অনুষ্ঠান শেষে বেরোবো দুপুরের খাবার খেতে, তখনই ঘটনাটি ঘটে। প্রেস ক্লাবের সামনের দরজা দিয়ে কিছু লোক ভিতরে ঢুকে তেলুগু ভাষায় চিৎকার করতে করতে আমার দিকে এগোতে থাকে। চিৎকার করে কী বলছে তা বোঝার সাধ্য আমার নেই। আমার দিকেই বা এগোচ্ছে কেন, তাও জানি না। হঠাৎ দেখি, হাতের কাছে যা পাচ্ছে, ফুলের তোড়া, বই, ব্যাগ, চেয়ার–সব ছুঁড়ে ছুঁড়ে মারছে আমাকে লক্ষ্য করে। ঠেকাতে গিয়ে ক’জন আহত হলেন। সাংবাদিকরা ব্যস্ত ক্যামেরায় ছবি তুলতে। আমি ওদের পেছনে নিজেকে আড়াল করার ব্যর্থ চেষ্টা করছি। আমার গায়ে কী এসে লাগল, নিয়ে ভাবছিলাম না। ভাবছিলাম, ক্রমশ এগিয়ে আসতে থাকা মৃত্যু থেকে কী করে বাঁচবো আমি। কেউ একজন আমাকে টেনে পেছনের দরজার কাছে নিয়ে গেল, ক্লাবঘর থেকে আমাকে বের করে নেবে, গাড়িতে ওঠাবে। আক্রমণকারীরা তখন পেছনের দরজার দিকে দৌড়ে আসছে। বুঝে যাই, গাড়িতে ওঠা আমার পক্ষে সম্ভব হবে না। পেছনের দরজাটি আমি দ্রুত বন্ধ করে দিলাম। সঙ্গে সঙ্গে জোরে লাথি মেরে দরজার কাঁচ ভেঙে ফেললো ওরা। কী করে বাঁচবো, এই ভাবনা মাথায়, অন্য সব ভাবনার লেশমাত্র কিছু নেই কোথাও। দৌড়ে যাই সামনের দরজায়। না, ওদিক দিয়েও বেরোনোর কোনও উপায় নেই। প্রেস ক্লাব ঘিরে ফেলেছে আক্রমণকারীরা। সামনের দরজাও ভেতর থেকে বন্ধ করে দেওয়া হল। ক্লাব ঘরটার ভেতর আমি আর কিছু নিরীহ নারী। দু’একজন পুরুষও সম্ভবত ছিলেন। ওঁরা ভাঙা দরজার সামনে চেয়ার ফেলে উঁচু বাঁধ তৈরি করে দাঁড়িয়ে থাকলেন। আমাকে বললেন থামের আড়ালে লুকোতে। কেউ বললেন টেবিলের তলায় ঢুকে যেতে। কিন্তু ফাঁকা ঘরটার মধ্যে যেখানেই লুকোই আমি, বাঁধ ভেঙে ঢুকে পড়লে আমাকে হাতের মুঠোয় পেয়েই যাবে ওরা। বাইরে বিকট শব্দে তখন জানি না ক’জন লোকের স্লোগান চলছে, ‘ নাসরিন মুর্দাবাদ’। স্লোগান ছাড়াও অন্য চিৎকারের শব্দ। এমন সময় মঞ্চের নীল পর্দার পেছনে যে একটি গোপন দরজা ছিল, শুনি সেটি খোলার চেষ্টা চলছে বাইরে থেকে। দরজা ভেঙে ঢুকে পড়লে থামের আড়ালে দাঁড়িয়ে থাকা আমাকে পেয়ে যাবে চোখের সামনে। আবার থামের আড়াল থেকে অন্য আড়ালে দাঁড়ালে বাঁধ দেওয়া দরজা ভেঙে ঠিকই খপ করে ধরে ফেলবে আমাকে। বাঁধের দরজা ভাঙতে বাইরে থেকে বাধা দিচ্ছিলেন সাংবাদিকরা। নিজেরা আহত হয়েও ঠেকাতে চাইছিলেন ওই ভয়ংকর মারমুখো লোকদের। ছবি তোলা বাদ দিয়ে অনেকে তখন আমাকে বাঁচানোর চেষ্টা করছিলেন। মৃত্যু যে কোনও মুহূর্তে আমার খুব কাছে এসে দাঁড়াবে। মুহূর্তগুলো আমার বুকের ভেতর ঢং ঢং করে বাজছিল। যে কোনও সময় শেষ মুহূর্তের ঘণ্টা বাজবে। অসহায় আমি ঘরটির মধ্যে এক আড়াল থেকে আরেক আড়ালে যাচ্ছি। শখ করে পরা গলার মঙ্গলসূত্ৰ কখন ছিঁড়ে পড়ে গেছে, খেয়াল করিনি। কেউ জানে না, কী করে বাঁচানো যাবে আমাকে। দরজার বাঁধের কাছে দাঁড়িয়ে বাইরের ভীষণ, বিকট আওয়াজের দিকে ভয়ার্ত চোখে তাকিয়ে আছেন ঘরের কয়েকজন। যে কোনও মুহূর্তে ধাক্কা খেয়ে ওঁরা উল্টে পড়বেন। বাইরের চিৎকার আর স্লোগানের তীব্রতা বেড়েই চলেছে। বুকের ভেতরে ঢং ঢং ঘণ্টা বেজেই চলেছে। অনুরোধ করে যাচ্ছি কেউ যেন একবার পুলিশে খবর দেয়। কিন্তু কে দেবে? সকলেই উদভ্রান্ত। এমন ঘটনা কোনোদিন তাঁরা চোখের সামনে ঘটতে দেখেননি। ছুটোছুটি। কারও কারও আর্ত চিৎকার। যখন প্রাণে মারা হবে আমাকে, কিছু বুলেট ছিটকে গিয়ে বা ছুরির কোনো অংশ বেকায়দায় ওদের পেটে পিঠে লেগে গিয়ে ওঁরা আবার আহত হন কি না, এ নিয়ে কী ওঁরা দুশ্চিন্তাগ্রস্ত। কে জানে। প্রথম দিকে কিংকর্তব্যবিমূঢ়ের মতো দৃশ্যগুলো দেখতে থাকলেও বিস্ফোরণের আশংকা করে আয়োজক এবং দর্শকের মধ্য থেকেও অনেকে পালিয়ে যাচ্ছেন। আমি একা পড়ে যাচ্ছি। ক্রমশ দেয়ালের দিকে যাচ্ছি। আর কোনও আড়াল নেই সামনে। আমার মনে হতে থাকে ডানদিকের দরজা ভাঙা প্রায় বুঝি সারা, মনে হতে থাকে বাঁ দিকের দরজায় বাঁধের কাছাকাছি এগিয়ে আসছে হত্যাকারীরা। কয়েকটা লাথি, কয়েকটা ধাক্কা, তাহলেই উল্টে পড়বে উঁচু করে রাখা চেয়ারগুলো। পা পা করে এগিয়ে আসতে থাকা মৃত্যুর পায়ের আওয়াজ পাচ্ছি আমি। আর অস্থির হয়ে অপেক্ষা করছি পুলিশের আওয়াজ পেতে। না, পুলিশ ত্রিভুবনে নেই। কেউ জানে না কী ঘটছে হায়দারাবাদের প্রেসক্লাবে। আমার যে চোখ ফেটে জল আসবে তাও আসছিল না। শরীর শিথিল হয়ে মেঝেয় লুটিয়ে পড়বে, তাও পড়ছিল না। হত্যাকারীদের সঙ্গে যদি পিস্তল থাকে। গুলি ছুড়বে। যদি ছুরি থাকে, কুপিয়ে মারবে। আর, কিছু যদি না থাকে, মাথায় আঘাত করবে লোহার চেয়ারগুলো দিয়ে। নয়তো পিষে মারবে পায়ের তলায়। এরা তো অনেকজন। আমি একা। ক্রমশ একা হচ্ছিলাম। ঢং ঢং শব্দ আরও বিকট স্বরে বাজছিল। আমি তো জানি এরাই ফতোয়া দেয় আমার বিরুদ্ধে। এরাই মাথার দাম ঘোষণা করে, এরাই চিৎকার করে মুন্ডু চায়, এরাই ফাঁসির দাবিতে পথে নামে, এরাই ক’দিন পরপর আমার কুশপুত্তলিকা পোড়ায়, বই পোড়ায়। এর আগে কোনোদিনই এরা এতটা হাতের কাছে আমাকে পায়নি। এরা এখন যা ইচ্ছে তাই করতে পারে আমাকে। যে কোনও মুহূর্তেই এখন আমি দেখতে পাবো জীবনের শেষ মুহূর্তকে। মৃত্যু ঠিক কী রকম। খুব কষ্ট হবে কী! এরা কি বুকে বা মাথায় গুলি করবে, নাকি কেটে কেটে কষ্ট দিয়ে দিয়ে ধর্ষণ করে করে পিষে পিষে মারবে।