নিমা হক বলেছেন, ‘স্বাধীনতা ভোগের একটা সীমা আছে। তসলিমা সে সীমা লঙ্ঘন করেছেন। সাহিত্যের নামে এই ধৃষ্টতার জন্য তার শুধু তিরস্কারই প্রাপ্য নয়, প্রাপ্য শাস্তিও’। আসাদ চৌধুরীকে বহুকাল চিনি, খুব প্রশংসা করতেন আমার লেখার। তিনি বলেছেন, ‘ব্যক্তি সমাজ বিশাল জনগোষ্ঠী নিয়েই সাহিত্য, কোনও লাম্পট্যের নির্লজ্জ বর্ণনা কখনো সাহিত্য হতে পারে না’।
এদিকে পশ্চিমবঙ্গের বিখ্যাত লেখকরা শকুনের মতো খামছে ধরেছেন আমাকে। সমরেশ মজুমদার লিখলেন, ‘প্রায় ৯০ বছর আগে কলকাতার সোনাগাছিতে খ্যাতনামা বেশ্যা থাকতেন। তাঁর নাম ছিল নন্দরানী। কলকাতার প্রায় সমস্ত খ্যাতনামা ব্যক্তিদের যাতায়াত ছিল তাঁর কাছে। অবশ্যই খদ্দের হিসেবে। তিনি যদি এঁদের নিয়ে উপন্যাস রচনা করার কথা ভাবতেন তাহলে তিনি তা অনেকদিন আগেই করতে পারতেন। কিন্তু তিনি তাঁর ব্যক্তিগত জীবনে সমাজে চুপচাপ থাকার ভদ্রতা ও সৌজন্যের পরিচয় দিয়েছিলেন। কিন্তু তসলিমা নাসরিন নন্দরানীর সেই আত্মসম্মানবোধের অংশীদার হতে পারেননি। তসলিমা শাড়ি বদলাবার মতো করে পুরুষ বদলেছেন। মানসিক সম্পর্কের চেয়ে শারীরিক সম্পর্কের ওপর জোর দিয়ে এসেছেন। সাধারণ মেয়েরা তাঁর এই দ্বিচারিতার কথা জানতে পারেনি। তবে সবারই বাক স্বাধীনতা আছে। তসলিমা বলেছেন, আমরা শুনেছি। বিচার করার ক্ষমতা নিজেদের ওপর নির্ভর করছে। ঘরের ভিতর বন্ধুবান্ধবের মধ্যে খিস্তি খেউর করা যায় কিন্তু প্রকাশ্যে তা করলেই তাকে অশ্লীলতা বলে। এখন যা তিনি প্রকাশ্যে বলছেন, একসময় সেই কাজে নিজেই সহযোগিতা করেছেন। আসলে ওঁর উদ্দেশ্য ছিল বই বিক্রি করা এবং প্রচার পাওয়া। পশ্চিমবঙ্গের কবি সুবোধ সরকার লিখেছেন, তিনি সুইডেন থেকে ‘ক’ নামে একটি যৌন বোমা পাঠিয়েছেন ঢাকায় এবং ঢাকায় সেটি ফেটেছে। বইটিতে নাকি সমাজ নিয়ে, পরিবার নিয়ে, ধর্ম নিয়ে কথা আছে, কিন্তু কে শোনে ওদের কথা, যখন একই মোড়কে রয়েছে বেশ কয়েকটি রগরগে বেড সিন। বেডসিনের কাছে এই মর পৃথিবীতে ইরাক-আমেরিকাও তুচ্ছ সেটা আবার বোঝা গেল। ..হায়রে, যৌনতা কি তসলিমার ভেতরের কোনো দুরারোগ্য ব্যাধি, যা তার বাবাকে ছাড়ে না, বাবার বয়সীদেরও ছাড়ে না! শুনেছি আপনার যৌনকেচ্ছার তালিকা নাকি আরও বেরোবে। কলকাতার লেখকরাও দিন গুনছেন। নিশ্চয়ই আপনার স্টকে ফরাসি ইতালিয়ানরাও আছেন। অচিরেই আপনার নাম বিখ্যাত বাঈজির তালিকায় উঠবে। দু’একজন বাঙালি স্কলার আপনাকে নিয়ে বই লিখবে, একজন লেখিকা কোন আর্থ সামাজিক চাপে বাঈজি হয়ে গেলেন। ভাগ্যিস, আপনি সুইডেনে থাকেন। খারাপ পাড়ার লোকেরা এরপর জানতে চাইবেন, কীসে আপনার পেমেন্ট হয়, ডলারে, সুইডিশ ক্রোনারে, টাকায় না রুপিতে? ভাষাহীন মেয়েদের ভাষা দিতে চেয়েছিলেন আপনি, সেই মহৎ ইমেজ আর থাকলো না। এবার মেয়েরাও আপনাকে ছুলে ডেটল দিয়ে হাত ধোবেন। আরবের আতরও আপনার ছোট্ট দুটো হাতের গন্ধ দূর করতে পারবে না কোনোদিন’।
আরেক বিখ্যাত লেখক শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় বলেছেন, ‘শুনেছি বুদ্ধিজীবীদের সঙ্গে তার যৌনসম্পর্কের নানা বর্ণনা তিনি দিয়েছেন। আমি এটাকে অশ্লীল বলে মনে করি না। তিনি যদি তার বিবেক মুক্তির জন্য লিখে থাকতেন তাহলে বলার কিছু ছিল না। কিন্তু চমক সৃষ্টির উদ্দেশ্য নিয়ে লিখেছেন। এটাকে আমি মেনে নিতে পারি না। সাহিত্য ও অশ্লীলতার মধ্যে সীমারেখা টানতে জানাই সাহিত্যিকদের দায়িত্ববোধের পরিচয়’।
নবনীতা দেব সেনও বলেছেন মন্দ। বাণী বসুও মন্দ। বাণী বসু বলেছেন, ‘আত্মজীবনী পড়ে যদি গিমিক মনে হয় তাহলে তার সততা নিয়ে সকলে প্রশ্ন তোলে। পাঠকের এই কৌতূহল সাময়িক। সাহিত্য বিচারে তার লেখা নিম্নমানের। এই ধরনের লেখার কোনো সাহিত্যমূল্য নেই। এই বাণী বসুও অবশ্য পরে দৈনিক স্টেটসম্যানএ ছাপা হওয়া আমার কলাম পড়ে ফোন করেছিলেন আমাকে, বলেছিলেন আমার লেখা নাকি খুব ভালো লাগে তাঁর। অবশ্য আমি জানি না আমি ছাড়া বাইরের কাউকে তিনি তার মুগ্ধতার কথা জানতে দিয়েছেন কি না।
মল্লিকা সেনগুপ্ত, নতুন নারীবাদী কবি, লিখলেন, এখানে শুধু শোওয়ার জন্য শোওয়া। একের পর এক তালিকা। এটা কোনো আত্মজীবনী হতে পারে না। এর মধ্যে কতটা সত্যি আছে জানি না, কারণ অতীতেও তার সততায় সংশয় ছিল। এর সাহিত্যিক সততা এবং নারীবাদী সততা আমার কাছে স্বচ্ছ নয়। প্রতিটি সম্পর্ক তসলিমা নিজেই তৈরি করেছেন। সেখানে কার সঙ্গে শুয়েছেন, কার সঙ্গে কি করেছেন সেটা চমক তো বটে। এর মধ্যে কোনো বিশেষত্ব নেই। তসলিমার এই জীবনলেখ মানুষের আস্থা হারিয়েছে।… শোবার ঘরের অন্য গল্প আছে, কিন্তু তাঁর মতো রগরগে ভাষায় লেখার রুচি সকলের হয় না। হয় না বলেই সাহিত্য টিকে আছে। তসলিমার শোবার ঘরের চেয়ে অনেক বড় জায়গায় নারীবাদের লড়াই বেঁচে আছে।
গৌতম ঘোষ দস্তিদারকে বন্ধু-কবি বলেই জানতাম। তিনি দ্বিখণ্ডিত সম্পর্কে লিখলেন, ‘এই স্ববিরোধিতা, এইসব সচেতন যুক্তিহীনতা, অর্ধসত্য, ক্লেদ আর নির্লজ্জতাই তসলিমার চরিত্র। মূল্যবোধ জাতীয় কোনো শব্দ তসলিমার অভিধানে নেই। খ্যাতি, খ্যাতি আর খ্যাতি ছাড়া কোনো লক্ষ্য নেই। অখ্যাতিকেও তিনি খ্যাতি বলে ভাবেন। ফলে, সত্যের অছিলায় নিজের জীবনকাহিনী লিখতে গিয়ে নিজেকেই কেবল নগ্ন করে দেখান না, অন্যকেও নগ্ন করেন। এখানেই তার মূল্যবোধহীনতা প্রকট হয়ে ওঠে। আমরা যদি তার এইসব যৌনগাথাগুলিকে সত্যি বলেও ধরে নিই, তাহলেও প্রশ্ন ওঠে, এই গোপন তিনি প্রকাশ্যে করতে পারেন কি না, তাতে সম্পর্কের (হোক তাজৈব) শর্ত ভাঙে কি না। অবশ্য, তসলিমার কাছে এইসব স্বাভাবিক বৃত্তি আশা করা বৃথা। প্রথমাবধিই তাঁর এই জাতীয় মূল্যবোধ গড়ে ওঠেনি’।