ভারতবাসের শর্তহীনঅনুমতি শেষ অবদি জোটেবটে ২০১০ সালের শেষে, তবেইতিমধ্যেই আমি উপমহাদেশের সাহিত্য জগতে নিষিদ্ধ একটি নাম। কোনও বাংলা পত্রিকায় আমার লেখা ছাপা হয় না। বাংলাদেশের কথা বাদই দিলাম, ওরা বন্ধ করেছে সতেরো বছর আগে। পশ্চিমবঙ্গ অনুসরণ করেছে বাংলাদেশের পদাঙ্ক। দৈনিক স্টেটসম্যান বন্ধ করে দিয়েছে আমার লেখা ছাপানো, যদিও আমার লেখা ভীষণই জনপ্রিয় ছিল। আনন্দবাজার, দেশ, প্রতিদিন, রোববার ইত্যাদি ম্যাগাজিন এবং পত্রিকায় আমি নিষিদ্ধ নাম। রোববারের সম্পাদক ঋতুপর্ণ ঘোষ খুব ঘোষণা দিয়ে আমার লেখা ছাপাতে শুরু করেছিল। একটি লেখা ছাপা হওয়ার পর বন্ধ করে দিল ছাপানো। ওপর থেকে শুনেছি নির্দেশ আসে আমাকে বাতিল করার। এরপর দিল্লির ‘জনসত্তা’ নামের একটি হিন্দি দৈনিকে লিখতে শুরু করলাম, কর্ণাটকে আমার লেখা নিয়ে দাঙ্গা হওয়ার পর সেখানেও বন্ধ করে দেওয়া হল কিছুদিন পর। সবাই পিছিয়ে যায়। সবার কাছেই ওপর থেকে আদেশ আসে আমাকে বন্ধ করার। বই ছাপানোও বন্ধ করেছে প্রায় সব প্রকাশক। কারণ কি এই যে আমার বই বিক্রি হয় না, বা দৈনিকে সাপ্তাহিকে আমার লেখা কেউ পড়ে না? মোটেও তা নয়। লেখা ছাপালে কাগজ বেশি বিক্রি হয়, বই ছাপালে বই বেস্ট সেলার হয়। বোম্বের বিখ্যাত ‘ব্যাগ ফিল্মস’ আমার ‘ফরাসি প্রেমিক’ উপন্যাসের ফিল্ম রাইটস কিনেও ছবি বানায়নি। নামি পরিচালক মহেশ ভাট আমাকে নিয়ে ছবি বানাচ্ছেন, চিত্রনাট্য লিখতে শুরু করেছেন ঘোষণা দিয়েও চুপ হয়ে যান। ইউটিভির মতো বড় প্রডাকশান কোম্পানিকেও আমার ওপর ছবি বানানো শুরু করেও অজ্ঞাত কারণে বন্ধ করে দিতে হয়। কলকাতায় আমার গল্প নিয়ে মেগাসিরিয়ালের একশ এপিসোড সুটিং করার পরও টেলিভিশনে প্রচার করা বন্ধ করে দিতে হয়। সম্প্রতি কলকাতার তিনজন পরিচালক আমার জীবন এবং আমার উপন্যাস অবলম্বনে চলচ্চিত্র। নির্মাণের সব পাকা কথা হয়ে যাওয়ার পর, চুক্তিপত্রে সই নিয়ে যাওয়ার পরও ছবি বানানো বন্ধ করে দিতে বাধ্য হলেন। একটা কালো হাত আমার সমস্ত কিছুর ওপর থাবা বসাচ্ছে। একটা অদৃশ্য হাত। একটা ভুতুড়ে হাত। আমার শিরদাঁড়ায় ঠাণ্ডা ভয় বইতে থাকে। কণ্ঠদেশ চেপে ধরে আমাকে মেরে ফেলবে না তো হঠাৎ একদিন!
শুধু লেখাই বন্ধ হয়নি, বেশিরভাগ বন্ধুও যোগাযোগ বন্ধ করে দিয়েছে। ভারতবর্ষে আমি একা। একটি বিন্দুর মতো একা। কোনো লেখক বিনা দোষে এমন নিষিদ্ধ হয়েছে। পৃথিবীর কোথাও? হয়তা গ্যালিলিও হয়েছিলেন প্রায় চারশ’ বছর আগে। মাঝে মাঝে আমার অবাক লাগে ভাবতে আমি বাস করছি একুশ শতকের পৃথিবীতে।
দিল্লিতে থাকার স্বপ্ন তো কোনোদিন আমি দেখিনি। কলকাতায় বাংলা ভাষা আর সংস্কৃতির মধ্যে যতদিন না যেতে পারি, বা বাংলাদেশে, আমার দেশে, যতদিন না যেতে পারি, আমি শান্তি পাবোনা। এ ঠিক আমার ব্যক্তিগত বাসের জন্য নয়। হয়তো অধিকার পেলে আমি বাংলায় বাসও করবো না। কিন্তু বাস করার অধিকারের জন্য চেঁচিয়ে যাবো।
বাকস্বাধীনতার জন্য এ আমার লড়াই। যেসব দেশ আমাকে তাড়িয়েছে মৌলবাদীর মতের চেয়ে ভিন্ন কোনো মত তারা সইবে না বলে, সে দেশ বা সে অঞ্চলে আমার প্রবেশাধিকার যদি না হয়, তবে সে দেশ মৌলবাদীদের অসহিষ্ণুতাকে জয়ী করে তুলবে। এ আমার একার সুখ স্বস্তির চেয়ে বড় কিছু। যদিও লড়াই করছি আমি, একটি বিন্দুর মতো একা আমি, কিন্তু এ ছোট কোনো ব্যক্তিগত স্বার্থের জন্য মোটেই নয়, আরও বড় স্বার্থে। আমি হয়েছি, হয়েছি, পৃথিবীর আর কোনোমানুষই যেন নিজের মত প্রকাশের কারণে কোনওদিন নির্বাসন, নিষেধাজ্ঞা, নিষিদ্ধকরণ ইত্যাদির শিকার না হয়।
দিল্লিতে ধু ধু নিঃসঙ্গতা। শুধু বেড়ালটিই সঙ্গ দেয়। এই একটি প্রাণীর গোটা জীবন আমার ওপর নির্ভরশীল। আর কারও জীবন সম্পূর্ণ আমার ওপর নির্ভর করছে না। একে দিল্লিতে রেখে আমাকে প্রতি মাসেই বিদেশ ভ্রমণ করতে হয়। আসলে যে অনুষ্ঠানগুলোয় অংশ না নিলে চলে না সেগুলোতেই যাই। বাকিগুলো ফিরিয়ে দিই। বেলজিয়ামের বিশ্ববিদ্যালয় ডক্টরেট দেবে, প্যারিস বিশ্ববিদ্যালয়ও দেবে ডক্টরেট, পশ্চিমের অনেকগুলো সিটি সাম্মানিক নাগরিকত্ব দেবে, ইওরোপিয়ান পার্লামেন্টে বক্তৃতা করতে হবে মানবাধিকার নিয়ে, নরওয়েতে হিউম্যানিস্ট কংগ্রেস। যেতেই হয়। যতটা কম সময় থাকা সম্ভব, ততটা সময় থেকেই উড়ে আসি। ঘন ঘন ফিরে আসি বেড়ালের কাছে। ও একা আছে বলে। কী অসাধারণ এক ভালোবাসা গড়ে উঠেছে আমাদের মধ্যে। কে বলেছে, বেড়ালরা খুব স্বার্থপর, কাউকে ভালোবাসে না। মিনু ঠিক ভালো বাসে। ভীষণই বাসে। আর কেউ না বুঝুক, আমি বুঝি। ওর সঙ্গে দিন রাত ওই ভালোবাসা নিয়েই নিভৃতে কথা হয়। ভারতের ধনী লোকেরা কুকুর পোষে, কিন্তু বেড়াল নয়। বেড়ালে ভয়। বেড়ালে কুসংস্কার। বেড়াল দেখাশোনা করার তাই কেউ নেই দিল্লিতে। কলকাতাতেও ছিল না। কিন্তু কাউকে কাউকে শিখিয়ে পড়িয়ে তবেই ওদের কাছে বেড়াল রেখে যেতাম। দিল্লিতে কাউকে শেখাবো, সে সুযোগও নেই। বর্ধমান থেকে জয়প্রকাশ আগরওয়াল আসেন আমার অনুপস্থিতির দিনগুলোতে বেড়ালের দেখাশোনা করতে। কিন্তু বেড়ালের সঙ্গে তার কেবল তিক্ত সম্পর্কই গড়ে ওঠে। বেড়াল নিয়ে যত কুসংস্কার আছে ভারতে, তার বেশির ভাগই হয়তো তিনি বিশ্বাস করেন। দিল্লির কাউকে বেড়াল দেখাশোনা করার কথা বলা হয় না। দিল্লির কারও সঙ্গে পরিচয় নেই এমন নয়। কিন্তু পরিচয়গুলো বন্ধু বা বন্ধুমতো কোনো সম্পর্কে গড়াতে যা যা হওয়া উচিত তা হয়ে ওঠে না। আমারই আলস্য নাকি ওদের, কে জানে। কলকাতায় আমার এই আলস্য নিয়েই বন্ধু এবং বন্ধুমতো অনেকে গড়ে উঠেছিলো। ক্রমশ এক-ঘরের মানুষ হয়ে উঠি, চাই বা না চাই। জগতের মধ্যে আরেক জগৎ। আমার একার নিভৃত জগৎ।