হঠাৎ পথে একজায়গায় গাড়ি থামিয়ে পুলিশেরা আবার হাওয়া হয়ে গেল, পুলিশের সবগুলো গাড়ি থেকেই পুলিশ হাওয়া। অনেকক্ষণ বাদে ফিরে এলো সাদা পোশাকে। গা থেকে হঠাৎ ওরা পুলিশের ইউনিফর্ম খুলে ফেললো কেন! দাদা ফ্যাসফ্যাসে গলায় বললো, গাড়ির নম্বর প্লেটও খুলে ফেলেছে। লক্ষ্য করি, আমি যে গাড়িতে বসে আছি, সে গাড়ির তো বটেই, আমার গাড়ির সামনের এবং পেছনের গাড়িগুলোর নম্বর প্লেট নেই। দু’জন সাদা পোশাকের তাগড়া পুলিশ সব পুলিশকে বলছে রাইফেলগুলো সব লুকিয়ে ফেলতে। তার মানে কেউ যেন বুঝতে না পারে, আর্মস নিয়ে একদল লোক কোথাও যাচ্ছে! দাদা আর আমার দিকে চোখ রাঙিয়ে তাগড়া দুজন বললো, ‘মোবাইল ফোন অফ করো। মোবাইল ফোন অফ করবো, হচ্ছেটা কী? কেন করবো অফ?’ বলতে নিচ্ছি, অমনি বিরাট ধমক, ‘অফ করোনি এখনও, এক্ষুণি অফ করো।‘ যে পুলিশ গাড়ি চালাচ্ছিল, আমার দিকে কটমট করে তাকালো, দৃষ্টিটি লোলুপ, নাকি দৃষ্টিটি রাগে ঘৃণায় ফোলা, বুঝতে পারি না।
দুপুর পার হয়ে গেছে, তখনও দিল্লি পৌঁছোনোর তোনামইনেই বরং রাস্তার সাইনবোর্ডগুলো দেখে বুঝি দিল্লির উল্টো পথে চলছে আমাদের গাড়ি। দিল্লি পেছনে। বুক ধুকধুক করে। ভয়ে কণ্ঠ শুকিয়ে খরা। গাড়ি একসময় বড় রাস্তা থেকে নেমে যায় অলিতে গলিতে, মাঠে ময়দানে, ক্ষেতে। ক্ষেত মাড়িয়ে গাড়ি চলে, পারলে নর্দৰ্মায় নেমে যায়। আমার মনে হতে থাকে, এই লোকগুলো সত্যিকার পুলিশ নয়। এরা আমাকে অপহরণ করেছে। আইএসআই বলে কী যেন ভয়ংকর কী আছে, সম্ভবত এরাই। এরাই আমাকে জয়পুর থেকে ছলে বলে কৌশলে বের করে নিয়ে এসেছে। অজ পাড়া গাঁ’র কোনও ঝাড় জঙ্গলে নিয়ে মেরে ফেলে রাখবে। মরে পচে থাকবো, কেউ জানবেও না।
দিল্লির রাস্তা থেকে এরা অনেক আগেই গাড়ির বহর ঘুরিয়ে নিয়েছে। কোথায় যাচ্ছে, তা অনুমান করার সাধ্য আমার নেই। নিজেদের মধ্যে রাজস্থানী ভাষায় কথা বলছে, আর ফিরে ফিরে তাকাচ্ছে। ড্রাইভারের চোখে এখনও আমাকে গিলে খাওয়ার দৃষ্টি। দেখে নিচ্ছে আমি ঠিক আছি কি না, আমার পেছনের সিটে যারা আছে, তারা ঠিক কি না, এই গাড়ির পেছনের গাড়িটায় কোনও অসুবিধে হচ্ছে কি না, এবং পেছনের গাড়িটার পেছনে কোনও সন্দেহজনক গাড়ির চিহ্ন আছে কি না। আমি নিশ্চিত এরা পুলিশ নয়, এরা আমার আততায়ী। আমার ফোন বন্ধ, দাদাকাঠ, আমি বোবা, গাড়ির নম্বর প্লেট নেই, লোকগুলোর গায়ে পুলিশের পোশাক নেই, হাসছে হা হা। ওদের কোনও প্রশ্ন করবো বা মোবাইলে কাউকে চুপচুপ করে এসএমএসে জানাবো অবস্থা, সে সাহস নেই, দাদার সঙ্গে কানে কানে কথা বলবো সেই শক্তিও নেই। গাড়ি এসে থামলো একটা নির্জন এলাকায় এক একলা বাড়িতে। সেই বাড়িতে একটি প্রাণী নেই, সেখানে আমাদের একটা ঘরে বসতে বলা হল। আমার রক্তচাপ, আমি নিশ্চিত, বেড়ে আকাশে উঠেছে। বাথরুমে ঢুকে ফিসফিস করে, যেন আততায়ীরা টের না পায়, ফোনে কথা বলি ভ’বাবুর ঘনিষ্ঠ এক লোকের সঙ্গে। ‘আমার মনে হচ্ছে আমাকে কিডন্যাপ করা হয়েছে। এরা নিশ্চয়ই মুসলিম মৌলবাদী, আমাকে খুন করতে এতদুর নিয়ে এসেছে, দিল্লি না গিয়ে আমাকে একটা জঙ্গলের মধ্যে, লোকালয় থেকে দূরে একটা বাড়িতে ঢুকিয়েছে। আমার ভয় হচ্ছে। চেনা লোক ভ’বাবুর কাছ থেকে খবর নিয়ে খানিক বাদে আমাকে জানালো, যে, ভ’বাবু মনে করছেন না আমাকে অপহরণ করা হয়েছে। আমার দুশ্চিন্তা করার কিছু নেই। এর চেয়ে স্বস্তির আর কী হতে পারে! জোরে শ্বাস নিই। কয়েকটা ঘণ্টা প্রায় শ্বাস বন্ধ করে পড়েছিলাম গাড়িতে। কয়েকটা ঘণ্টা আমার রক্তে, নাড়িতে আতংকের তুফান বয়ে গেছে। জোরে শ্বাস নিয়ে বিধ্বস্ত সন্ত্রস্ত মনটাকে আরাম দিতে চেষ্টা করি।
একজন পুলিশ এসে জানান, জয়পুর থেকে কয়েকজন অফিসার আসছেন, আমার সঙ্গে কথা বলবেন। অফিসারদের দেখে যে মৃত্যুভয় আমার ঘাড়ের ওপর শকুনের মতো বসে মাথার খুলি ঠুকরে ঠুকরে খুলে অবশ করে দিচ্ছিলো মস্তিষ্ক, পালায় লেজ গুটিয়ে। রাতের খাওয়ার সময় আমাকে বললেন ওঁরা, যে, এত সাংবাদিকের গাড়ি আমার গাড়ির পিছু নিয়েছিলো যে ওঁদের এড়াতে পুলিশ আমার গাড়ির প্লেট খুলে নিয়েছে, নিজেদের পোশাক বদলে ফেলেছে, যেন আমার গাড়ির পিছু নিতে কেউ না পারে, যেন আমার গাড়ি বলে গাড়িকে চিনতে না পারে। যে সময়ে আমার পৌঁছানোর কথা দিল্লিতে, সে সময় না পৌঁছোনো নিরাপত্তার কারণেই। সাংবাদিক থেকে, খবর থেকে নিরাপদ দুরত্বে থাকা।
ঘটনাটি এত কেন গোপন রাখা হচ্ছে, বুঝি না। এ কথা বললেই হতো আমাকে যে সাংবাদিকদের এড়ানোর জন্য এসব করা হচ্ছে। এত রহস্যের জট তো আমি খুলতে পারি না।
নিশ্চিন্তে দিল্লি চলি। সঙ্গে চারজন অফিসার। পথে যেতে যেতেই শুনি রাজস্থানের সরকার বিজেপি সরকার, মুখ্যমন্ত্রীর নাম বসুন্ধরা রাজে, মহিলা। এসবের কিছুই আমার জানা ছিল না। অফিসারদের মধ্যে একজন বাঙালি। যেন প্রাণ ফিরে পাই। তার সঙ্গেই গল্প করি বেশি।
দিল্লির রাজস্থান হাউজে গাড়ি থামলো। এত যে সতর্কতা ছিল সাংবাদিকদের কবলে না পড়ার, কই সে তো পড়তেই হল। ক্যামেরার ঝলসানো আলোর মধ্য দিয়ে আমাকে গাড়ি থেকে দ্রুত নামিয়ে দোতলায় ওঠানো হল। একটা সুইট দেওয়া হল বিশ্রাম নিতে। আজ রাতটা এখানে কাটালে কাল সকালে আমাকে কোনও এক নিরাপদ বাড়িতে নিয়ে যাওয়া হবে। এ কথা আমাকে ভ’বাবু ফোনে বললেন। এও বললেন, আমার জন্য কেউ একজন কাপড় চোপড় কিনে নিয়ে আসছে।