষ্ঠুরতা থেকে বড় মমতায় নিরাপত্তা দেয়। তাদেরই আমি দেশ বলে আজ ডাকি, তাঁদের হৃদয়ই আজ আমার সত্যিকার স্বদেশ।
.
ঙ.
আমার দেশটি তাকিয়ে তাকিয়ে আমার যন্ত্রণা দেখছে আজ এক যুগেরও বেশি। আমার দেশটি দেশে দেশে আমার বন্দিত্ব দেখছে, দূরত্ব বেড়ে গেলে দূরবীন লাগিয়ে দেখছে, বেজায় হাসছে,পনেরো কোটি মানুষ তারিয়ে তারিয়ে ভোগ করছে আমার সর্বনাশ।
আমার দেশ এমন ছিল না আগে, দেশের হৃদয় বলে কিছু ছিল, দেশে মানুষ বলে কিছু ছিল। দেশ এখন আর দেশ নেই। কতগুলো স্থবির নদী শুধু, কতগুলো গ্রাম আর শহর। এখানে ওখানে কিছু গাছপালা, কিছু ঘরবাড়ি, দোকানপাট। আর, ধূসর চরাচরে মানুষের মতো দেখতে কিছু মানুষ।
আমার দেশে এককালে প্রাণ ছিল খুব, এককালে কবিতা আওড়াতে খুব মানুষ, এখন কবিকে নির্বাসন দিতে কেউ দু’বার ভাবে না, এখন কবিকে মাঝরাত্তিরে নিশ্চিন্তে ফাঁসি দিয়ে ফেলে গোটা দেশ, পনেরো কোটি মানুষ তারিয়ে তারিয়ে ভোগ করে মর্মন্তুদ মৃত্যু।
দেশটি ভালোবাসতে জানতো আগে, দেশ এখন হিংসে শিখেছে, চোখ রাঙানো শিখেছে। দেশের হাতে এখন ধারালো সব তলোয়ার থাকে, দেশের কোমরে গোঁজা মারণাস্ত্র, মারাত্মক সব বোমা, দেশ এখন আর গান গাইতে জানে না।
দুনিয়া তছনছ করে দেশ-খুঁজছি এক যুগেরও বেশি, এক যুগেরও বেশি ঘুম নেই, উন্মাদের মতো দেশ দেশ করে দেশের কিনারে এসে দেশকে স্পর্শ করতে দু হাত বাড়িয়ে আছি। আর শুনি কিনা, হাতের কাছে দেশ যদি একবার পায় আমাকে, তবে নাকি আমার রক্ষে নেই।
.
চ.
আমার বাংলা আর বাংলা নেই, সোনার বাংলা এখন ক্ষয়ে যাওয়া, আমার রুপোলি বাংলার গায়ে মরচে, পূর্ব পশ্চিম আজ একাকার। ধর্মান্ধরা ছড়ি ঘোরায়, ভীতুরা মাথা নত করে হাঁটে, নিশ্চিতই কবন্ধের যুগ এই যুগ। সাহস আর সতোর নির্বাসন হয়ে গেছে, বাংলা এখন কুচক্রী শাসক আর তাঁবেদারে ঠাসা, বাকিরা নির্লিপ্ত, জীবনযাপনকারী, হয় জড়, নয় জঞ্জাল।
এই বাংলার জন্য যত জল আমার দুচোখে আছে দিলাম, কোনওদিন একদিন যেন উর্বর হয় মাটি, যেন জন্ম নেয় মানুষ, যেন দুর্ভাগা-বাংলা মানুষের বাসযোগ্য হয় কোনওদিন একদিন।
.
ছ.
মরে গেলে লাশখানা রেখে এসো ওখানে, মেডিক্যালের শব-ব্যবচ্ছেদ কক্ষে, মরণোত্তর দেহদান ওখানেই করেছি, রেখে এসো কলকাতা শহরে লাশ। জীবিত নেবে না আমাকে ও শহর। মরলে নেবে তো? প্রিয় কলকাতা!