যখন পশ্চিমবঙ্গ সরকার আমার বই নিষিদ্ধ করেছিলো, সিদ্ধান্তটি যদিও অগণতান্ত্রিক এবং বাক স্বাধীনতা বিরোধী, দলের সিদ্ধান্ত বলেই আশংকা করেছিলাম জ্যোতি বসুও বই নিষিদ্ধের পক্ষে। কিন্তু আমাকে বিস্মিত করে দলের একজনই, তিনি, বই নিষিদ্ধ করার বিপক্ষে মত দিয়েছিলেন। কখনও কারওর পায়ের ধুলো নিইনা আমি। জ্যোতি বসুরও নিইনি। যখনই দেখা হয়েছে, শ্রদ্ধা ভরে নমস্কার করেছি। কৃতজ্ঞতা প্রকাশে চিরকালই আমি খুব আনাড়ি। জানি না তিনি বুঝতে পেরেছেন কি না তাঁর দলের সিদ্ধান্তের বাইরে গিয়ে হলেও মত প্রকাশের অধিকারের পক্ষে কথা বলে শুধু নিজেকেই মহান করেননি, আমরা যারা লড়াই করছি এই অধিকারের পক্ষে, আমাদের প্রচুর শক্তি আর সাহস জুগিয়েছেন। জ্যোতি বসু সম্পর্কে মন্দ কথা বলার লোকের অভাব নেই। উন্নাসিক ছিলেন? হয়তো ছিলেন। কিন্তু বই নিষিদ্ধের বিপক্ষে তাঁর বক্তব্য শুনে, তাঁকে উন্নাসিক তো নয়ই, বরং বড় বিচক্ষণ, বড় বুদ্ধিদীপ্ত মানুষ বলে আমার মনে হয়েছে। অন্য কোনো কমিউনিস্ট নেতা, দলের সিদ্ধান্ত, সে সিদ্ধান্ত ভুল হলেও, আদর্শগত কারণে তা মানতে না পারলেও মুখ ফুটে কিছু বলেননি। এর চেয়ে মর্মান্তিক আর কী হতে পারে কোনো দলে নাম লেখাতে হলে যদি নিজস্ব বোধবুদ্ধিবিবেক বিসর্জন দিয়ে তবে লেখাতে হয়। যদিও কমিউনিজমে ধর্ম মানা নেই, তারপরও ধর্মের সমালোচনা করেছি এই দোষে আমাকে দোষী করে পশ্চিমবঙ্গের ক্ষমতাসীন কমিউনিস্টরা আমার বই নিষিদ্ধ করে মত প্রকাশের স্বাধীনতার চিতার ওপর ধর্মীয় মৌলবাদীদের বিজয় পতাকা উড়িয়ে দিলেন। এই বিজয় মৌলবাদীদের এত উৎসাহ দিয়েছে যে প্রকাশ্যে তারা একের পর এক আমার মাথার দাম ঘোষণা করতে কোনো দ্বিধা করেনি, রাস্তায় আগুন জ্বালানোর সাহসও তাদের হয়েছে।
যে সময় পশ্চিমবঙ্গের কমিউনিস্ট নেতাদের কেউই আমার সঙ্গে দেখা করেন না, আমি একটা ভয়ংকর নিষিদ্ধ নাম, আমাকে সমর্থন করা মানে, তাদের বদ্ধ বিশ্বাস, জেনেশুনে মুসলমানের ভোট হারানো সে সময় জ্যোতি বসু আমার সঙ্গে দেখা করেছেন। কারও বিরুদ্ধে আমি কোনো অভিযোগ করতে যাইনি তাঁর কাছে। দুজন আমরা গল্প করছিলাম সেই আগের দিনের মতো। তিনি তাঁর দেশের বাড়ি, তাঁর পাড়া পড়শি, তাঁর শৈশব কৈশোরের কথা বলছিলেন। বলছিলেন দেশভাগ, ধর্মান্ধতা, মুক্তিযুদ্ধ আর স্বাধীনতার কথা। আমার লেখালেখি আর এর ঐতিহাসিক গুরুত্বের কথা।
দিন যায়। যেতে থাকে। জ্যোতি বসু ছাড়া আর কারও সঙ্গে আমাকে দেখা করতে দেওয়া হয়নি দেশের ভেতর। দেশের বাইরে যেতে দেওয়া হয়েছে। তাইপেই কবিতা উৎসব থেকে ফিরে আসি। প্যারিসে গিয়েও অনুষ্ঠান শেষে ফিরি। আমার ফিরে আসাটি যে কাঙ্ক্ষিত নয়, টের পাই। ফেরার সঙ্গে সঙ্গে, যে জীবন যাপন করছিলাম, সেই জীবন আবার যাপন করতে বাধ্য হই। নীরবে নিভৃতে গৃহবন্দি জীবন। আমার খুব জানতে ইচ্ছে করে, কতদিন, ঠিক কত মাস বা বছর আমার স্বাধীনতা আমি ফিরে পাবো না। কেউ নেই আমার এই প্রশ্নের উত্তর দেবে। অনেকটা চোখ বুজে, মুখ বুজে, দাঁত কামড়ে পড়ে থাকি। পায়ে অদৃশ্য শেকল। যাঁরা শেকল পরিয়েছেন তাঁরা জানেন, আর যার পায়ে শেকল সে জানে, এ ছাড়া খুব বেশি মানুষের জানা সম্ভব হয় না শেকলের কাহিনী।
০৪. কথোপকথন
বন্দি আমি। ঘরের বাইরে বেরোনো নিষেধ। গায়ে শ্যাওলা পড়ছে। মনে ভুতুড়ে বাড়ির উঠোনের বড় বড় ঘাসের মতো ঘাস। এর মধ্যেই তিনি এলেন। সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি সময় এক সন্ধ্যায়। আসার দশ মিনিট আগে ডিজি এসবি বিনীত গোয়েল ফোনে বলে দিলেন সিপিআসছেন। পুলিশ কমিশনারকে সংক্ষেপে সিপি বলা হয়। মুখ্যমন্ত্রীকে বলা হয় সিএম। চিফ এর প্রথম বর্ণ সি আর মিনিস্টারের প্রথম বর্ণ এম নিয়ে সিএম। পশ্চিমবঙ্গের সিএম বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য। সিপি প্রসূন মুখোপাধ্যায়। প্রসূন মুখোপাধ্যায় আমার বাড়ি আসবেন। কী কান্ড, এত বড় একজন মানুষ আমার বাড়ি আসছেন কেন? এই প্রশ্নের আমি কোনও উত্তর জানি না। উত্তর খোঁজারও চেষ্টা করিনি। হতে পারে এমনি সৌজন্য সাক্ষাৎ! আমাকে নিরাপত্তা দিচ্ছেন, আমি তো আর হাবিজাবি কোনও মানুষ নই। দেখা করার ইচ্ছে ওঁর হতেই পারে। পুলিশের বড় দু’জন অফিসার এর আগে একবার সৌজন্য সাক্ষাৎ করে গেছেন। বলেছেন, আমি যেন কোনও দুশ্চিন্তা না করি, আমার নিরাপত্তার জন্য সবরকম ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। অফিসার দুজনের মধ্যে একজন ছিলেন জাভেদ শামীম, রীতিমত সুদর্শন। কথায় কথায় বললেন, ‘হায়দারাবাদে যারা আপনার ওপর হামলা চালিয়েছিলো, তারা হেলা করার মতো লোক নয় কিন্তু। সবাই উচ্চশিক্ষিত। লেখাপড়া করতে বিলেত পর্যন্ত গেছে ওরা। চমৎকার ইংরেজি বলে। ওদের ইংরেজি শুনলে বোঝাই যায় না ওরা ভারতীয়। জাভেদ শামীমের চোখে ছিল হায়দারাবাদের ওয়াইসি বংশের লোকদের জন্য সমীহ আর মুগ্ধতা! প্রসূন মুখোপাধ্যায় এলে মিষ্টি, বিস্কুট, চা, চানাচুর ইত্যাদি নানা কিছু দিয়ে আপ্যায়ন করা হয়। এর আগে ফোনে ওঁর সঙ্গে কথা হয়েছে। দেখা যদি হয়েও থাকে কোথাও, কেমন আছেন, ভালো জাতীয় মামুলী কথা ছাড়া বেশি কিছু কথা হয়নি। কথোপকথন মোট দুঘণ্টার। মোদ্দা কথাগুলো এরকম।