প্রথম দিনই মুখ্যমন্ত্রী বসুন্ধরা রাজে বলেছিলেন, ”যতদিন দরকার হয়, থাকুন রাজস্থান হাউজে’, অফিসাররাও বলেছিলেন। এই তাঁরাই তিন দিন পর বললেন, আজই আপনাকে বেরিয়ে যেতে হবে রাজস্থান হাউজ থেকে। হ্যাঁ আজই। মুখ্যমন্ত্রী আমাদের জানিয়ে দিয়েছেন, আজই। ভ’বাবুর লোকদের আমি ফোনে জানিয়ে দিলাম, আমাকে বেরিয়ে যেতে বলছে, আজই’। আমি হয়তো দুনিয়ার অনেক কিছু বুঝি, শুধু রাজনীতির মাথামুণ্ডু কিচ্ছু বুঝি না। যে অফিসাররা এত আন্তরিক ছিলেন, এত শ্রদ্ধাভরে কথা বলতেন, তাঁরাই কী ভীষণ ক্রুদ্ধ এখন, তাঁদের ভাষাই কী ভীষণ কঠিন এখন, তাঁদের আচরণে স্পষ্ট অশ্রদ্ধা এখন। আমি এটুকু বুঝেছিলাম, তারা আমার ওপর সন্তুষ্ট নন, যেহেতু আমি দিল্লির অফিসারদের উপদেশ রেখেছিলাম, কোনও সাংবাদিককে সাক্ষাৎকার দিইনি। জয়পুরীদের যুক্তি ছিল, তোমার এখন খারাপ সময়, মিডিয়া তোমার পক্ষে, তুমি মিডিয়াকে অ্যাভোয়েড করছো, মিডিয়াকে ক্ষেপিয়ে তুলছো, তুমি বুঝতে পারছে না মিডিয়াতে যতক্ষণ তুমি আছো, মিডিয়া যতক্ষণ তোমার পাশে আছে, ততক্ষণ কোনও সরকার, কোনও পলিটিক্যাল পার্টি তোমাকে কিছু করতে পারবে না। তুমি মিডিয়াতে নেই, যে কোনও খেলাই তোমাকে নিয়ে খেলতে পারবে যে কেউ। সিপিএম তোমাকে পশ্চিমবঙ্গ থেকে কীভাবে বের করেছে, জানাও সবাইকে। কেউ কিছু যদি না জানে, তা হলে মানুষের সাপোর্ট তুমি কী করে পাবে? এ দেশের মানুষ তোমাকে ভালোবাসে। তুমি এদের কাছ থেকে দূরে সরে থাকবে কেন? মিডিয়াকে ব্যবহার করো মানুষের কাছে পৌঁছোননার জন্য। সারাদিন জয়পুর বলেই চলেছেন, ‘তুমি ভুল করছো, বেছে বেছে হাতে গোনা দুতিনটে মিডিয়ার সঙ্গে তোমার কথা বলা উচিত। এত বলার পরও আমি রাজি হইনি। শীলা রেড্ডির সঙ্গে দেখা করতে রাজি হয়েছিলাম, সাক্ষাৎকার দিতে নয়, সৌজন্য সাক্ষাৎ করতে। আউটলুকের সাংবাদিক শীলা। আমাকে দিয়ে কয়েকটি লেখা লিখিয়েছিলেন আউটলুকের জন্য। শীলা রেডিও বলেছিলেন, যতক্ষণ মিডিয়া আছে সঙ্গে, ততক্ষণ সরকার আমার বিরুদ্ধে কিছুই করতে পারবে না।
কিন্তু সাক্ষাৎকার দিতে রাজি হইনি বলে একটি রাজ্যের একটি সরকারি বাড়ি থেকে অতিথি হিসেবে বরণ করে নিয়েও আমাকে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যেতে বলা হবে, এ আমার বিশ্বাস হয় না। হয়তো অন্য কোনও কারণ আছে। সে কারণ আমার কাছে চিরকাল অজানাই থেকে যাবে।
রাত বিরেতে পেছনের দরজা দিয়ে বের করা হল আমাকে। বের করার আগে দিল্লির অফিসাররা এক অফিসারকে তসলিমা সাজিয়ে বোরখা পরিয়ে রাজস্থান হাউজ থেকে বের করলো, গাড়িতে ওঠালো। সেই গাড়ির পেছনে যখন সাংবাদিকদের দল ছুটলো, সন্তর্পণে সত্যিকার আমাকে পেছনের দরজা দিয়ে বের করে নিয়ে সোজা ক্যান্টনমেন্ট। ওখানে দুদিন রেখে আমাকে আরেক ক্যান্টনমেন্টে নিয়ে যাওয়া হল। ঠিকানা জানি না। আমার অজ্ঞাতবাস শুরু হল এখানেই। অনেক কিছুই দেওয়া হল আমাকে। মোবাইল। ইন্টারনেট। কাপড় চোপড়। সাবান শ্যাম্পু। যা খেতে চাই, সব। বিছানা, টেবিল চেয়ার, সোফা, টিভি আর আমাকে সঙ্গ দিতে, বা পাহারা দিতে, বা চোখে চোখে রাখতে দু’জন করে সরকারি অফিসার। সব আছে, একটি জিনিসই নেই অজ্ঞাতবাসে, কোথাও যাবার, ঘর থেকে বেরোবার বা কারও সঙ্গে দেখা করার অধিকার বা স্বাধীনতা।
অফিসাররা মাঝে মাঝেই বলেন, স্বাধীনতাহীন বেঁচে থাকাটা ভয়ংকর।
আমি চুপ হয়ে শুনি। ওঁরা আমার মুখে অপলক তাকিয়ে লক্ষ্য করতে থাকেন, ত্বকের কোন অঞ্চলে ভাঁজ পড়ছে, ক’টা শিরা দপদপ করছে, ক’টা স্নায়ু নড়ছে, পেশিগুলোর কী হাল।
দাদা অস্থির হয়ে পড়ে দেশে ফেরার জন্য। কিছুতেই তাকে আর রাখার উপায় নেই। বোনকে এই অবস্থায় ফেলে কেন যেতে চাইছো, তোমাদের কী কোনও মায়া নেই, কখন কী হয় কে জানে, যদি মরে যাই, এসব কথা বা আমার চোখের জল কিছুই দাদাকে রুখতে পারে না। দাদাও কি মনে মনে ফেয়ারওয়েল জানায় আমাকে! পরম আনন্দে কলকাতা হয়ে ঢাকায় ফিরে যায় দাদা। মুক্তি পায়। আমি একা। আমার সংগ্রাম চিরকালই আমার একার।
০৮. নিরাপদ বাড়ির কবিতা
অ.
সত্য বললে কিছু লোক আছে খুব রাগ করে, এখন থেকে আর সত্য বোলো না তসলিমা। গ্যালিলিওর যুগ নয় এই যুগ, কিন্তু এই একবিংশ শতাব্দীতেও সত্য বললে একঘরে করে সমাজ, দেশছাড়া করে দেশ। গৃহবন্দি করে রাষ্ট্র, রাষ্ট্র শাস্তি দেয়, সত্য বোলো না।
তার চেয়ে মিথ্যে বলো, বলো যে পৃথিবীর চারদিকে সূর্য ঘোরে, বলো যে সূর্যের যেমন নিজের আলোআছে, চাঁদেরও আছে,বলল যে পাহাড়গুলো পৃথিবীর গায়ে পেরেকের মতো পুঁতে দেওয়া, বলল যে পুরুষের পাঁজরের হাড় থেকে নারীকে বানানো, বলো যে নারীর ঘাড়ের কী যেন একটা হাড় খুব বাঁকা। বলল যে শেষ-বিচারের দিনে মানুষেরা সব কবর থেকে, ছাই থেকে, নষ্ট হাড়গোড় থেকে টাটকা যুবক যুবতী হয়ে আচমকা জেগে উঠবে, স্বর্গ বা নরকে অনন্তকালের জন্য জীবন কাটাতে যাবে। তুমি মিথ্যে বলো তসলিমা। বলো যে বিশ্ব ব্রহ্মারে অগুনতি গ্রহ, উপগ্রহ, নক্ষত্ররাজি মিথ্যে, মাধ্যাকর্ষণ শক্তি মিথ্যে, মানুষ চাঁদে গিয়েছিলো, মিথ্যে।
মিথ্যে বললে তুমি নির্বাসন থেকে মুক্তি পাবে, তুমি দেশ পাবে, প্রচুর বন্ধু পাবে, হাত পায়ের শেকল খুলে দেওয়া হবে, তুমি আলো দেখবে, আকাশ দেখবে। একা একা অন্ধকারে হমুখো মৃত্যুর মুখে ছুঁড়ে দেবে না তোমাকে কেউ।