বিবিসি থেকে আমার মন্তব্য চাইতে ফোন করলো, শুনিয়েও দিল সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় আর সৈয়দ হক আমার বিরুদ্ধে কী নিন্দা করেছেন সেসব। ক্রোধ,ঘৃণা, বিদ্রূপ, কটাক্ষ দুজনের কণ্ঠেই। সৈয়দ শামসুল হক না হয় তার গোপন সত্য প্রকাশ হওয়ায় হিতাহিত জ্ঞানশূন্য, চেঁচিয়ে, লাফিয়ে, হম্বিতম্বি করে, গালি দিয়ে, থুতু ছুঁড়ে, মামলা করে বোঝাতে চাইছেন যে তাঁর সম্পর্কে যা লিখেছি আমি তা ভুল। কিন্তু সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় নিয়ে বইয়ে তেমন কোনো কথা নেই। তার এত রাগ কেন! তিনি তো কোনো ‘পুরুষ রক্ষা সমিতি’র সদস্যও নন। তিনি বারবারই বলেছেন, দুটো মানুষের মধ্যে দরজা বন্ধ করে। যা ঘটে, তা কখনো বাইরে প্রকাশ করতে হয় না। বাইরে প্রকাশ করা যাবে না, এমন কাজ অপরাধীরাই করে। আর অপরাধীদের বাঁচানোর দায়িত্ব কে বলেছে সব মেয়েকেই নিতে হবে। আগুন যেমন এক অরণ্য থেকে আরেক অরণ্যে বাতাসের আগে ছুটে যায়, তেমন গেল, কলকাতাতেও সাহিত্য মহলের একাংশে নিন্দার ঝড় বইছে, এই ঝড়ের দেবতা, কেউ কেউ বললো, স্বয়ং সুনীল। যদিও তাঁর কিছুই আমি ফাঁস করিনি, কিন্তু কিছু যদি করি পরের বইগুলোতে, এই ভয়। আমাকে বাতিল করে, ব্যান করে, ত্যাগ করে, ত্যাজ্য করে পাঠকের কাছে আমাকে মিথ্যুক, অযোগ্য, কাণ্ডজ্ঞানহীন, ভারসাম্যহীন লেখক হিসেবে দাঁড় করাতে পারলে কেউ আমার কথা আর বিশ্বাস করবে না, আমার লেখা আর পড়বে না। এই নিন্দার ঝড়তুফান শান্ত হওয়ার আগেই খবর ছাপা হয়, পশ্চিমবঙ্গ সরকার ‘দ্বিখণ্ডিত’ নিষিদ্ধ করেছেন। পঁচিশ জন লেখক, বুদ্ধিজীবী পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীর কাছে আবেদন জানিয়েছিলেন আমার ‘দ্বিখণ্ডিত’ নিষিদ্ধ করার জন্য। মুখ্যমন্ত্রী সবার কথা শুনেছেন, নিজেও বইটি কয়েকবার পড়েছেন। পড়ে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন নিষিদ্ধ করার। নিষিদ্ধ করা হয়েছে অবশ্য অন্য কারণ দেখিয়ে, আমি নাকি মানুষের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দিয়েছি। ওদিকে বাংলাদেশে ‘ক’ নিষিদ্ধ। হাইকোর্টে সৈয়দ শামসুল হক আমার বিরুদ্ধে দশ কোটি টাকার মামলা করেছেন মানহানির, বই নিষিদ্ধ করার আকুল আবেদন জানিয়েছেন সরকারের কাছে। সরকার বই নিষিদ্ধ করার আগেই হাইকোর্ট নিষিদ্ধ করেছে। এসবে অনুপ্রাণিত হয়ে কী না জানি না, কলকাতায় প্রায় অচেনা এক কবি মানহানির মামলা ঠুকে দেয়, এ আবার এগারো কোটির। লেখকরা বই নিষিদ্ধ করছেন, লেখকরা লেখকের বিরুদ্ধে মামলা করছেন। জগতের কোথাও এমন ঘটনা ঘটে না। সভ্য লেখকরা লেখকের বাক স্বাধীনতার পক্ষে দাঁড়ান, বই নিষেধাজ্ঞার বিরুদ্ধে কথা বলেন। বাংলার লেখকদের যত দেখি, তত অবাক হই। বেশির ভাগই স্বার্থপর, সুযোগসন্ধানী, সরকারী আনুকূল্য ছাড়া বাঁচতে জানেন না। আদর্শ! নীতি! ওসব মুখে বা বইয়ে। অন্তরে নেই, বিশ্বাসে নেই, জীবন যাপনে নেই।
.
পশ্চিমবঙ্গ আর বাংলাদেশের বিখ্যাত সাহিত্যিকরা আমার নিন্দায় বিষম মেতে আছেন। নিন্দা কী রকম বীভৎস হতে পারে, কুৎসা কী রকম নির্মম হতে পারে, ঘৃণা কী রকম ভয়ংকর হতে পারে, তা অনুমান করতে হলে শুনতে হয় ওঁরা কী বলছেন, কী লিখছেন আমাকে নিয়ে। বাংলাদেশের লেখক হুমায়ুন আজাদ লিখলেন, “আমি ‘ক’ বইটি পড়ার উপযুক্ত মনে করিনি বলেই পড়িনি। এই বইয়ে আমাকেও নানারকম গালাগালি করা হয়েছে, মিথ্যে কথা লেখা হয়েছে। কিন্তু আমার সম্পর্কে কোনও যৌনতার অভিযোগ আনতে পারেনি। কারণ আমি কখনই তসলিমার ডাকে সাড়া দিইনি। সম্প্রতি প্রকাশিত ‘ক’ বইটি সম্পর্কে বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় পড়ে আমার মনে হয়েছে, এটি একটি পতিতার নগ্ন আত্মকথন অথবা একজন নিকৃষ্টতম জীবনের কুরুচিপূর্ণ বর্ণনা।’
হুমায়ুন আজাদ প্রায়ই ধর্মের সমালোচনা করেন। আমি নারীর অধিকার নিয়ে লিখতে শুরু করার পর তিনিও একই বিষয় নিয়ে একটি বই লিখতে শুরু করেন। বই লিখেছেন কিন্তু মেয়েদের প্রতি কখনও তার কোনও শ্রদ্ধাবোধ দেখিনি। একসময় নারী বিরোধী প্রবচন লিখেছেন। নারীর পক্ষে লিখলে জনপ্রিয়তা অর্জন সম্ভব হতে পারে, তা আমার ‘নির্বাচিত কলাম’এর জনপ্রিয়তা দেখেই ‘নারী’ নামে বই লিখেছেন, কিন্তু নারীকে যৌনবস্তু ভাবার মন বই লেখার আগে যেমন ছিল, তেমনই রয়ে গেছে। কোনও পরিবর্তন হয়নি। আমার সম্পর্কে মিথ্যে উচ্চারণে হুমায়ুন আজাদের কোনও অসুবিধে হয় না। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর তিনি, বলে ফেললেন তসলিমার ডাকে আমি সাড়া দিইনি। যেন আমি তাঁকে ডেকেছিলাম কোনওদিন! একজন ডাক্তার, তার ওপর জনপ্রিয় লেখক, সাহিত্য পুরস্কার সহ প্রচুর মানবাধিকার পুরস্কার পাওয়া প্রচণ্ড ব্যক্তিত্বসম্পন্ন একজন নারীর আত্মজীবনীকে তিনি বলে দিলেন ‘পতিতার নগ্ন আত্মকথন এবং নিকৃষ্টতম জীবনের কুরুচিপূর্ণ বর্ণনা’। প্রচণ্ড নারীঘৃণাকারী বদমাশও কোনো নারী সম্পর্কে না জেনে না বুঝে এই মন্তব্য করতে না। হুমায়ুন আজাদের মতো দুশ্চরিত্র, মিথ্যুক, ঈর্ষাকাতর, ছোট-লোক যদি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক হন, তবে নতুন প্রজন্ম কী শিক্ষা পেয়ে বড় হবে, ভেবে আমি শংকিত হই, সত্যি। নারী বিরোধী সমাজে নারী বিরোধী হুমায়ুন আজাদকে ঘিরে থাকার জন্য নারী বিরোধী বালককুলের অভাব হয় না।