পায়ে আমার অদৃশ্য শেকল। চলতে গেলেই বাজে এই শেকল। শেকলই বলে দেয়, কোথায় এবং কতদূর যেতে পারি আমি। অন্যায় মেনে নেওয়ার মানুষ তো আমি নই। বিনা অপরাধে আমাকে বন্দি করা হবে কেন? আমার মনে আর শরীরে লক্ষ করি প্রতিবাদের বুদবুদ। অস্থির আমি কেবল ঘর-বারান্দা করি। এত প্রিয় ঘর, এটিকেই মনে হতে থাকে কারাগার। বন্ধুরা যারাই আসে, এই বন্দিত্বের কথা শোনে, চুক চুক করে দুঃখ করে চলে যায়। হয়তো কারওরই কিছু করার নেই। অথবা করার থাকলেও করা উচিত হবে কী না ঠিক বুঝে পায় না। একদিন হঠাৎই দেখতে চাই সরকারি নিষেধাজ্ঞা কত দূর গেছে, বা যেতে পারে। পুলিশদের জানিয়ে দিই, জ্যোতি বসুর সঙ্গে দেখা করবো। সঙ্গে সঙ্গে ওপরতলায় খবর চলে গেল। জ্যোতি বসুর বাড়ি যেতে চাইছি আমি। সত্যি বলতে কী, জ্যোতি বসুর সঙ্গে দেখা করা জরুরি ছিল না আমার। মনে হয়েছিল, উনিই হয়তো একমাত্র মানুষ এ শহরে, যার সঙ্গে দেখা করতে চাইলে আমার পায়ের শেকল খুলে দেওয়া হবে। জ্যোতি বসু প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রীই শুধু নন, ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা। শুরু থেকেই আছেন এই পার্টির সঙ্গে। সাতাত্তর থেকে দু’হাজার সাল, সবচেয়ে দীর্ঘ সময় তিনি ছিলেন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী। জ্যোতি বসুকে ফোন করে দেখা করতে চাই’ বলার সঙ্গে সঙ্গে তিনি রাজি হয়েছেন। মানুষটি অসাধারণ। একবারও ভাবলেন না, তাঁর পার্টির সরকার আমার বই নিষিদ্ধ করেছে, আর এখন হায়দারাবাদে আমার ওপর হামলা হওয়ার পর কোথায় আমাকে পাশে দাঁড়াবে, তা নয়, আমাকে গৃহবন্দি করেছে, আমার সঙ্গে দেখা করাটা তার উচিত হবে না। একবারও জিজ্ঞেস করেননি, কী কারণে দেখা করতে চাই, কী কথা বলতে চাই বা এ জাতীয় কোনও প্রশ্ন।
বর্তমান মুখ্যমন্ত্রী এখন অনুমতি দেন কী না প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করতে, সেটিই দেখার বিষয়। আমাকে বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হয়নি। মুহূর্তে খবর চলে এলো, দেবেন দেখা করতে। হাসি ফুটলো শংকরের মুখে। পুলিশগুলো ভালোবাসে আমাকে। আমার বন্দিত্ব এদেরও পীড়া দেয়। ছোট সরকারি চাকুরে, সরকারি সিদ্ধান্ত বদল করার শক্তি এদের নেই। ফুলের বড় একটা তোড়া নিয়ে, মিঠাই থেকে অনেক দই আর রসগোল্লা নিয়ে রওনা হই মহান নেতার ইন্দিরা ভবনে। কী আনন্দ যে হয়! আনন্দ হয় মুক্তির স্বাদ পেয়েছি বলে। স্বাধীনতার জন্য সংগ্রাম করছি বলে বারবারই বিপদের মুখে পড়ছি। বারবার পরাধীনতার শৃংখলে জড়িয়ে পড়ছি। সে আমি জানি। তারপরও আপোস করার কথা মুহূর্তের জন্যও মনে আনি না।
ইন্দিরা ভবনে পৌঁছোনোর পর জয়কৃষ্ণ, জ্যোতি বসুর দেখাশোনা করার ভার যার ওপর, জানিয়ে দিলেন, কোনও মিষ্টিই ঘরে আনার দরকার নেই, তিনি খাবেন না। কী কাণ্ড! খাবেন না, অতিথিদের তো খাওয়াতে পারেন! জয়কৃষ্ণের তীব্র সতর্কতার অথবা কঠিন আদেশের সঙ্গে তর্ক করতে ইচ্ছে করেনি। ঘরে ঢুকে তাঁর জন্য অপেক্ষা করি। তিনি এসে মুখে সেই রহস্যের হাসি, হাত জোড় করে নমস্কার জানালেন। উঠে দাঁড়িয়ে আমিও। খুব বেশি কারও সঙ্গে আজকাল দেখা করেন না। অসুস্থ। পরনে সবুজ একখানা লুঙ্গি আর সাদা ফতুয়া। তাঁর সঙ্গে আগে আরও দুবার আমার দেখা হয়েছে, এই ইন্দিরা ভবনেই। এত বড় একজন মানুষ, অথচ আমার সঙ্গে বসে কী সহজে কথা বলেন। কথা বলতে বলতে আমি ভুলে যেতে থাকি তার সঙ্গে বসে গল্প করার যোগ্য আমি নই। সম্ভবত রাজনীতির খুব বেশি কিছু আমি বুঝি না বলেই কোনওদিনই রাজনীতিবিদদের সঙ্গে ভালো কথা বলতে জানি না আমি।
খুব বড় মানুষদের সঙ্গে যেচে কোনোদিন পরিচিত হতে বা খাতির জমাতে যাই না। এ আমার স্বভাবের বাইরে। বড়রা যদি আমার ব্যাপারে অত্যন্ত আগ্রহ দেখান, তাহলেই সশরীরে উপস্থিত থেকে বড়দের আগ্রহ যথাসম্ভব মেটাতে অথবাদূর করতে তেমন আপত্তি করি না। বড়দের কাছে আমার না যাওয়ার কারণ কিন্তু অহংকার নয়, নিতান্তই সংকোচ। বড়রা ব্যস্ত মানুষ, অযথা তাদের বিরক্ত না করে দুর থেকে তাদের সরবে নীরবে শ্রদ্ধা করে যাওয়াই স্বাস্থ্যসম্মত। কিন্তু আমারই তৈরি এই নিয়ম অনিচ্ছাসত্ত্বেও কখনো কখনো আমাকে ভাঙতে হয়েছে। ফ্রাঁসোয়া মিতেরোঁর সঙ্গে দেখা করতে হবে, জ্যাক শিরাখের সঙ্গেও। লিওনেল জসপা তোমাকে ডেকেছেন, সিমোন ভেইল অপেক্ষা করছেন, গুন্টার গ্রাসের সঙ্গে দেখা করবে এসো, অ্যালেন গিন্সবার্গ কথা বলবেন। বাধ্য হয়েছি দেখা করতে। বড়দের সঙ্গে সত্যি বলতে কী কখনো কোনো সম্পর্ক গড়ে ওঠে না আমার। ওঁদের সঙ্গে দেখা হয়, ওঁরা চমৎকার কথা বলেন, কেউ কেউ বেশ আদর যত্নও করেন। কিন্তু বিদেয়টা শেষ বিদেয়ই হয়। যোগাযোগে আলসেমি আছে বলে ও পথ মাড়াই না, আর বড়রা বড় বলে খুব স্বাভাবিক, যে, কোনো খোঁজ খবরও আর করেন না। জ্যোতি বসুর সঙ্গে বছর সাত আগে এভাবেই আমার দেখা হয়েছে। প্রথম দেখা। কারও কাছে কোনো আবদার করিনি, কোনো ইচ্ছে প্রকাশ করিনি দেখা করতে চাওয়ার, হঠাৎ শুনি তাঁর সঙ্গে আমার দেখা করার দিন তারিখ সব ঠিক। ঘটনাটি ঘটিয়েছিলেন আমার এক শুভাকাঙ্খী, সম্ভবত তিনি আমাকে বড় জাতের কিছু বলে ধারণা করেছিলেন। জ্যোতি বসুর মতো বিশাল এক মানুষের সঙ্গে আমার মতো ক্ষুদ্র লেখক রাজনীতির মাথামুণ্ডু যে কিচ্ছু জানে না, কী কথা বলবে! নিজের মুখতা আর অজ্ঞতা নিয়ে আশংকায় কুঁকড়ে ছিলাম। আমি ক্ষুদ্র জেনেও আমার সঙ্গে দেখা করতে কোনো অনীহা ছিল না জ্যোতি বসুর। তিনি তো এলেনই, তাঁর স্ত্রীও এলেন, এমনভাবে কথা বলছিলেন যেন আমাকে কতকাল চেনেন, যেন আমি তাঁদের কতকালের চেনা বা আত্মীয়। মানুষ খুব বড় হলে সম্ভবত অচেনা অজানা লোক আর নিজের মাঝখানে কোনো দেয়াল রাখেন না। এই প্রথম আমি কোনো বড় মানুষের কাছাকাছি এসে বোধ করলাম যে মানুষটির সঙ্গে আবার কখনও আমার দেখা হতে পারে। তাঁর সঙ্গে রাজনীতির সাদা কালো, মন্দ ভালোর গল্প করার আমার কোনো দরকার নেই। আমি শুধু তার শৈশব কৈশোরের গল্প, তার দুঃখ সুখের, আনন্দ বেদনার ছোট ছোট কথা কাহিনী শুনেই মুগ্ধ।