ত–কাপড় কেন?
ভ–কাপড় তো লাগবে। কিছু কি এনেছেন সঙ্গে?
ত–না। শুধু ল্যাপটপ।
ভ–কাপড়চোপড়, আর যা যা দরকার, সেসব দেওয়া হবে আপনাকে। অফিসাররা আপনার গছে পৌঁছে যাবে। ওরাই আপনার দেখাশোনা করবে।
ত–আমি তো কলকাতায় ফিরবো। আমার কাপড়ের দরকার নেই। কালই তো ফিরে যেতে পারি। যেটা পরে আছি, সেটা পরে রাতটা কাটিয়ে দিতে পারবো, কোনও অসুবিধে হবে না। এক রাতের জন্য কাপড় চোপড়ের দরকার নেই।
ভ–না। এখন কলকাতায় ফেরা যাবে না। আপনাকে অন্য একটা বাড়িতে কাল সিফট করা হবে। সেই বাড়ির ব্যবস্থা করছি আমরা।
ত–বাড়ি?
ভ–হাঁ, সেই হাউজ।
ত–কিন্তু..
ভ–আপনি থাকুন। খাওয়া দাওয়া ওখানে ভালোই দেবে আশা করি। কোনও প্রবলেম হবে না। কিছুর দরকার হলে আমাকে ফোন করবেন।
খাওয়ার আয়োজন ভালো। একসঙ্গে আমার জন্য বরাদ্দ সুইটের বৈঠকঘরে বসেই সবাই খেলেন।
পরদিন সকালে কেন্দ্রর অফিসার এলেন ক’জন। বেশি বয়সী, অল্প বয়সী। ওঁরা বসেই রইলেন। লক্ষ্য করি জয়পুরের অফিসাররা কেন্দ্রর অফিসারদের ঠিক পছন্দ করছেন না, একটু পর পর কিছু না কিছু নিয়ে তর্ক শুরু করছেন। দাদা টেলিভিশন নিয়ে ব্যস্ত। টেলিভিশনে, বিশেষ করে কলকাতার চ্যানেলগুলোয় আমার খবর দেখিয়ে যাচ্ছে। আমি
কোথায়, কিভাবে, কেন ইত্যাদি। আমার সঙ্গে কারও যোগাযোগ করার উপায় নেই। ভ’বাবুর পাঠানো অফিসাররা বলে দিয়েছেন, কোনও সাংবাদিকের সঙ্গে যেন কথা না বলি। বললেন, খুব বিপদ হবে সাংবাদিকের সঙ্গে কথা বললে। এদিকে জয়পুরের অফিসাররা আলাদা করে আমাকে বলছেন, যেন কথা বলি, খুব বাছাই করে হলেও। বাইরে প্রচুর সাংবাদিক ভিড় করে আছে। চব্বিশ ঘণ্টা ওরা বাইরেই দাঁড়িয়ে আছে। অন্তত কয়েকজনের সঙ্গে যেন কথা বলি। আমি ঠিক বুঝে পাই না কী করবো। দু’দিক থেকে দু’রকম চাপ। মাঝখানে আমি বিমূঢ়। তবে কেন্দ্রর অফিসাররা যা বলছেন তাই আমি মেনে নিই। ভ’বাবু ওঁদের পাঠিয়েছেন। ভ’বাবু আমার শুভাকাঙ্ক্ষী, নিশ্চয়ই যা বলছেন আমার ভালোর জন্যই বলছেন।
জয়পুরের অফিসাররা বললেন কাল আমাকে এখান থেকে সরিয়ে ফেলা হলে ওঁরা জয়পুরে ফিরে যাবেন। কিন্তু কাল আসে। দিল্লির অফিসাররা আসেন। গলার স্বর যথাসম্ভব নরম করে জানান, আরও একদিন সময় লাগবে নিরাপদ বাড়ি খুঁজতে। অতএব আমি রয়ে যাই। সাংবাদিকরাও দিন রাত রয়ে যায়। বাড়ি ঘিরে থাকা পুলিশও রয়ে যায়। দাদা টিভিতে ব্যস্ত। আমাকে দেখায় খানিক পর পর, আমি কোথায়, কী করে আমাকে তাড়ানো হয়েছে কলকাতা থেকে, এসব নিয়ে আলোচনা চলে। স্টার আনন্দ থেকে বাংলাদেশে পাঠানো হয়েছে লোক, ময়মনসিংহে আমার আত্মীয় স্বজনের সাক্ষাৎকার নেওয়া হচ্ছে। নিজের বউ বাচ্চার কথা শুনতে শুনতে খুশিতে দাদার চোখে জল।
কোনো সাংবাদিকের সঙ্গে যেন কথা না বলি, উপদেশ দিতেই থাকেন দিল্লির অফিসাররা। সাংবাদিকদের সঙ্গে যেন কথা বলি, উপদেশ দিতেই থাকেন জয়পুরের অফিসাররা। এর মধ্যে দিল্লির অফিসারদের অনুপস্থিতি এবং আমার অন্যমনস্কতার সুযোগে এক ফটোগ্রাফার আমার পটাপট বেশ কিছু ছবি তুলে ফেলে ঘরে ঢুকে। কে এই লোক প্রশ্ন করতেই জয়পুর বললেন, এই হাউজের নিজস্ব ফটোগ্রাফার। এক ফটোগ্রাফারকে রাজস্থান হাউজের নিজস্ব ফটোগ্রাফার বলে আমার ঘরে ঢুকিয়ে দিলেন জয়পুর। পরে ওই ছবি বিভিন্ন পত্রিকায় ছাপা হতে দেখেছি। গভীর রাতে হঠাৎ আমাকে বলা নেই কওয়া নেই, বরখা দত্তকে ঢোকালেন জয়পুর। যেখানে সাংবাদিকদের শত অনুরোধ সত্ত্বেও কারও সঙ্গে দেখা করছি না, সবাইকে এক বাক্যে ফিরিয়ে দিচ্ছি, চেনা অচেনা কারও ফোন ধরছি না, কারও আবেদনে অনুরোধে রাজি হচ্ছি না, তখন ঘরের ভেতর ক্যামেরা আর একজন সাংবাদিক। এভাবে একজনকে খাতির করবো কেন! জয়পুরের অফিসাররা আকাশ থেকে পড়েন, তুমি বরখাকে চেনোনা, ও ভারতের সবচেয়ে নামকরা সাংবাদিক। না, আমি বরখাকে চিনি না, আমি তো করন থাপরকেও চিনতাম না। সাক্ষাৎকার চাইলে মুখের ওপর না বলে দিয়েছিলাম। করন থাপরকেই কলকাতা যেতে হয়েছিল। সাক্ষাৎকার নেওয়ার সময়ও বুঝিনি তিনি নামকরা কোনোও লোক। আরও পরে লোকের মুখে করন থাপরের কথা শুনে বা সিএনএন-এ ডেভিলস এডভোকেট দেখে, হিন্দুস্থান টাইমসে কলাম পড়ে বুঝেছি উনি নামী লোক। বরখা সাক্ষাৎকার চাইছেন, নানাভাবে আমাকে রাজি করানোর চেষ্টা করছেন। আমার কথা বলা উচিত। আমি কথা বললে কী ঘটেছে তা লোকে জানতে পারবে, আমি জনতার সমর্থন পাবো। জয়পুর জোর করছেন। অপ্রস্তুত অবস্থা আমার। ভ’বাবুর কথা অমান্য করা আমার উচিত নয়। অনেক জোরাজুরির পর কথা বলতে রাজি হলাম, তবে সাক্ষাৎকার নয়। শুধু একটা বিবৃতি, ‘আমি কলকাতায় ফিরতে চাই’, এর বেশি একটিও কথা নয়।
বিজেপির এক নেতা এসেছিলেন। তেমন কোনও কোনও কথা হয়নি। উনি কিছুক্ষণ বসে থেকে চলে গেছেন। তবে মহাত্মা গান্ধির নাতনি তারা গান্ধি এসেছিলেন দেখা করতে, উপহার দিয়ে গেলেন নিজের হাতে বোনা একটি ব্যাগ, তাঁর সঙ্গেই গল্প করেছি। তারা গান্ধির সঙ্গে ওই আমার প্রথম আলাপ। বললেন, তিনি যোগাযোগ রাখবেন। তাঁর ভাই গোপালকৃষ্ণ গান্ধি তখন পশ্চিমবঙ্গের গভর্নর। রাজভবনে একবার কবিতা পড়েছিলাম, মন দিয়ে বাংলা কবিতা শুনেছিলেন, প্রশংসা করেছিলেন খুব। একবার কথাও হয়েছিলো ফোনে, যখন কলকাতায় আমাকে বাড়ি থেকে বেরোতে দিচ্ছিল না পশ্চিমবঙ্গ সরকার। আমি কী রকম ভাবে বেঁচে আছি শুনে উনি ক্ষুব্ধ হয়ে বলেছিলেন, আমি যেন কেন্দ্রকে কোনওরকম দেরি না করে খবরটা জানাই। কেন্দ্র বলতে আমি যা বুঝি, তিনি ভ। এক ভ’র সঙ্গেই কালে ভদ্রে আমার কথা হয়, যেটুকুই হয়। এক ভ’কেই আমি বলতে পারি কী ঘটছে। ভ’কে সম্ভবত বলেছিলাম। উনি ব্যাপারটা দেখবেন’ বলেছিলেন।