সুইডেনের ভারতীয় দূতাবাসে আমার লেখা পছন্দ করেন এমন একজন হৃদয়বান মানুষ ছিলেন, কেন ছিলেন কে জানে! ভিসা করতে গেলে দিব্যি আমাকে ‘এক্স ভিসা দিয়ে দিলেন, যেটির, পরে জেনেছি, মেয়াদ ছমাস অন্তর অন্তর বাড়িয়ে অনন্ত কাল ভারতে থাকা যায়। এখন থেকে আর পর্যটক নই, রীতিমত বাসিন্দা আমি। কত শত স্বপ্ন মনের উঠোনে এক্কা দোক্কা খেলে, হঠাৎ যে কখন কোন্ ঘরটা কেনা হয়ে যায়, কোন্ স্বপ্নটা পূরণ হয়ে যায় নিজের অজান্তেই।
এক সকালে কলকাতা বিমান বন্দরে নেমেই কোনো একটা নম্বরে ফোন করে বাড়ি ভাড়া নেব, এক্ষুণি এই মুহূর্তে বললে ওপারের অচেনা এক কণ্ঠস্বর থেকে এক থোকা বিস্ময় ঝরে পড়ে। এভাবে বাড়ির কিছুই না দেখে বাড়ি ভাড়া কেউ নিয়েছে বলে তার জানা নেই। ধুলোধূসরিত খালি বাড়িতে খালি হাতে উঠে তোশক বালিশ খাট সোফা বাসন কিনে নিয়ে আসি, হ্যাঁ সেই সকালেই, সেদিনই। কোথায় বাড়ি ভাড়া পাওয়া যাবে, কোথায় আসবাব পত্র, কোথায় চাল ডাল, সে ধারণা দেওয়ারও অবশ্য লোক ছিল না। প্রশ্ন করলে, যারা ঘিরে থাকে, আমি নামী বলে, বা আমি আমি বলে সবাই অপ্রস্তুত হয়, উত্তর নেই, অথবা ভুল উত্তর। সংসার ওই ভুল দিয়েই শুরু হয় আমার। আমার কলকাতার সংসার।
দু’দিনেই বাড়ি বাসযোগ্য করে ফেলি। চারদিনে সাজানো। সাতদিনে ঝলমলে। ছ’মাসে মনে হয় তিরিশ বছরের সংসার। বারান্দায় শৈশবের সব ফুল। নানা রঙের ফুল ফুটে সুবাস ছড়াতে থাকে বাড়িময়। রাতে হাসনুহেনার গন্ধে বাড়ি ভেসে যায়। প্রায়ই একটি হাসনুহেনার টব শিয়রের কাছে এনে রাখি। ঘ্রাণ শুকতে শুকতে শৈশবে যেমন ঘুমোতাম, তেমন ঘুমোই। শহরের মধ্যিখানে চমৎকার বাড়ি। নিরাপদ বাড়ি। ঠিক রাস্তার ওপরে নয়। দুদুটো লোহার ফটক পেরিয়ে, দারোয়ান পেরিয়ে তবে ভেতরে ঢুকতে হয়। খোলা বারান্দা। মশলার সুগন্ধ ভেসে আসে রান্নাঘর থেকে, বারান্দায় অল্প অল্প উড়তে থাকে শুকোতে দেওয়া কাপড়। কী আশ্চর্য সুন্দর এই দৃশ্য! কতকাল আমি আমার শৈশব কৈশোরকে এত কাছ থেকে দেখি না। আলোয়, হাওয়ায় বাড়িটি সত্যিকার বাড়ি হয়ে ওঠে। আমার সাত নম্বর রাওডন স্ট্রিটের বাড়ি।
শহর আগের মতোই, তবে দীর্ঘদিনের বন্ধুটি নেই শহরে। যে বন্ধু সুসময়ে দুঃসময়ে ঠিক একই রকম পাশে থাকতেন, যাঁর সঙ্গে যে কোনো বিষয়ে যে কোনো সময় কথা বলা যেত, সেই নিখিল সরকার, নেই। সেই অথৈ সমুদ্র, সেই নিমগ্ন সাধক, সেই জ্ঞানের ভাণ্ডার নেই। জগৎ আমার, টের পাই, ঠিক বুঝে ওঠার আগেই কী রকম খালি হয়ে যাচ্ছে। মাও নেই, বাবাও নেই, নিখিল সরকারও নেই। আত্মীয় স্বজন থেকেও নেই, চেনা পরিচিত লোকদের বন্ধু বলে ডাকি। ঘন ঘন দেখা করতে আসা ভক্তদেরও বন্ধু বলি। তাড়াহুড়ো করে একটা তাসের ঘরের মতো কিছু গড়ে তুলছি কি! মাঝে মাঝে সবকিছুকে অদ্ভুত এক মায়া, রহস্যের জালের মতো মায়াবি এক জাল অথবা জীবন নিয়ে নিতান্তই বালখিল্য রসিকতা বলে মনে হয়।
রাওডন স্ট্রিটের বাড়ির দুয়ার সবার জন্য খোলা। সবার জন্য, এমন কী অচেনা মানুষের জন্যও আপ্যায়নের অন্ত নেই। আতিথেয়তা আমার অন্তরে। কত ঠিক-মানুষ, কত বেঠিক মানুষ, কত ভুল, কত ধূর্ত আমার ঘরের চৌকাঠ পেরিয়েছে। কাউকেই বেঠিক বা ভুল ভাবতে আমার ইচ্ছে করেনি। আজও করে না। এরকমই আমি। এরকমই সাদাসিধে আর নিরীহ। ঘরের পোশাকে আর হাওয়াই চপ্পলে হেঁটে হেঁটে দিব্যি ঘুরে বেড়াই শহর। ফুটপাত থেকে সস্তা জিনিস পত্তর কিনি। গড়িয়াহাটের বাজার থেকে বেড়ালছানা তুলে এনে আদরে আহ্লাদে বড় করি। সাদামাটা ধুলোবালির জীবন। আবার এই জীবনই মুহূর্তে ঝলমলে হয়ে উঠতে পারে। বই মেলায় স্টলের দরজা বন্ধ করে রাখতে হয় ভিড় ঠেকাতে। পুলিশের লাঠিচার্জের দরকার হয় ভক্তদের উন্মাদনা দূর করতে। তারপরও পাঠকদের সঙ্গেই সম্পর্ক গড়ে ওঠে। সাহিত্যজগতের মাতব্বরদের সঙ্গে ওঠা বসা নেই মোটেই। কাউকে দাক্ষিণ্য দেওয়া বা গুরু মানা আমার স্বভাবে নেই। সত্য কথা কোনও রাখঢাক না। করে বলে দেওয়া, মাতব্বরদের, শুনেছি, একেবারেই পছন্দ নয়। নিভৃতে আমি বাস করি আমার মতো। দেশি জীবনের বাইরেও আরেক জীবন আছে। পশ্চিমের দেশে যেতে হয় ঘন ঘন। অনুষ্ঠানে কবিতা পড়তে বা বক্তৃতা দিতে, বা পুরস্কার নিতে। কোনও না কোনও আমন্ত্রণ থাকেই। শুধু পশ্চিমের দেশেই ভালো ঘটনা ঘটছে, তা বলবো না। ভালো কিছু কলকাতাতেও ঘটে। ব্যাগ ফিল্মস আমার ‘ফরাসি প্রেমিক’-এর গল্প অবলম্বনে চলচ্চিত্র তৈরি করার জন্য চুক্তিপত্রে সই নিয়ে যায়, কণিমাইটের টাকাও দিয়ে যায়। খুব ঘটা করে আমার লেখা ভূমিকা সম্বলিত শত বছরের রবিবাসরীয় গল্পগুলোর নির্বাচিত একটি সংকলন বের হয় ‘আনন্দ’ পাবলিশার্স থেকে। ‘আনন্দ’ আমার লেখা বইগুলোর সমগ্র করার জন্যও উদ্যোগ নেয়। আমার ‘শোধ’ গল্পটি নিয়ে টেলিভিশনে এক মাসের একটি সিরিয়াল দেখানো হয়। অন্য সব সিরিয়ালের চেয়েও জনপ্রিয় হয় এটি। মেগা সিরিয়ালের গল্প লেখার জন্য আমন্ত্রণ জোটে। লিখতে থাকি মেগাসিরিয়ালের গল্প। গল্পের নাম দিই ‘দুঃসহবাস’। ওদিকে সুটিংও হতে থাকে। ‘ফেরা’ গল্প নিয়ে অনেকদিন হল নাটক হচ্ছে। বিভিন্ন মঞ্চে। গিরিশ মঞ্চে, মধুসূদন মঞ্চে, রবীন্দ্র সদনে সেই নাটক দেখি। তা ছাড়া বিভিন্ন গ্রুপ থিয়েটারের অসাধারণ সব নাটক দেখাও হয়। একবার নান্দীকার আয়োজন করলো নাট্যসপ্তাহের, সেইসব নাটক শেষ হলে রুদ্রপ্রসাদ সেনগুপ্ত আমাকে মঞ্চে ডাকতেন যেন বিজয়ী কলা কুশলীদের মাল্যদান করি। নিজেকে কলকাতার সাহিত্যিক সাংস্কৃতিক জগতের একজন মনে হয়। কখনও মনে হয় না আমি কলকাতার লোক নই, আমি অন্য দেশ থেকে এসেছি। সেই কিশোরী বয়স থেকেই তো কলকাতার সঙ্গে সখ্য আমার। সেকালে সেঁজুতিতে যাদের কবিতা ছাপাতাম, অথবা যাদের লিটল ম্যাগে আমার কবিতা ছাপা হত, একদিন ওদের যে ক’জনেরই খোঁজ পাওয়া যায়, সবাইকেই আ আর রাতের খাবারের নেমন্তন্ন করি বাড়িতে। কেউ এখনও লিখছে, কিন্তু যে জায়গায় ছিল সেই জায়গাতেই দাঁড়িয়ে আছে, কেউ তান্ত্রিক হয়ে গেছে, কেউ ব্যবসায়ী, তারপরও পুরোনো দিনগুলো ফিরে পেতে চাওয়ার আকুলতা আমি টের পাই আমার ভেতর। দেশ থেকে দাদা আসে। ঝুনু খালা আসে। দাদার ছেলে শুভও বেড়াতে আসে। সবাইকেই আদরে ডুবিয়ে রাখি। আর কলকাতা দিতে থাকে আমাকে দুহাত ভরে। সকালে বাংলা খবরের কাগজ পড়ার সুযোগ কোথায় আর পেতাম জগতে। বিকেলে কোনও একটা বাংলা ম্যাগাজিন, বা বই হাতে নিয়ে শুয়ে পড়া। সন্ধেয় বাংলায় আড্ডা আর রাতে এক গুচ্ছ বাঙালি মিলে হৈ হৈ করে বাঙালি খাবার! তাছাড়া তো আছেই টেলিভিশনে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে, বিভিন্ন বিষয়ে মত প্রকাশ করার আমন্ত্রণ। আর আছে বিভিন্ন চিত্র প্রদর্শনী উদ্বোধন করা। নানা লেখক কবির বইএর ফিতে কাটা। বিভিন্ন মঞ্চে কবিতা পড়া। আর ‘ধর্ম মুক্ত মানববাদী মঞ্চ’ নিয়ে স্বপ্ন দেখা। বাঙালি মুসলমান পরিবারে জন্ম কিন্তু ধর্মমুক্ত মানুষদের জড়ো করে একটি মানববাদী সংগঠন গড়ে তুলি, নিজেকে ইচ্ছে করেই রাখি নেপথ্যে। সংগঠনের উদ্দেশ্য সত্যিকার ধর্মমুক্ত রাষ্ট্র, সমাজ, শিক্ষা এবং আইন প্রতিষ্ঠা করা, মেয়েদের শিক্ষিত আর স্বাধীন করা, মসজিদ মাদ্রাসার উৎপাত বন্ধ করা। পশ্চিমবঙ্গের আনাচ কানাচ থেকে আগ্রহীরা জড়ো হতে থাকে। অন্ধকারে পড়ে থাকা মুসলমান সমাজকে আলোকিত করার উদ্যোগ নিই, খুব ছোট বটে দল, কিন্তু স্বপ্ন ছোট নয়। বাতি খুব উজ্জ্বল, কিন্তু সব আঁধার ঘরে, সব অন্ধকার গলিতে পৌঁছে দেবার লোকবল নেই। না থাকুক, কলকাতার বিভিন্ন মঞ্চে অনুষ্ঠান করা, লিফলেট বিতরণ, মিটিং মিছিল চলতে থাকে।