প্র–মধ্যপ্রদেশে চলে যান না, ওখানে তো বিশাল জঙ্গল আছে।
ত–আপনি আমাকে জঙ্গলে পাঠিয়ে দিতে চান?
প্র–(অপ্রস্তুত হেসে) না, আসলে আমি তো জঙ্গল খুব ভালোবাসি, তাই বলছি।
ত–আমার জঙ্গল ভালো লাগে না।
প্র–তাহলে কী ভালো লাগে?
ত–সমুদ্র, পাহাড় এসব ভালো লাগে।
প্র–তাহলে কেরালায় চলে যান। ওখানে এনজয় করুন সমুদ্র।
ত–ফিরবো কবে?
প্র–তিনচার মাস থাকুন। এদিকের আগুনটা কমলে ফিরবেন।
ত–আগুনের তো কিছু দেখছি না।
প্র–আপনি দেখছেন না, আমরা তো দেখছি।
ত–ও।
প্র–আর ফিরে এসে আপনি এই ফ্ল্যাটটা পাল্টে নেবেন। সাউথের দিকে কোথাও ফ্ল্যাট নিন। বালিগঞ্জের দিকে নিন। এটা মুসলিম এরিয়ার খুব কাছে।
ত–ফ্ল্যাট খুঁজে পাওয়া এত কষ্টের। প্রচুর ফ্ল্যাট দেখেছি। ভালো জায়গায় ভালো ফ্ল্যাট এখনও পাওয়া হয়নি। এই ফ্ল্যাটটা খুব তাড়াহুড়ো করে নিয়েছিলাম। কোনও উপায় ছিল না। ভাড়া খুব বেশি। একটু কম ভাড়ার ফ্ল্যাট পেলে ভালো হয়।
প্র–কোনও চিন্তা করবেন না। আমরাই খুঁজে দেব।
ত–এই বাড়ি ফেলে এতদিনের জন্য কী করে আমি দূরে থাকবো? আমার তো খুব দরকারি জিনিসপত্র আছে এ বাড়িতে। কত বই। কত সার্টিফিকেট, ডকুমেন্টস! সব কি এভাবে ফেলে চলে যাওয়া ঠিক হবে?
প্র–দামি কী আছে?
ত–সোনার মেডেল টেডেল আছে…
প্র–শুনুন, ভ্যালুবল জিনিস বরং নিয়ে যান।
ত–নিয়ে যাবো? ওগুলো নিয়ে পথে পথে ঘুরবো? আর ঘর বাড়ি এভাবেই পড়ে থাকবে? আমার বেড়ালটা কোথায় যাবে?
প্ৰ–একটুও চিন্তা করবেন না। আমার ছেলেরা দেখবে আপনার ফ্ল্যাট। বেড়াল নিয়েও দুশ্চিন্তার কিছু নেই।
ত–আপনি যে এভাবে বাইরে চলে যেতে বলছেন। কতদিনের জন্য বলছেন যেতে। ফিরবো কবে? ফেরার কথা ঠিক করে তো বলছেন না।
প্র–যান। দুতিন মাস পর ফিরে আসুন।
ত–দুতিন মাসে কি পরিস্থিতি শান্ত হবে বলে আপনার বিশ্বাস?
প্র–হ্যাঁ হয়ে যাবে। কত আর নেবে? কয়েক মাস পরেই সব ঠিক হয়ে যাবে। বছর। খানেকের মধ্যে তো হবেই মনে হচ্ছে।
ত পরিস্থিতি তত আমি মোটেও অশান্ত দেখছি না। কিন্তু আমি কলকাতায় থাকলে, যা আপনি বলছেন, পরিস্থিতি অশান্ত হয়। তাহলে তো আমি ফিরে এলে আবার পরিস্থিতি অশান্ত হবে। আমি ফিরে এলে ওরা কি চুপ করে বসে থাকবে? মেনে নেবে?
প্র–এ নিয়ে ভাববেন না। তখনেরটা তখন দেখা যাবে।
ত–তাহলে এখনেরটা এখন দেখাই ভালো। পালিয়ে গিয়ে কোনও সমস্যার কি সত্যিকার সমাধান হয়? ওরা যদি জানে যে আমি ওদের ভয়ে চলে গেছি, তাহলে বিরাট ভিকটরি হবে ওদের।
প্ৰ–আপনার এই ফ্ল্যাটটা কবে নিয়েছেন?
ত–এই তো বছর তিনেক আগে।
প্র–জায়গাটা ভালো না। মুসলিম এরিয়ার খুব কাছে। যে কোনও সময় অ্যাটাক হতে পারে। দেখি তো ফ্ল্যাটটা, কত স্কোয়ার ফুট?
ত–ঠিক জানি না, মনে হয় সতেরোশ। দুহাজারও হতে পারে। একেকজন একেকরকম বলে।
প্র–(উঠে ফ্ল্যাট দেখতে দেখতে) হা এরকমই একটা আমরা দেখে রাখবো। ওদিকে বাথরুম?
ত–হ্যাঁ ওদিকে বাথরুম।
প্র–(স্টাডিতে এসে) স্টাডি?
ত–হ্যাঁ। এখানেই বেশির ভাগ সময় থাকি।
প্র–এখানেই বেশির ভাগ সময়? কেন, এখানে কী করেন?
ত–লেখা পড়া করি।
প্র–(কমপিউটারের কাছে এসে) কমপিউটারে লেখেন?
ত–হ্যাঁ।
প্র–বাংলায় লেখেন?
ত–হ্যাঁ।
প্র–আশ্চর্য!
ত–আশ্চর্য কেন।
প্র–কী করে লেখেন, দেখান তো।
ত–(বাংলা একটি লাইন ‘আমার পক্ষে কোথাও যাওয়া অসম্ভব। না, এ হতে পারে না’ –লিখে) এভাবেই বাংলা লিখি।
প্ৰ–(মৃদু হেসে) কী করে জানেন কোন্ কী তে কোন্ বাংলা অক্ষর আছে?
ত–অনেক বছর ধরে লিখছি কমপিউটারে। কোন রোমান হরফের তলায় বাংলা কোন হরফ লুকিয়ে আছে, জানা হয়ে গেছে।
প্ৰ–(দরজার কাছে, চলে যেতে যেতে) আপনার বোন কবে আসছে যেন?
ত–এই তো দুদিন পর। ও অসুস্থ। কিছু ডাক্তার টাক্তার দেখাবে।
প্র–শুনুন। আপনি কিন্তু চলে যান অ্যাজ সুন আজ পসিবল। কবে যাচ্ছেন এটা আমাকে তাড়াতাড়ি ফোনে জানিয়ে দেন।
ত–আমাকে একটু ভাবতে হবে।
প্র–ভাবার কিছু নেই। অ্যাজ সুন আজ পসিবল চলে যেতে হবে।
প্রসূন মুখার্জি বেরিয়ে গেলেন। দরজার ওপারে দাঁড়িয়ে থাকা পুলিশগুলো সব মুহূর্তে চেয়ার ছেড়ে দাঁড়িয়ে পড়লো। অসম্ভব সমীহ করে এরা উঁচু পদের কর্মকর্তাদের। আমি দরজা বন্ধ করে স্টাডিতে এসে স্থবির বসে থাকি। কণ্ঠের কাছে থোক থোক কষ্ট এসে জমছে। উস্রি চলে গেল, আমি চরাচর জুড়ে একা। পায়ের তলায় যেন মাটি কাঁপছে। সবচেয়ে কাছের যে মানুষের সঙ্গে মনে হল এ বিষয় নিয়ে কথা বলতে পারি, তিনি মানস ঘোষ। তাঁর পত্রিকায় প্রতি বুধবার আমার কলাম বেরোয়। মানস ঘোষকে ফোনে খবরটা দেবার সঙ্গে সঙ্গে বললেন, সৌগত রায়কে খবরটা জানাবেন তিনি। আমার যে ক্ষুদ্র পরিচয়ের গন্ডি, এর মধ্যে রাজনীতি বোঝার লোক বাদুঃসময়ে উপদেশ দেওয়ার খুব বেশি কেউ নেই। হাতে গোনা ক’জন ছাড়া বাকি সব চেনা জানা সব আমার মতোই রাজনীতি না-বোঝা মানুষ। দু’জনই, মানস ঘোষ আর সৌগত রায় আমার বাড়ি পৌঁছোলন। প্রসূন মুখার্জি আমার বাড়িতে এসে ঘণ্টাদুয়েক ছিলেন, আমাকে কলকাতা ছাড়তে বলছেন, শুনে মানস ঘোষ ঠিক কী বলা উচিত কিছু বুঝতে পারছেন না। বারবারই এক কথা বলছেন, খুব খারাপ খুব খারাপ। খুব খারাপের পর যে ঠিক কী, তা অনেকক্ষণ তার মুখের দিকে তাকিয়ে থেকেও অনুমান করতে পারিনি। সৌগত রায় তো বলেই ফেলতে লাগলেন, ‘হা তুমি ছিলে, ভালোই লাগতো শহরটায়। তোমাকে খুব মিস করবো’।