হঠাৎ পুলিশ এলো। ওই ভাঙা দরজার বাঁধ ভেঙে পুলিশ ঢুকলো, হত্যাকারী ঢোকার আগে। আমার নিচ্ছিদ্র নিরাপত্তার ব্যবস্থা ওরাই করলো। দেয়ালে সেঁটে থাকা আমার পাথর শরীর অথবা অস্থির শরীর ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হল, মুষ্ঠি আলগা হল হাতের। শুনলাম মৌলবাদীদের ভোলা হচ্ছে পুলিশের ট্রাকে। তারপর আমাকেও নিরাপত্তার শক্ত বেষ্টনীতে নিয়ে পুলিশের গাড়িতে তোলা হল, দ্রুত আড়াল করা হল। শুভাকাঙ্খীরা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন।
এর মধ্যে মৃত্যুর মুখটি তো আমার দেখা হয়ে গেছে। ওরা যখন হত্যা করে, ওভাবেই করে। সব তছনছ করে। জানিয়ে শুনিয়ে দেখিয়ে। পয়গম্বরের নাম নিতে নিতে। পতাকা ওড়াতে ওড়াতে। আজ আমার অলৌকিক বেঁচে যাওয়া। জীবন আর মৃত্যুর ব্যবধান ছিল এক সুতোর। আমার আশংকা মৃত্যু আমার ওভাবেই হবে কোনও একদিন। কোথাও যখন আমি কবিতা পড়ছি, কোথাও যখন আমি মানবতার কথা বলছি, অতর্কিতে কেউ আমার হৎপিন্ড ফুটো করবে।
কী দোষ করেছি আমি? ধর্মান্ধতা, কুসংস্কার, নির্যাতন, আর নিষ্পেষণের বিরুদ্ধে কথা বলা কি অন্যায়? মানবাধিকার আর মানববাদের পক্ষে দাঁড়ানো কি অন্যায়? ঘৃণার আগুনে আমাকে যে করেই হোক তারা পুড়িয়ে মারবে। কেন, কার কী ক্ষতি আমি করেছি?
আমাকে জীবন দিয়েছে মানুষের ভালোবাসা। শুধু ভারতবর্ষ থেকেই নয়, ভারতবর্ষের বাইরে থেকেও পেয়ে যাচ্ছি যুক্তিবাদী, মুক্তবুদ্ধি আর শুভবুদ্ধির মানুষের সমর্থন। চোখে আমার জল এসেছে মৌলবাদীদের আক্রোশ আর তাদের বিষ দাঁত দেখে নয়। যখন বিধ্বস্ত আমি, যখন মৃত্যুর গুহা থেকে আমাকে বাঁচিয়ে আনা হল, যখন শুনছিলাম কারও উদ্বিগ্ন কণ্ঠ, ‘ভালো আছো তো? বা আমি তোমার সঙ্গে আছি, বা আমরা তোমার পাশে আছি, তখন এসেছে চোখে জল।
আমার আর একা লাগে না। জানি আমরা সংখ্যায় বেশি, আমরা, যারা গণতন্ত্রে আর মত প্রকাশের অধিকারে বিশ্বাস করি। আর তারা চিরকালই সংখ্যায় কম, যারা বাক স্বাধীনতা বিরোধী, মানবতাবিরোধী, অসহিষ্ণু, মৌলবাদী। যুদ্ধ কি আমার একার সঙ্গে তাদের? যুদ্ধ তো আমাদের সবার সঙ্গে তাদের! একটি সুস্থ সমাজ গড়ার জন্য, একটি সুন্দর দেশ গড়ার জন্য, একটি বাসযোগ্য জগৎ গড়ার জন্য আমরা ওই ভয়ংকর অথচ ক্ষুদ্র শক্তির বিরুদ্ধে আপোসহীন ভাবে লড়তে পারি। আমরা সবাই। পারি না?
আমার ভাবনাগুলোকে থামিয়ে দিয়ে গাড়ি সশব্দে থামে খোদ পুলিশ হেডকোয়ার্টারে। প্রকৃতির কাছে তখন আমার প্রার্থনা শুরু হয়, যেন হিন্দু বেষ্টিত হয়ে থাকি, যেন কোনও মুসলমান পুলিশের মুখোমুখি না হই। দোতলায় উঠিয়ে পুলিশের বড় বড় লোকদের সঙ্গে পরিচয় করানো হচ্ছে। ধর্ম বড় ভয়ংকর। বড়কর্তাদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেওয়া হলে আড়চোখে বুকে লাগানো নামখানা পড়ে নিশ্চিন্ত হয়ে নিই। পুলিশের সবাই খুব অমায়িক আর আন্তরিক। আক্রমণকারী মৌলবাদীদের সবাইকেই চেনেন পুলিশের লোকেরা। ঘরের টিভিতে প্রেসক্লাবের কুৎসিত আক্রমণের ঘটনাই দেখানো হচ্ছে। থেকে থেকে বড়কর্তা মন্তব্য করছেন। আমাকে দিয়ে ওদের বিরুদ্ধে দুটো অভিযোগপত্র লিখিয়ে নিয়ে আমাকেও বলছেন, ‘সব কটাকে হাজতে নেওয়া হচ্ছে, একটুও ভাববেন না। আমার আর ভাবনার কী! আমি তো শহর ছেড়ে চলেই যাচ্ছি। এ শহরে কখনও আর আসা হবে বলেও মনে হয় না।
সন্ধ্যেয় ফেরার কথা ছিল কলকাতায়, এয়ারলাইনসে ফোন করে সময়টা এগিয়ে আনলেন বড়কর্তা। বিকেলে আমাকে বিমানবন্দরে নিয়ে গেলেন পুলিশ কর্তারা। কোনও সাংবাদিকের জানার কথা নয় আমি কখন বিমান বন্দরে পৌঁছোবো। তারপরও সাংবাদিকের ভিড়। সম্ভবত সারাদিন বসে থেকে অপেক্ষা করারই উদ্দেশ্য ওদের। স্পষ্ট জানিয়ে দিলাম, সাক্ষাৎকার দেব না। কিন্তু কেউই বন্দর থেকে সরে যায় না। ভিড় করেই থাকে। কলকাতায় পৌঁছেও ওই একই অবস্থা দেখি। বন্দর ছেয়ে আছে সাংবাদিকে। কী করে লোক জানলো কখন আসছি আমি, কে জানে! বাড়িতে দেখি আঙিনা ভরে আছে। টিভি ক্যামেরায়, সাংবাদিকে। কাউকে বাড়িতে ঢুকতে দিইনি। কারও সঙ্গেই কথা বলিনি। ঘটনা যা ঘটেছে, তার প্রতিবাদ অন্যরা করুক। আমাকে করতে হবে কেন প্রতিবাদ! সেই কতকাল থেকে লড়ছি মত প্রকাশের স্বাধীনতার পক্ষে। আমার মলিন মুখখানাই, আমার সন্ত্রস্ত দেহখানাই টিভিতে দেখিয়ে বলতে হবে কেন যে আমি মত প্রকাশের স্বাধীনতা চাই। মানুষ মুখ খুলুক। সারা দেশ দেখেছে কী ঘটেছে। নিজের ওপর হামলার ঘটনা নিজে আর কত বর্ণনা করবো। যথেষ্ট কি হয়নি। আমার কি ক্লান্তি বলতে কিছু নেই! আমার কি রাগ হওয়া উচিত নয়। আমি কি লেখক হয়েছি লেখার জন্য নাকি লেখার অধিকারের জন্য লড়াই করার জন্য। আর কত আমাকে মার খেতে হবে, অনুযোগ করতে হবে, তাড়া খেতে হবে, কাঁদতে হবে।
বাড়িতে উদ্বিগ্ন বন্ধুরা, আমার ফেরার অপেক্ষা করছিলো। ভেতরের অসহ্য আগুন বা শীতলতা আমাকে স্তব্ধ করে রাখছিলো। সবাই জানতে চাইছিল কী ঘটেছে, কেন ঘটেছে, আদ্যোপান্ত। কাউকেই আমার কিছু বলতে ইচ্ছে করছিল না। শুধু বেড়ালটাকে খুঁজছিলাম। ফোন বেজে চলেছে। কারও সঙ্গে কথা বলতে ইচ্ছে করেনি। শুধু বেড়ালটাকে কোলে নিয়ে আদর করতে ইচ্ছে করেছে। চাইছিলাম বন্ধুরা সবাই বাড়ি থেকে চলে যাক। আমাকে একা থাকতে দিক। আমার ঘুম পেয়েছিলো। খুব ঘুম। যেন হাজার বছর ঘুমোইনি। কিন্তু ঘুমোতে কি পেরেছি! বারবারই সেই মুখগুলো ভাসছিল চোখের সামনে, আততায়ীদের ভয়ংকর ক্রুদ্ধ মুখ, হিংস্র শরীর। মৃত্যু একেবারে দু’হাত দূরে এসে দাঁড়ালে মানুষের ঠিক যেমন লাগে, আমারও তেমন লেগেছিলো। আমাকে মেরে ফেলার উদ্দেশ্য হয়তো ওদের ছিল না। কিন্তু সেসময় তো আমার জানা ছিল না ওরা বিধায়ক, দলের জনপ্রিয়তা কমে গেছে বলে এসেছিলো আমাকে আক্রমণ করে এলাকায় নিজেদের জনপ্রিয়তা বাড়াতে। আমি তো ভেবেছিলাম ধর্মান্ধ ফতোয়াবাজ মৌলবাদী গোষ্ঠী এতদিনে আমাকে হাতের কাছে পেয়েছে। নিরাপত্তাহীন, নিরস্ত্র আমাকে হত্যা করে বেহেসতে যাবার এমন মোক্ষম সুযোগ ওরা হাতছাড়া করবে না। অনেক ছোটখাটো মৃত্যুর ফাঁদ থেকে বেঁচে বেরিয়েছি। এবার আর কোনও উপায় নেই। ওদের থাবা থেকে আমার বাঁচার এবার আর উপায় নেই। প্রাণে আমাকে মারেনি। পারেনি বলবো না। ইচ্ছে করলেই পারতো। ইচ্ছে না করলেও ক্রোধ মানুষকে এমন অমানুষ করে ফেলে যে মেরে ফেলা তখন খুব কঠিন হয় না। তখন বরং মারাটাই কঠিন হয়ে দাঁড়ায়।