আমাকে চলে যেতে হয় অস্ট্রেলিয়ার মেলবোর্নে। গ্লোবাল এথিস্ট কনভেনশনে। কর্ণাটকের দাঙ্গার কথা উল্লেখ করি ওখানে। ধর্ম মুক্ত বিজ্ঞান-বিশ্বাসী মানুষদের মধ্যেই আমি সবচেয়ে আরাম বোধ করি, যেন তারাই আমার সমাজ, আমার সত্যিকার স্বদেশ। আড়াই হাজার ধর্মমুক্ত মানুষ ইওরোপ আমেরিকা আর অস্ট্রেলিয়ার বিভিন্ন অঞ্চল থেকে এসেছে। বাঘা বাঘা বক্তা সব। রিচার্ড ডকিন্স, পিজি মেয়ার্স, এসি গারলেইং। সবার মধ্যে আমিই একমাত্র পেয়েছি স্ট্যান্ডিং অভেশন। সবার দাঁড়িয়ে হাততালি। খুব বড় সম্মান। এত বড় সম্মানে আমার মন ভালো হয়ে যাওয়ার কথা। অস্ট্রেলিয়ার মিডিয়া সাক্ষাৎকার নেওয়ার জন্য ধরেছে, না কাউকে দিইনি সাক্ষাৎকার, ইমেইলের উত্তরও দিইনি। রাস্তায় উদাস হাঁটি, মানুষ দেখি। পেঙ্গুইনের মিছিল দেখতে দৌড়োই। ইস্কুলের বান্ধবী মমতা থাকে সিডনিতে, উড়ে এলো একদিন দেখা করতে। দেখা হয়নি। আমি তখনও পেঙ্গুইনে। আরও গ্লোবাল কনভেনশনে ডাক পড়ে। যাইনি। ডেনমার্কে যাওয়ার জন্য টিকিটও হয়ে গিয়েছিলো। ইচ্ছে করেনি। ঘরে বেড়াল আছে, ওকে আদর করি কোলে নিয়ে, কোথাও যেতে ইচ্ছে করে না। আকাশে আকাশে জীবনের অনেকটা বছর কাটিয়েছি। আকাশ-জীবন থেকে এবার একটু মুক্তি চাই। ঘর আমাকে ভীষণ টানে। কতকাল ঘর জোটে না।
আবারও নিউইয়র্ক, আমার সেই ২৩তলার মিলিয়ন ডলার ভিউ’ অ্যাপার্টমেন্টে। দেয়াল জুড়ে কাঁচের জানালা। যত পারো দেখ খোলা আকাশ আর নদী। নদীতে নানা রকম ঢেউ, আকাশে নানা রকম রং। সত্যিকার নিরাপদ বাড়ি, নিউইয়র্ক বিশ্ববিদ্যালয়ের ফেলোশিপ শেষ হওয়ার পরও অপার সম্ভাবনা –কানেকটিকাট বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতার চাকরি, উড্রোউইলসন ফেলোহিসেবে বিভিন্ন কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ানো, ব্রডওয়ে মিউজিকাল, লিংকন সেন্টারের অনুষ্ঠান, নারীবাদীদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা, সব সম্ভাবনা, সব সমর্থন ছেড়ে, ইয়াসমিন,সুহৃদ যে দুজন আমার জীবনের একমাত্র আত্মীয় তাদেরও ছেড়ে, নিউইয়র্ক বিশ্ববিদ্যালয়ের রবার্ট কুইন, দীর্ঘকালের বন্ধু ওয়ারেন অ্যালেন স্মিথ, মেরেডিথ ট্যাক্স সবাইকে ছেড়ে, সুন্দর এই প্রকৃতি ছেড়ে চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিই ভারতে, যে ভারত আমাকে চিঠি দিয়েছে যে আর আমার ভিসা বাড়ানো হবে না। এ আমি মেনে নিচ্ছি না। বিদেশের কোনও ভারতীয় দূতাবাস ভারত সরকারের আদেশ ছাড়া আমাকে ভিসা দেবে না। সরকারই যদি সে আদেশ দেওয়ার হর্তাকর্তা, তবে আর ভারতের বাইরে থেকে ভিসা নিতে হবে কেন, ভেতর থেকেই তো নেওয়া সম্ভব। আর সয় না ভেতর বাহির। যে করেই হোক নিশ্চিন্তিবাস চাই জীবনে। অনেক তো হল। অকাতরে ছেড়ে আসতে পারি সব। জীবনে এক দেশ ছেড়ে আরেক দেশে গেছি অনেক। এক শহর ছেড়ে আরেক শহরে। এভাবেই এক ঠিকানার আশায় আশায় জীবন ফুরোয় আমার।
আগস্ট মাস অবদি আমার থাকার অনুমতি দিল্লিতে, ভিসা আমি বাইরে থেকে চাইবো না। একবার যদি আমার ভিসার মেয়াদ উত্তীর্ণ হয়ে যায়, আমি আর নতুন কোনো ভিসা পাবো না। এ অনেকটা বাংলাদেশ বা পশ্চিমবঙ্গ থেকে যেমন বলা হয়েছিলো, তুমি যাও দেশের বাইরে, দু একদিন বা দু তিন মাস পর ফিরে এসো, তেমন সেই ফিরে আসা কোনওদিন আর হয়নি। সব বিদেয় ফিরে আসার জন্য নয়। অনেক বিদেয়-এর পর দরজা চিরতরে ভেতর থেকে বন্ধ করে দেওয়া হয়।
শুনেছি বিদেশি কিছু লেখকও বিবৃতি দিয়েছেন আমার ভারত বাসের অধিকার নিয়ে। ভারত সরকারকে অনুরোধ করেছেন আমাকে যেন ভারতে থাকার অনুমতি দেওয়া হয়। একদিন সুইডিশ দূতাবাসে গেছি নতুন পাসপোর্ট করতে, কারণ অতি ভ্রমণে পাসপোর্ট সিলে সিলে একাকার, এক বিন্দু জায়গা নেই ভিসার সিলের। ওই দূতাবাসেই শুনলাম দিল্লির কয়েকটি বিদেশি দূতাবাস থেকে লোক যাচ্ছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কারও সঙ্গে দেখা করতে, আমাকে যেন থাকতে দেওয়া হয় দিল্লিতে, এই আবেদন নিয়ে। মন ভালো হয়ে ওঠে। কোনও ভালো খবর পেলে লোকে বলে, ‘তাহলে বলতে হয় ঈশ্বর আছেন’, আমি তা বলি না, আমি বলি, তাহলে ভালো মানুষ পৃথিবীতে এখনো আছেন। এখনও মানুষ আছেন, যাঁরা মত প্রকাশের স্বাধীনতায় বিশ্বাস করেন, এখনও তবে পৃথিবীটা পুরোপুরি নষ্ট হয়ে যায়নি। তারা ঠিক কারা আমি জানি না, যারা আমাকে ভারত ছাড়া করার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছেন, যারা আমাকে ছ’মাস নয়, পুরো এক বছরের ভিসা দিয়েছেন, এবং প্রতি বছর দিয়ে যাবেন। মন কৃতজ্ঞতায় ভরে যায় আড়ালের সেই মানববাদী, মত প্রকাশে বিশ্বাসী মানুষের প্রতি। আমি ভারতের নাগরিক নই, আমাকে যদি থাকতে না দেওয়া হত, কার কী বলার ছিল, আমাকে যদি ভিসা একেবারেই না দেওয়া হত, ভিসা পাওয়ার কোনো ক্ষমতাই তো আমার ছিল না। আমাকে যদি নিরাপত্তা না দেওয়া হত, কী-ই বা করার থাকতো আমার! মোদ্দা কথা, কিছুই না। আমি অতি নিরীহ প্রাণী, লেখার জোর ছাড়া আর সত্য কথা বলার জোর ছাড়া আর কিছুর জোর নেই আমার। এই পুরুষতান্ত্রিক পৃথিবীতে নারীর অধিকারের জন্য লেখার মাধ্যমে লড়াই চালিয়ে যাওয়া বড় সেকেলে জিনিস। বেশির ভাগ নারী পুরুষ নারীবাদ বিষয়টিকেই ভালো চোখে দেখে না। তারা বিশ্বাস করে সমাজে নারী পুরুষের সমতা পুরোপুরিই প্রতিষ্ঠিত, শুধু গোটা কয় বর্বর অশিক্ষিত লোক কদাচিৎ নারীকে অসম্মান করে।