দৈনিক স্টেটসম্যানে নিয়মিত কলাম লিখি। এক একটি কলাম হাজার বছরের সংস্কার ভেঙে নতুন সময়ের দিকে, নারী পুরুষের সমতার দিকে, একটি সুস্থ সুন্দর সমাজের স্বপ্ন দেখাতে দেখাতে হাত ধরে নিয়ে চলে। নিখিল সরকার নেই, তবে শিবনারায়ণ রায়, অম্লান দত্ত আর প্রশান্ত রায়-এর সঙ্গে হয় সাহিত্যিক সাংস্কৃতিক বৌদ্ধিক আলোচনা। একদিন ঘটা করে মরণোত্তর দেহদানও করে ফেলি। মরে গেলে কলকাতা মেডিক্যাল কলেজের ছাত্র ছাত্রীরা পড়বে শরীর। দুটো চোখ আর দুটো কিডনি চলে যাবে যাদের প্রয়োজন, তাদের কাছে। দেশের নানা রাজ্য থেকে আমন্ত্রণ এলে ঘুরে আসি, বইয়ের উদ্বোধন, নয়তো ভাষণ। যেখানেই যাই একদিকে ভক্তের ভিড়, আরেকদিকে মৌলবাদী বিক্ষোভ। কেরালা, মধ্যপ্রদেশ, বিহার, উড়িষ্যা, আসাম, মহারাষ্ট্র, দিল্লি। বাকি জীবন কলকাতায় থাকবো, এতে কোনো দ্বিধা নেই বলে একটা গাড়ি কিনে ফেলি একদিনের নোটিশে। বাড়িও কিনি, চমৎকার একটা দোতলা বাড়ি।
এক উঠতি কবির সঙ্গে বন্ধুত্ব গাঢ় হয়। এক ডাক্তারের সঙ্গেও অদ্ভুত একটাঅমীমাংসিত সম্পর্ক গড়াতে থাকে। এমন সময় সেই দিনটি আসে, কালো সেই দিনটি।
বাড়ি থেকে অনেকদিন বেরোই না। অনেকদিন একটানা বসে থেকে ভালোও লাগছিল না। ডক্টর ইনাইয়া বলছিলেন হায়দারাবাদে আমার ‘শোধ’ বইটা বেরোচ্ছে, তাঁর স্ত্রী অনুবাদ করেছেন, যেন যাই একবার ওখানে, বই উদ্বোধনের আনুষ্ঠানিকতায়। এর আগে দুবার তিনি আমাকে সম্বর্ধনা দেওয়া বা আমার বক্তৃতা শোনা ইত্যাদি অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছিলেন, যেতে রাজি হইনি। এবার রাজি হয়েছি। রাজি হওয়ার কারণ বোধহয় নতুন জায়গা, আমার একটু হাওয়া পাল্টানো, একটুখানি কলকাতার একঘেয়েমি কাটানো। সকালে গিয়ে বিকেলে ফিরবো, কোনও সুটকেস, কোনও টুথব্রাস, কোনও কাপড় চোপড় নেওয়ার প্রশ্ন ওঠে না। নীল শিফনের একটা শাড়ি পরে নিলাম। ইস্ত্রিও করা নেই। দলামোচা হলেও খুব একটা বোঝা যায় না। আর গেলেই বা কী! কাপড় চোপড় নিয়ে মাথা আমি ঘামাই না। সাজগোজ নিয়েও না। একসময় তো লিপস্টিক পরাও বাদ দিয়েছিলাম। এখন চুলটা এলোমেলো হলে একটুখানি আঁচড়াই আর ঠোঁটে হালকা লিপস্টিক পরি, এতে শুকিয়ে চড়চড় হওয়া থেকে ঠোঁটের বাঁচা হয়।
হায়দারাবাদ বিমান বন্দরে নেমে ডক্টর ইনাইয়াকে একা দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে আমি একটু অবাক হই। নিরাপত্তা-পুলিশ কোথায়! ভেবে নিই, পুলিশ অনুষ্ঠানে থাকবে, বিমান বন্দরে আসেনি। ঝকঝকে একখানা গাড়িতে আমাকে উঠিয়ে হোটেলে নিয়ে গেলেন ইনাইয়া। পাঁচতারা হোটেলের একটা ঘর তিনি ভাড়া নিয়েছেন অনুষ্ঠানের আগে আমার বিশ্রামের জন্য। ঘরটা সুন্দর। বিছানায় শুয়ে একটুখানি টেলিভিশন দেখি। উঠে চা বানিয়ে খাই। এরমধ্যেই ফোন। কী, নিচে নামতে হবে। অনুষ্ঠানে যাওয়ার সময় হয়ে গেছে। অনুষ্ঠান কোথায়, কী ধরনের অনুষ্ঠান, তার কিছু আমি জানি না। ইনাইয়াকে জিজ্ঞেস করলে কড়া অস্ত্রের উচ্চারণে তিনি ঠিক কী বলেন বা বলতে চান, তার বেশির ভাগই বুঝতে পারি না। জিজ্ঞেস করলাম, পুলিশ প্রোটেকশন রাখেন নি?
ইনাইয়া এর উত্তরে কী বললেন, আমার পক্ষে বোঝা সম্ভব হল না।
‘যে রাজ্যেই যাই, আমার জন্য তো নিরাপত্তা রক্ষীর ব্যবস্থা করা হয়। আপনি করেননি?’
এবার যা বললেন, তা খুব কান পেতে শুনে বোঝার চেষ্টা করে যেটুকু উদ্ধার করতে পারলাম, তা হলো–‘করিনি.. হে হে। ছোটখাটো অনুষ্ঠান। তেমন প্রচার হয়নি। খামোক পুলিশের ঝামেলা করার দরকার কী!’
‘ও। আসলে ঝামেলা করতে নয়, পুলিশ প্রোটেকশন বরং ঝামেলা এড়াতেই রাখতে হয়।‘
‘হে হে।‘
আমি জানিনা ইনাইয়াকে কেন স্মরণ করিয়ে দিলাম না যে এই হায়দারাবাদে আমি গত দু’দুবার আমন্ত্রণ পেয়েও আসা বাতিল করেছি, তার একমাত্র কারণ এ শহরকে আমি নিরাপদ বলে ভাবিনি। কারণ মুসলমানরা এ শহরে আমার বিরুদ্ধে এর আগে কিছু হৈ চৈ করেছে, কাগজে পড়েছি বইয়ের দোকান ভাংচুর করেছে আমার লজ্জা বিক্রি করছিলো বলে। আমার ভুলো মন। ভুলেই হয়তো গিয়েছিলাম এ শহরে মুসলমানের সংখ্যা অন্য অনেক শহরের তুলনায় বেশি। মুসলমানের সংখ্যা বেশি হলেই মুসলমান মৌলবাদীর সংখ্যা বেশি হওয়ার আশংকা থাকে। মৌলবাদীরা আমাকে বহুবছর ইসলাম-বিরোধী খেতাব দিয়ে বসে আছে। সব মোছা যায়, এই খেতাব মোছা যায় না। আমার নাস্তিকতা, আমার মানববাদ, আমার বিজ্ঞানমনস্কতা, আমার মানবতা কিছুই মানুষের মস্তিষ্কে গভীর করে গেঁথে যাওয়া ‘আমি ইসলাম-বিরোধী এই বিশ্বাসের কাঁটাটি উপড়ে ফেলতে পারেনি।
অনুষ্ঠান হায়দারাবাদের প্রেসক্লাবে। উদ্বোধন হলোবইয়ের। আমার ‘শোধ’ উপন্যাসের তেলুগু অনুবাদ। একজন তেলুগু লেখক এবং একজন অনুবাদক নিজেদের লেখা এবং অনুবাদ সম্পর্কে নিজেদের অভিজ্ঞতার কথা বললেন। আমি বললাম মানবাধিকার বিষয়ে। ‘শোধ’ নারীবাদী বই। শোধের প্রধান চরিত্র ঝুমুর নিজেকে পুরুষের সম্পত্তি হতে দেয়নি, প্রতিবাদ করেছে। নারী যে পুরুষের বা সমাজের সম্পত্তি নয়, এ কথাই চিরাচরিত কোমল কণ্ঠে বললাম। আমার কণ্ঠস্বর কিছুতেই ‘মিছিলের ভেঙে দাও গুঁড়িয়ে দাও’ বলা মেয়েদের মতো হয়ে ওঠে না। শান্ত, শিষ্ট, নম্র, নরমই রয়ে যায় যতই ক্রুদ্ধই হই না কেন, যত কঠিন কথাই বলি না কেন!