ব্যক্তিগত মতামত ও সামাজিক সহিষ্ণুতার এই প্রথম পাঠ বিভেদরেখার সকল দিকের মানুষকেই গ্রহণ করিতে হইবে, গত্যন্তর নাই। আদিমতা হইতে আধুনিকতার যাত্রাপথে একটি বিষয় স্পষ্ট হইয়া গিয়াছে, ব্যক্তি ও গোষ্ঠীর বিশ্বাস ও মতামতকে শ্রদ্ধা করা না গেলেও সহ্য করিতেই হইবে, ইহা সভ্যতার মৌলিক ভিত্তি। অর্থাৎ ইহা কেবল বাঞ্ছনীয় নয়, ইহা একেবারে আবশ্যিকএর পর্যায়ে। প্রয়োজনে অধৈর্য ও অসহিষ্ণুতার অপরাধের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি প্রয়োজন। দেব দেবীর প্রেমলীলাঅঙ্কন করিয়াছেন বলিয়াশিল্পীকে যাহারা। লাঞ্ছনা করেন, কিংবা ধর্মপুরুষের অবমাননা রচনা হইয়াছে বলিয়া যাহারা লেখকের দিকে আক্রমণার্থে ধাবিত হন, তাহাদের সকলেরই কঠিন শাস্তি পাওয়া উচিত। সমাজ যদি নিজে হইতে সভ্যতা ও সুশীলতার সংস্কৃতি গড়িয়া তুলিতে না পারে, পরস্পর-সহনের বোধটিতে পৌঁছাইতে না পারে, তবে রাষ্ট্রেরই আগাইয়া আসিতে হইবে, উপায় কী!
প্রতিবাদ এমন অনেক হয়েছে। না, শাস্তি ওই হায়দারাবাদি মৌলবাদীদের কারওরই হয়নি। গ্রেফতার করে থানায় নিয়ে গেছে, থানায় কিছুক্ষণ রেখে, সম্ভবত চা বিস্কুট খাইয়ে, ছেড়ে দিয়েছে। সরকারি দলের জোটশক্তি ওরা। সুতরাং সত্যিকার শাস্তি, অনেকে বলছে, ওদের কেউ দেবে না। এমনিতে পার পেয়ে যাবে।
মানুষ কেন এত মূর্খ হয়, কেন এত নিষ্ঠুর হয়, আমি বুঝতে পারি না। ধর্মবিশ্বাসের সঙ্গে মুখতা আর নিষ্ঠুরতার সম্পর্ক খুব গভীর। নিষ্ঠুরতা খুব সংক্রামক। হায়দারাবাদে আমাকে আক্রমণ করা হলো, কিন্তু যে শহরে থাকি সে শহরে কোনও জুৎসই আক্রমণ এখনও হলো না, এ নিয়ে কলকাতার মৌলবাদীরা দুঃখ প্রকাশ করতে শুরু করলো। দুঃখ ঝেড়ে একদিন সোজা নেমে পড়লো আমার মাথার দাম ঘোষণা করতে বা কুশপুতুল পোড়াতে। মাঠে নামানো হল মাদ্রাসার ছাত্রদের, যারা জানেই না আমার নাম,বা কিছু। মাদ্রাসার এক পাল ছেলে আমার কুশপুতুল পোড়াচ্ছে, অথচ কোনওদিন পড়েনি আমার একটিও বই। কেন পোড়াচ্ছে, কারণ তাদের মৌলবাদী নেতা বলেছে, আমি নাকি ইসলামের বারোটা বাজিয়েছি, ইসলামকে প্রায় ধ্বংসই করে ফেলেছি, এখন তাদের সবার দায়িত্ব ইসলামের যেটুকু অবশিষ্ট আছে, সেটুকু বাঁচানো। মাদ্রাসা-মসজিদে এভাবেই আমার বিরুদ্ধে মগজ ধোলাই চলে। আমার সম্পর্কে না হয় তারা না জানলো, ইসলামকে পুঁজি করে মিটিং মিছিলের আয়োজন করতে গেলে ইসলাম সম্পর্কে তো সামান্য কিছু জানতে হয়। ধর্মতলার জনসভায় হায়দারাবাদ থেকে মৌলবাদীদের আমন্ত্রণ জানিয়ে আনা হয়েছে। সবাই মিলে মহাসমারোহে আমার মাথার দাম ঘোষণা করলো। দামটা কত জানতে চাইলো মৌলবাদী দর্শক শ্রোতা। মঞ্চ থেকে একজন নেতা বললো, পাঁচ লাখ। হায়দারাবাদের বড় নেতা সঙ্গে সঙ্গে পাঁচ লাখকে শুধরে দিয়ে বললো ‘আনলিমিটেড। মঞ্চের বাকিরা চেঁচিয়ে বললো। ‘আনলিমিটেড। শত শত টুপি মাথার লোক উল্লাসে উচ্ছাসে ফতোয়াকে স্বাগত জানালো। জনসভায় পুলিশের বড়কর্তারা উপস্থিত ছিলেন। তাঁদের সামনেই আমার মাথার দাম ঘোষণা হল। সব মৌলবাদীই বুক ফুলিয়ে ফতোয়া দিল, বুক ফুলিয়ে পুলিশের নাকের ডগায় হেঁটেও গেল। এই অবৈধ ফতোয়া জারিতে কারো বিন্দুমাত্র কোনো অসুবিধে হলো না। কী চমৎকার জীবনই না এরা যাপন করে ভারতবর্ষে।
হায়দারাবাদ থেকে কলকাতায় ফেরার পর দুটো ব্যাপার লক্ষ্য করলাম। কড়া নিরাপত্তার ব্যবস্থা আমার জন্য। দরজার কাছে বেশ কয়েকজন নতুন পুলিশ বসেছে। কেউ আমার সঙ্গে দেখা করতে এলে পুলিশের কাছে নাম ঠিকানা লিখে ঢুকতে হয় ভেতরে। দুনম্বর, আমাকে বাড়ি থেকে কোথাও বেরোতে দেওয়া হয় না। যেখানেই যেতে চাই, পুলিশ বলে দেয়, বড়বাবুর অনুমতি নিতে হবে। অনুমতির জন্য ওরা ছোটবাবুকে ফোন করে। ছোটবাবু করে বড়বাবুকে। অনুমতি মেলে না। বেশ কিছুদিন এরকম হবার পর আমি বুঝে নিলাম, আমাকে গৃহবন্দি করা হয়েছে। বাড়িতে বন্ধুরা আসছে বটে, কিন্তু কোথাও আমার বেরোনো নিষেধ। বাজারে যাবো, না যেতে দেওয়া হবে না। বন্ধুর বাড়ি, না। অসুস্থ বন্ধুকে দেখতে, না কোথাও না। এরকম গৃহবন্দি জীবন আগে কাটাইনি। ভেবেছিলাম, কিছুদিন পর বোধহয় অবস্থা স্বাভাবিক হয়ে আসবে। কিন্তু তার কোনও লক্ষণ দেখি না। এদিকে তাইওয়ান থেকে আমাকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। আমি তাইওয়ান যাবো। সুতরাং ট্রাভেল এজেন্সিতে আমাকে যেতে হবে। বড়বাবু এবার যেতে দেবেন। অবশ্য তাইপেই-এ কবিতা উৎসবে যাওয়ার জন্য কোনো ট্রাভেল এজেন্সিতে যাওয়ার কোনো প্রয়োজন ছিল না আমার। ইলেকট্রনিক টিকিট ইমেইল করে দিলেই হয়। শুধু শহরটা দেখার জন্য, বাইরের হাওয়াটা নেওয়ার জন্য ফুসফুসে, স্বাধীনতার স্বাদটা নেওয়ার জন্য অন্তরে, আমার বের হতে চাওয়া। স্বাধীনতা কাকে বলে আমি জানি। স্বাধীনতার রূপ রস গন্ধ আমি চিনি। স্বাধীনতা ফিরে পেতে আমার প্রতি বিন্দু রক্ত টগবগ করে, ফুঁসে ওঠে, ফুলে ওঠে। সমুদ্রে বাঁধ দিয়ে দেখুক কেউ, কী হয়। ঘরের বাইরে কোথাও যেতে না দেওয়া, শুধু ট্রাভেল এজেন্সিতে যেতে দেওয়ার অর্থ আমি টের পাই, শুধু দেশের বাইরে বেরোনোর অনুমতি পেতে পারি, দেশের ভেতরে আমার চলাফেরা নিষিদ্ধ।