আর ওদিকে বাংলার অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবি জয় গোস্বামী কবিতার বই ২০০৭”আমার শ্যামশ্রী ইচ্ছে, স্বাগতা ইচ্ছেগুলি’ তো উৎসর্গ করলেনই আমাকে, আমাদের সময়ের উজ্জ্বল ফলক তসলিমা নাসরিনকে’ লিখে, একটি কবিতাও লিখলেন, ‘আমাদের কাউকে যদি তোমার লড়াই লড়তে হত?/দূরে দূরে, নিরাপদ আশ্রয়ে দাঁড়িয়ে/আমরা তোমার কত দোষ খুঁজে বার করলাম/আগুনের সামনে গিয়ে দেখলাম না আঙুলটি বাড়িয়ে/জানলায় দড়ির মই ঝোলানোই ছিল, কিন্তু তুমি/ বেরিয়ে আসার কোনো সুযোগ নিলে না/জ্বলন্ত বাড়ির মধ্যে থেকে যাওয়াটাই বেছে নিলে/ তোমার যুদ্ধের কাছে/আমার জীবন কিছু নয়। এখন আমার পিঠে ঠেকেছে দেওয়াল/এরপর বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে গিয়ে/আমার জীবনটি ওই ধানক্ষেতে ফেলে দিয়ে যাবে/নায়েব, গোমস্তা, লাঠিয়াল/না, আমি তোমার মতো/ ঘুরে পাল্টা লড়তে পারবো না/এমনকী অবস্থানটুকু/জানাতে যাবো না কাউকে পতাকা নাড়িয়ে/যদি বন্ধু মনে করো, শুধু এ শুভেচ্ছাটুকু দাও, সাহসিকা/অন্তত ঘাড় গুঁজে যেন মরতে পারি একা একা স্বধর্মে দাঁড়িয়ে।
২০০৭/২০০৮ সালে অনেকেই কবিতা লিখেছিলেন। বেশ কিছু বই আর ম্যাগাজিন বেরিয়েছিলো আমাকে কলকাতা ফিরিয়ে নেওয়ার জন্য মানুষের প্রবন্ধ, নিবন্ধ, গল্প কবিতা ছাপিয়ে। মানুষ রাস্তায় নেমেছিলেন, দেওয়ালে পোস্টার সেঁটেছিলেন, আন্দোলন করেছিলেন, অনশন করেছিলেন। প্রতি বছর ২২ নভেম্বর তারিখে আমাকে পশ্চিমবঙ্গ থেকে বের করে দেওয়ার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ অনুষ্ঠান হয়। ধীরে ধীরে সেসব ফিকে হয়ে এলো। পশ্চিমবঙ্গে নির্বাচন হল। সিপিএম-এর চৌত্রিশ বছর শাসন গেল, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ঐতিহাসিক বিজয় হল। কিন্তু দু’একজন কাছের মানুষ ছাড়া কেউ আর আমার প্রসঙ্গ তোলে না। যেন আমি বলে কিছু আর বেঁচে নেই কোথাও। আমার আর বাংলায় ফেরা জরুরি। নয়। যেন এক বাঙালি লেখককে বাংলা থেকে নির্বাসনদণ্ড দেওয়ার ঘটনাটি ইতিহাসের পাতা থেকে দিব্যি মুছে দেওয়া গেল।
কোটি কোটি বছর আগে জন্ম নেওয়া বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের কোটি কোটি নক্ষত্র আর গ্রহের ভিড়ে পৃথিবী নামক গ্রহের অস্তিত্বই ক্ষণস্থায়ী, এই গ্রহে মানুষ নামের প্রজাতির বিচরণ আর এর নির্মূল হয়ে যাওয়ার ঘটনাও নিতান্তই তুচ্ছ ঘটনা। মানুষের গোটা ইতিহাসও হয়তো কিছুই না, কিছুই না, কিছুই না। ব্রহ্মাণ্ডে কে আর কোথায় আছে মানুষের ইতিহাস খুঁড়ে .দেখতে যাবে। এখনও বেঁচে আছি বিরুদ্ধ স্রোতে, এই তো বেশি।