মৃত্যু থেকে উঠে আসা আমি। পুনরুত্থিত আমি। দ্বিতীয় জীবন আমি।
০৩. গৃহবন্দি
ইসলাম সম্পর্কে একটি শব্দ উচ্চারণ না করেও হায়দারাবাদে আমাকে মৌলবাদীদের আচমকা আক্রমণের রাজনীতির শিকার হতে হয়েছে। আমাকে আক্রমণের পিছনে, যা শুনলাম, ছিল এলাকায় জনপ্রিয় হওয়ার বাসনা। হামলা চালিয়েছিল হায়দারাবাদের মজলিস ইত্তেহাদুল মুসলিমিন নামের এক রাজনৈতিক দল। অন্ধ্র প্রদেশের বিধানসভায় এই দলের এক বড় নেতা বলেছেন, ‘ধর্মদ্রোহী কথাবার্তা যারা বলে, তাদের কোতল করাই উচিত।‘ প্রেসক্লাবে গতকালের হামলার পূর্ণ সমর্থন জানিয়ে তাঁর বক্তব্য, আমাদের বিধায়করা যা করেছেন, তার জন্য মুসলিমরা গর্বিত। তাঁদের সাধুবাদ পাওয়া উচিত। মোহম্মদের প্রতি কোনও অসম্মান আমরা বরদাস্ত করবো না।
অন্য একটি ইসলামি গোষ্ঠী উঠে এসেছে। মজলিস বাঁচাও তেহেরিক। এই গোষ্ঠী বলছে, আমাকে নাকি মেরে ফেলারই পরিকল্পনা করা হয়েছিল, এমআইএম (মজলিস ইত্তেহাদুল মুসলিমিন) বরং আমাকে প্রাণে বাঁচিয়ে দিয়েছে। এমআইএমের তিন বিধায়ককে পুলিশ গ্রেফতার করেছিল, জামিনে ওরা ছাড়াও পেয়ে গেছে। দলের নেতা সাফ সাফ জানিয়ে দিয়েছেন, নির্ভুল উচ্চারণে নির্মেদ ভাষায় ঘোষণা করে দিয়েছেন, হায়দারাবাদে ফের যদি যাই কখনও, আমাকে মেরে ফেলা হবে। হ্যাঁ, আমাকে মেরে ফেলবেন ওঁরা। কী কারণ এসবের? এই প্রশ্নের উত্তর চারদিক থেকে যা পাই তা হল, পুরসভা নির্বাচনের আগে ইসলামি গোষ্ঠীগুলো নিজেদের গুরুত্ব বাড়িয়ে নিতে চাইছে। আমাকে যারা আক্রমণ করবে, আঘাত করবে, তারা ইসলামকে বাঁচাবে। ইসলামকে যারা বাঁচাতে পারবে, তাদেরই মুসলমানরা চোখ বুজে সমর্থন করবে, ভোট দেবে। তসলিমা নামের এক মেয়ে ইসলামকে ধ্বংস করে ফেলছে, সুতরাং তসলিমার হাত থেকেইসলামকে বাঁচাতে হলে ওকে মেরে ফেলতে হবে, ওকে মারলে এপারে ফতোয়ার অগাধ টাকা পাওয়া যাবে, ওপারে বেহেস্তলাভ হবে। ধর্মনিরপেক্ষ ভারতে আজ মুসলিম মৌলবাদীরা ঠিক এভাবেই দরিদ্র অশিক্ষিত অজ্ঞান মুসলমানদের উস্কানি দিচ্ছে এবং তাদের ভোটও ছলে বলে কৌশলে বাগিয়ে নেওয়ার ব্যবস্থাও পাকা করছে। দেশের প্রায় পঁচিশ ভাগ লোক মুসলমান, এবং মৌলবাদীরা এই বিশাল সম্প্রদায়ের প্রতিনিধি। কোনো সুসভ্য, সুশিক্ষিত সেকুলার, যুক্তিবাদী বিজ্ঞানমনস্ক লোককে এই সম্প্রদায়ের প্রতিনিধি ভাবা হয় না। এর চেয়ে বড় দুঃখ আর কী আছে!
সংসদে আমার প্রসঙ্গ ওঠে, ঘটনার নিন্দা করা হয়। টিভিতে আলোচনার আসর বসে। বাক স্বাধীনতা নিয়ে তর্ক তুঙ্গে ওঠে। হায়দারাবাদের মৌলবাদীরাও সেই আসরে বসে রীতিমত বাক স্বাধীনতা নিয়ে নিজেদের মত প্রকাশ করে। আমি ইসলামের বিরুদ্ধে কথা বলেছি, মোহাম্মদকে অপমান করেছি, মুসলমানদের অনুভূতিতে আঘাত দিয়েছি, সুতরাং আমাকে মারা হয়েছে, মারটাকম হয়েছে, আরোমারা উচিত ছিল। কেবলবে, যে, সেদিনের আমার ভাষণে ইসলাম শব্দটিই ছিল না! ওদের মূল বক্তব্য, আমাকে ভারত থেকে তাড়িয়ে দিতে হবে। আমি বিদেশি, আমার কোনো অধিকার নেই এ দেশের মুসলমানের মনে আঘাত দেওয়ার। মনে মনে বলি, ‘বিদেশিদের অধিকার নেই, তবে কি তোমাদের মনে আঘাত দেওয়ার অধিকার দেশিদের আছে?’ সোজা কথা বললেই তো হয় যে ‘জগতের কারও অধিকার নেই মুসলমানের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেওয়ার’! বললেই তো হয়, যে, ‘আমরা বাক স্বাধীনতায়, মত প্রকাশের অধিকারে এক ফোঁটাও বিশ্বাস করি না!’
জীবনে অনেক দুর্ভোগ পোহাতে হয়েছে। অনেক যন্ত্রণা সয়েছি। কিন্তু মাঝে মাঝে যন্ত্রণার ওপর পরশ বুলিয়ে যায় কারও কিছু কথা। সকালবেলাতেই আনন্দবাজারের সম্পাদকীয়টি পড়ে মন ভালো হয়ে যায়।
‘স্বাধীনতার হীরকজয়ন্তি পূর্তির অব্যবহিত আগে তসলিমা নাসরিনের উপর ব্যক্তিগত আক্রমণের ঘটনা এ দেশের সাংস্কৃতিক অশক্ত, দুর্বল অবয়বটি আবার চিনাইয়া দিল। হায়দরাবাদের প্রেস ক্লাবে এই সুখ্যাত ও বিতর্কিত লেখকের উপর শারীরিক-মানসিক নিগ্রহের যে প্রয়াস দেখা গেল, তাহা এক কথায়, বর্বরতা। এমন একটি ঘটনার নেতৃত্ব দিলেন তিন বিধায়ক, ইহা প্রমাণ করে যে এ দেশের সাংস্কৃতিক অসহিষ্ণুতা কোনও প্রান্তিক বা বিক্ষিপ্ত ঘটনা নয়, মূলস্রোতের রাজনীতির উপর-পরতেও তাহা যথেষ্ট দৃশ্যমান। এবং এই অসহিষ্ণুতার প্রকাশ যথেষ্ট পরিকল্পিত ও সংগঠিত। তসলিমা নাসরিন তাঁহার বিতর্ক ফুলিঙ্গ-বিধৃত রচনার জন্য স্বদেশ এবং অন্যান্য দেশে মুসলিম মৌলবাদীদের আক্রমণের মুখে পড়িয়াছেন, কিন্তু দুনিয়ার অন্যতম বৃহৎ গণতন্ত্র ধর্মনিরপেক্ষ, বহু-সংস্কৃতিবাদী ভারতবর্ষে তাঁহার এই অভিজ্ঞতার স্বাদ নিশ্চয় অনেকাংশে আলাদা। তিনিও নিশ্চয় এখন এ দেশের মধ্যে বিভিন্ন স্থানে স্বাধীন যাতায়াতের আগে পুনর্বিবেচনা করিবেন, হয়তো এখন হইতে অতিরিক্ত নিরাপত্তার ঘেরাটোপে আশ্রয় লইয়া গণতন্ত্রের আওতা হইতে খানিক দূরত্বে বসবাস করিবেন। দুর্ভাগ্য এই আত্মগর্বিত দেশেরও –-ব্যক্তিগত মতামত ও সামাজিক সহিষ্ণুতার ভিতরে সীমারেখাঁটি কী ও কেমন, ষাট বৎসরের স্বাধীনতা ও গণতন্ত্র যাহাকে শিখাইয়া উঠিতে পারে নাই।
সমস্যার মূলটি এইখানেই। এই দুর্ভাগ্যজনক ঘটনার তীব্র সমালোচনা সর্বত্র, এমনকী রাজনৈতিক দলগুলিও প্রতিবাদ জানাইয়াছে।