.
এ.
কিন্তু কী করে দুশ্চিন্তামুক্ত হবে এই অজ্ঞাতবাসে, একটা স্বাধীনচেতা মানুষকে জন্মের মতো তুলে এনে আচমকা খাঁচায় বন্দি করলে কী করে দুশ্চিন্তামুক্ত হবে সে! খাঁচা থেকে আদৌ কোনওদিন মুক্তি পাবে কি না, মানুষের কোলাহলে মানুষের মতো কোনওদিন জীবনখানি যাপন করতে পারবে কি না, জানতে না পারলে দুশ্চিন্তামুক্ত কী করে হবে সে! আলোর মানুষেরা কতদিন পারে অন্ধকারে অন্ধের মতো সাঁতরাতে। আমার শরীরে তীরের মতো বিঁধে রয়েছে দুশ্চিন্তা, যতক্ষণ ওই খাঁচা থেকে মুক্তি নেই, ততক্ষণ তীর থেকেও নেই।
.
ঐ.
কাল রাতে দেখি একটি টিকটিকি কোত্থেকে লাফিয়ে গায়ে পড়ে বাহু বেয়ে আমার ঘাড়ের দিকে চলে গেল, ঘাড় পার হয়ে মাথার দিকে, চুলের জঙ্গলে শরীর আড়াল করে দ্বিতীয় টিকটিকির দিকে ঘণ্টা দুয়েক অপলক তাকিয়ে থেকে ভোররাত্তিরের দিকে কানের পাশ দিয়ে নেমে শিরদাঁড়ায় গিয়ে বসে রইল। দ্বিতীয়টি স্থির শুয়ে ছিল আমার ডান পায়ের ঘঁটু থেকে ইঞ্চি দুয়েক নিচে। সারারাত একচুলও নড়েনি। ওদের সরাতে চেয়ে ব্যর্থ হয়ে অগত্যা আমি যা করছিলাম, তাই করি, চোখ বুজে পড়ে থাকি। মনে মনে একশ থেকে এক অবধি বারবার করে গুনি। কোনও কারণ নেই গোনার, তারপরও গুনি।
যে বিছানায় আমি ঘুমোচ্ছি, দীর্ঘদিন হল সেটি আধোয়া কাপড়, এঁটো বাসন, হিজিবিজির খাতা, চায়ের দাগে বাদামি হয়ে থাকা পুরোনো পত্রিকা, চুল আটকে থাকা চিরুনি, মিইয়ে যাওয়া মুড়ি, খোলা ওষুধপত্র, কালি ফুরিয়ে যাওয়া কলম ইত্যাদির স্থূপ। দুশর মতো বড় বড় কালো পিঁপড়ে সারা বিছানা জুড়ে কদিন হল নোঙর ফেলেছে। আটঘাট বেঁধে লেগে গেছে নতুন বসত তৈরি করতে।
আমাকে দখল করে নিচ্ছে ওরা। ওরা খুব ক্ষুদ্র প্রাণী। কুঁকড়ে থেকে থেকে দিন দিন ওদের মতোই ক্ষুদ্র হয়ে যাচ্ছি আমি। এ অবধি একটি পিঁপড়েও, আশ্চর্য, আমার শরীর জুড়ে উৎসব করছে ধ্রুপদী নৃত্যের, ভুলেও কামড় দেয়নি। আমাকে, আমার বিশ্বাস, ওদেরই একজন মনে করে ওরা!!
সম্ভবত মানুষের জগতের চেয়েও এই পোকামাকড়ের জগতেই বেশি নিরাপদ আমি।
.
ও.
দিনের পর দিন যাচ্ছে, স্নান করি না। মাস পেরোচ্ছে, গা থেকে দুর্গন্ধ বেরোচ্ছে, স্নানের তবু কোনও ইচ্ছে জাগে না, কেনই বা স্নান করবো, কী লাভ স্নান করে। এক অদ্ভুত অনীহা আমাকে অধিকার করে রাখে।
তিনবেলা লোক আসে খাবার নিয়ে পছন্দ হোক বা না হোক, খেতে হয়। না খেয়ে যদি বাঁচা যেত–বলে দিতাম কাল থেকে যাই দিক, অন্তত খাবারটা যেন না দেয়।
ঘুমোতে যাবার আগে ভয় হয়, যদি কিছু হয়! যদি আর না জাগি! ঘুমোলে চমকে চমকে বার বার উঠে যাই, আশেপাশে তাকাই, আমার ঘর কি এ ঘর? না, এ আমার ঘর নয়।
নির্বাসন নেহাতই একটা দুঃস্বপ্ন, এ সত্যি নয়–এই স্বপ্নটি সারাদিন দেখি, ঘুমোলে স্বপ্ন যদি উবে যায়, ঘুমোতে ভয় হয়।
চার দেওয়াল ঘেরা ওই চতুষ্কোণ ঘরটির মধ্যেই হাঁটাচলা করো যদি নিতান্তই করতে হয়–
এরকমই আদেশ এসেছে। ঘর ঘরের মতো পড়ে থাকে, আমি এক কোণে আদেশে অবশ হয়ে, স্তব্ধ বসে ভাবি, বিশাল বিস্তৃত এই পৃথিবী, কবে থেকে এত কৃপণ হল!
জেলেও শুনেছি কিছু নিয়ম থাকে, দেখা সাক্ষাৎএর সময় ইত্যাদি নাকি থাকেই, আমারই কিছু নেই। স্বজন বন্ধু বলতে কিছু থাকতে নেই এক আমারই, জেলের সুবিধে চেয়ে আবেদন করি প্রতিদিন, নিরুত্তর সবাই।
.
ঔ.
এভাবেই, যেভাবে রেখেছে আমাকে, সেভাবেই থাকতে হবে, যদি থাকি, যদি নিতান্তই থাকতে চাই এদেশে। এভাবেই কারাগারে, বন্ধ ঘরে, একা। কতদিন, কত মাস বা বছর? তার কোনও ঠিক নেই। কোনওদিন কি জীবন ফিরে পাবো? ঠিক নেই।
কী কারণ এই বন্ধ ঘরের? বেরোলেই দেশের দশটা লোকের মৃত্যু হতে পারে।
চমকে উঠি। –আমার কারণে? চোখ নিচু করে লোক বলে, –হ্যাঁ। বলি, –একবার মুক্তি দিয়েই দেখুন, দেখুন কতটা যুক্তিহীন এই অভিযোগ। ওদিকে মানুষ তো ভেবে বসে আছে, আমার জন্য বুঝি সব আয়োজন, নিচ্ছিদ্র নিরাপত্তা আমার জন্য, আমি যেন না মরি! কাউকে না কাউকে নিরাপত্তা দিতে, হয়তো এ পৃথিবীরই নিয়ম, কাউকে না কাউকে হারিয়ে যেতে হয় অদ্ভুত আঁধারে। আমার বন্দিত্ব দশটা লোককে নিরাপত্তা দিচ্ছে, আমার বন্দিত্ব দশটা লোককে অভাবনীয় নিশ্চিন্তি দিচ্ছে,
খুব জানতে ইচ্ছে করে, কারা সেই দশজন? তারা কি রাস্তার লোক নাকি রঙিন দালানবাড়ির লোক! তারা কি আদপেই লোক, নাকি লোকেদের লোকাতীত লোকনীতি? কাঁদের বাঁচাতে আজ আমাকে প্রতিদিন দেখতে হচ্ছে মৃত্যুর বীভৎস মুখ!
.
ক.
এমন একটা নিরাপদ বাড়িতে আমাকে বাস করতে হচ্ছে যেখানে ভালো না লাগলে বলতে পারার আমার কোনও অধিকার নেই যে ভালো লাগছে না। এমন একটা নিরাপদ বাড়ি যেখানে কষ্ট পেতে থাকবো আমি, কিন্তু কাঁদতে পারবো না। চোখ নামিয়ে রাখতে হবে আমাকে, কেউ যেন দেখতে না পারে কোনও অমীমাংসিত যন্ত্রণা।
এমন একটা বাড়ি যেখানে ইচ্ছেগুলোকে প্রতিদিন ভোরবেলা খুন হয়ে যেতে হয়, আর সন্ধের আগে আগেই বাড়ির উঠোনে পুঁতে দিতে হয় ইচ্ছের মলিন মৃতদেহ।
দীর্ঘ দীর্ঘশ্বাস ফেলে নৈঃশব্দ্য ভাঙি নিরাপদ বাড়ির, দীর্ঘশ্বাসের শব্দ ছাড়া আর কোনও শব্দ নেই বাড়ির বাইরে বা ভেতরে। প্রতিদিন ভয়ে ভয়ে ঘুমোতে যাই, ভয়ে ভয়ে জাগি, নিজের ছায়ার সঙ্গে যতক্ষণ জেগে থাকি মনে মনে কথা বলি। জানি না কোত্থেকে বিষদাত সাপ এসে থিকথিকে ক্রোধ আর ঘৃণা ছড়াতে ছতে সারাদিন আমার শরীর বেয়ে হাঁটাহাঁটি করে, হিসহিস করে বলতে থাকে, চলে যাও, সীমান্ত পার হয়ে দূরে কোথাও, কাক পক্ষী না দেখে কোনও দুর্গম পর্বতের দিকে কোথাও চলে যাও। ছায়াটির শরীর বেয়েও সাপ বলতে বলতে যায়, যাও, জন্মের মতো যাও। বন্ধুরা, প্রার্থনা করো, নিরাপদ বাড়ি থেকে কোনও একদিন যেন নিরাপদে বেরোতে পারি বেঁচে। প্রার্থনা করো, যেন কোনও একদিন একটি অনিরাপদ বাড়িতে বাস করার সৌভাগ্য আমার হয়।