তুমি সত্য বলো না তসলিমা, বাঁচো।
.
আ.
আমার শহর যাকে বলেছিলাম, সে শহর আমার নয়, সে শহর ধুরন্ধর রাজনীতিক, অসৎ ব্যবসায়ী, আর নারী-পাচারকারীর শহর। বেশ্যার দালালের শহর, লম্পটের শহর। ধর্ষকের শহর সে শহর। আমার শহর নয়, সে শহর কেউ খুন বা ধর্ষিতা হলে, অত্যাচারিত হলে কিছু যায়-আসে-না-দের শহর। আমার শহর নয়, সে শহর মুখে-এক-মনে-আরেকদের শহর। বস্তির না-খাওয়াদের পাশ দিয়ে নির্বিকার হেঁটে যাওয়াদের শহর, ফুটপাথে মরে থাকা-ভিখিরিকে আলগোছে ডিঙিয়ে যাওয়াদের শহর। বিপদের আঁচ পেলে তড়িঘড়ি গা-বাঁচানোদের শহর। অন্যায়ের স্তূপে বসে মুখ-বুজে-থাকাঁদের শহর। আমার নয়। ইহ আর-পরলোক নিয়ে-বঁদ-হয়ে-থাকাঁদের শহর, জ্যোতিষীর শহর, আখের-গুছোতে-ব্যস্ত থাকাঁদের শহর, সুযোগসন্ধানীর শহর।
সে শহর আমার শহর নয়। কিছুতেই। সে মিথুকের শহর। কূপমন্ডুকের শহর। ঠগ, জোচ্চোরের শহর, আমার নয়। সে শহর সুবিধেবাদীর, স্বার্থান্ধর, পাঁড় ধর্মান্ধদের শহর। তাদের শহরে আমরা গুটিকয় মুক্তচিন্তার মানুষ, কিছু যুক্তিবাদী, প্রতিবাদী, কিছু সৎ, সজ্জন বড় ভয়ে ভয়ে বাস করি।
.
ই.
রাত তিনটেয় ঘুম ভেঙে গেলে এখন আর বিরক্ত হই না। রাতে ভালো ঘুম না হলে দিনটা ভালো কাটে না–এরকম বলে লোকে। দিন যদি ভালো না কাটে, তাতে কি কিছু যায় আসে! আমার দিনই বা কেন, রাতই বা কেন। দিন দিনের মতো বসে থাকে দূরে, রাতও রাতের মতো, ঘুমিয়ে থাকার গায়ে মুখ গুঁজে গুটিশুটি শুয়ে থাকে জেগে থাকা। এসব দিন রাত, এসব সময়, এসব দিয়ে আমার করার কিছু নেই, জীবন আর মৃত্যু একাকার হয়ে গেলে কিছু আর করার থাকে না কিছু দিয়ে। আমি এখন মৃত্যু থেকে জীবনকে বলে কয়েও সরাতে পারি না, জীবন থেকে মৃত্যুকে আলগোছে তুলে নিয়ে রাখতেও পারি না কোথাও আপাতত।
.
ঈ.
বন্দুক হাতে সেনারা ঘুরছে চারদিকে, মাঝখানে নিরস্ত্র আমি। সেনারা কেউ আমাকে চেনে না , নিরস্ত্র নারীর দিকে মাঝে মাঝে অদ্ভুত চোখে তাকায়। কেউ জানে না এখানে হঠাৎ কী কারণে আমি! ময়লা শরীর, মলিন কাপড়চোপড়, মনমরা উড়ুক্কু চুল, গায়েপায়ে শেকল নেই আমার, কিন্তু কোথাও না কোথাও আছে, টের পায় ওরা, চাইলেও দু’পা এগোতে পারবো না টের পায়। ওদের চোখের তারায় বীভৎস এক টের পাওয়া দেখি। বন্দুকগুলো, জানে ওরা, ভয় দেখাতে, বেয়নেটগুলো, বুটজুতোগুলো ভয় দেখাতে। ভয় না পেলে ওরা আঘাত পাবে খুব, কাউকে আঘাত দেওয়ার অধিকার আমার আইনত নেই। ওরা যদি ওপরতলায় খবর পাঠিয়ে বলে, এর তো দেখি ডর ভয় নেই। শেকল ভাঙতে চাইছে প্রাণপণে। ওপরতলা আমাকে নির্ঘাত ফাঁসি দেবে। ফঁসির দিনক্ষণ ঠিক হলে, খেতে দেবে মাছের ঝোল, ইলিশ চিংড়ি ইত্যাদি।
যদি বলি, খাবো না! ফাঁসির মঞ্চে উঠে যদি একটাও দীর্ঘশ্বাস না ফেলি? গলায় দড়ি পরাবার পরও যদি ভয় না পাওয়ার দুঃসাহস আমার হয়?
.
উ.
কয়েকবছর ধরে আমি মৃত্যুর খুব কাছে, প্রায় মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আছি। আমার মার সামনে, আমার বাবা, প্রিয় কিছু মানুষের সামনে বাকরুদ্ধ দাঁড়িয়ে আছি কয়েক বছর। কয়েক বছর ধরে আমি জানি না ঠিক বেঁচে আছি কি না, কয়েক বছর ধরে বেঁচে থাকা এবং না থাকার ব্যবধান কমে কমে শূন্যে এসে সুতোর মতো নড়ছে। কয়েক বছর ধরে আমার ভেতরে বাইরে যে মানুষটা বাস করে, সে বীভৎস বোবা একটা মানুষ, যার বৃক্ষ থেকে শেষ শুকনো পাতাটাও ঝরে গেছে, জীবন থেকে জন্মের মতো বিদেয় নিয়েছে বসন্ত। আমার যদি মৃত্যু হয় আজ রাতে, কেউ কিছু বোলো না, শুধু কোথাও কোনও শিউলি গাছের নিচে একটা এপিটাফ পুঁতে দিও, কয়েক বছর ধরে লেখা আমার এপিটাফ, সাদা কাগজের গায়ে সাদা। রঙে, সযত্নে লেখা এপিটাফ।
.
ঊ.
কোনও কবিকে কি কখনও গৃহবন্দি করা হয়েছিলো কখনও? কবি নিয়ে রাজনীতি অনেক হয়েছে হয়তো, কবি নিয়ে ইট পাটকেলও হয়েছে, আগুন হয়েছে, কবিকে কেউ গৃহবন্দি করেনি, কোনও দেশ। এই ভারতবর্ষ, এই সভ্যতা, এই একবিংশ শতাব্দী, কবিকে গ্রহণ করেছিলো, মুহূর্তেবর্জনও করেছে এর বালখিল্য ধর্ম, এর নিষ্ঠুর রাজনীতি। কোনও অপরাধ করেনি কবি, কবি আজ গৃহবন্দি। কবি এখন আকাশ না দেখে দেখে জানে না আকাশ কেমন দেখতে, মানুষ না দেখে দেখে জানে না মানুষ কেমন, কবির সামনে এক জগৎ অন্ধকার ফেলে চলে গেছে তারা, তারা আর এ পথ মাড়াবে না বলে গেছে। আজ একশ পঞ্চান্ন দিন কবি গৃহবন্দি, একশ পঞ্চান্ন দিন কবি জানেনা হৃদয় আছে এমন কেউ পৃথিবীতে আর বাস করে কি না, একশ পঞ্চান্ন দিন কবি জানে না, কবি বেঁচে আছে কি নেই। কার কাছে সে তার দিনগুলো ফেরত চাইবে, অন্ধকার সামনে নিয়ে বসে কবি ভাবে, কে তার জীবনে দেবে রোদ্দুর ফিরিয়ে, কে তাকে নিভৃতে জীবনের মন্ত্র দেবে কোনও একদিন। অন্তত সান্ত্বনা দিতে কবিকে তো বলুক মানুষ, এর আগে গৃহবন্দি ছিল যারা, অধিকাংশই কবি ছিল–নিঃসঙ্গতা থেকে মনে মনেও কিছুটা মুক্তি পাক সে।
.
ঋ.
চেয়েছিলাম মানুষের অন্ধত্ব দূর করতে, চেয়েছিলাম মানুষের মোহর করা হৃদয় থেকে বৈষম্যের, হিংসের, অন্ধকারের আর অসুস্থতার শেকড় উপড়ে ফেলে ভালোবাসা রোপণ করতে। আমার চাওয়ার শাস্তি আমাকে দিয়েছে প্রিয় ভারতবর্ষ।