এরকমই একটা সময় আমার মন উদাস। ভারতের রেসিডেন্স পারমিট ফুরোবার আগে গিয়েছিলাম দিল্লিতে। ঢুকতে দিয়েছে, এক বন্ধুর খালি বাড়িতে থাকতেও দিয়েছে কয়েকদিন। শত শত পুলিশ ঘিরে রেখেছে বাড়িকে, আমাকে। কিন্তু যাওয়ার পর পরই রেসিডেন্স পারমিট ছ’মাসের জন্য বাড়িয়ে আমাকে বিদেয় করে দেওয়া হয়েছে। আমি থাকবো না ভারতে, এ কথাটি ওদের মাথায় হাত দিয়ে বললে, নিজের বুকে হাত দিয়ে প্রতিজ্ঞা করলে তবেই আমাকে ‘ভারতে থাকার অনুমতি দেওয়া হয়। মুচলেকা দিতে বলা হয়েছে, দিতে বাধ্য হয়েছি। ছমাস পরেও গিয়ে দেখি সিদ্ধান্ত পাল্টায়নি। ওই একই, রেসিডেন্স পারমিট দেবো, তবে এক শর্তে, পারমিট পাওয়ার তিন দিনের মধ্যে চলে যাও। ভারত যদি থাকতেই না দেয়, যেতেই না দেয় কলকাতায়, আমাকে তো কোথাও না কোথাও থাকতে হবে, এরকম কিছুদিন সুইডেনে সুয়েনসনের বাড়িতে, কিছুদিন নিউইয়র্কে ইয়াসমিনের বাড়িতে, কিছুদিন প্যারিসের হোটেলে হোক না সে ফাঁইভ স্টার হোটেল, কিছুদিন মদনজিৎ সিংএর প্রাসাদে –এভাবে জীবন ঠিক যাপন করা যায় না। সুয়েনসনের বাড়িতে কিছুদিন থাকা যায়, দীর্ঘদিন থাকা যায় না। প্যারিসের আমি সম্মানীয় নাগরিক, মেয়রও বলেছেন প্যারিসে যেন থাকি। তবে প্যারিসেই থাকি না কেন। অনেকে বলেছে, ফরাসি সরকারের কত কত বাড়ি পড়ে আছে, দিতেই পারে একটি। তা কি সত্যি আমাকে দিতে পারে, ফরাসি কত লোক রাস্তায় জীবন যাপন করে, আর আমি কে যে আমাকে একটা বাড়ি দিতে হবে। শুধু লমন্দ নয়, অন্যান্য পত্রিকাও ভারত থেকে বিতাড়িত হওয়ার পর আমার গৃহহীন অবস্থার কথাই লিখেছে। প্যারিসের মেয়র বাট্রণ্ড দোলানয়ে দিলেন ছ’মাসের জন্য স্কলারশিপ, শিল্পীদের থাকার জায়গায় আমার জন্য ঘর হবে, মাসে মাসে হাত-খরচের টাকা হবে। লেখক শিল্পী সাহিত্যিকের সঙ্গে প্যারিসের মধ্যিখানে সেইন নদীর ধারে এক বাড়িতে থাকা আমাকে পুলকিত না করলেও আমার ফরাসি বন্ধুদের করে। হৈহুল্লোড় করে কিছু বন্ধু লেখক ধুমধাম করে খেয়েও গেল, তুমুল আড্ডা দিয়ে গেল আমার জন্য বরাদ্দ ঘরটিতে। অনেকটা উদ্বোধনের মতো। তবে ঘরে, সত্যিকার অর্থে আমার থাকা হয়নি, চলে গেছি নিউইয়র্কে, নিউইয়র্ক ইউনিভার্সিটি থেকে আমাকে ফেলোশিপ দেওয়া হয়েছে।
নিউইয়র্কে থাকতে শুরু করি, তবে ছুটতে হয় আরও অনেক দেশে। সুইডেনে আন্তর্জাতিক সাহিত্য সম্মেলন, স্পেনের বিলবাওয়ে সেন্সরসিপের বিরুদ্ধে সেমিনার, সানফ্রান্সসিস্কোতে কবিতা উৎসব, বীট-কবিরা যেখানে কবিতা পড়তেন, সেখানে কবিতা পড়া, সেই নর্থ বিচ,সেই সিটি লাইটস, সেই বিসুভিয়াস! ইতালিতে কবিতা উৎসব, লুক্সেমবার্গেও তাই, আমস্টারডামে মুক্তচিন্তা বিষয়ে অনুষ্ঠান, ভিয়েনায় জগতে ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠা করার · মূল্যবান আলোচনা অনুষ্ঠান। ইওরোপিয়ান পার্লামেন্ট থেকে শাখারভ পুরস্কারের পঁচিশ বছর পূর্তি। বেলজিয়ামের লোভেইন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সাম্মানিক ডক্টরেট কিছু না কিছু আছেই। কিছু না কিছু থাকেই। ঘরে বসে নিশ্চিন্তে লেখালেখি করার জো নেই। অথবা এ একধরনের ঘরে বসে থাকার একঘয়েমি থেকে মুক্তি।
তবে নিউইয়র্কে যে মত প্রকাশের স্বাধীনতাকে বিষয় করে সাহিত্য উৎসব হচ্ছে, তাতে কেউ আমাকে আমন্ত্রণ জানায় না। ভিন্ন মত প্রকাশ করার অপরাধে যে লেখককে এত কাল ধরে এত ভয়ংকর জীবন যাপন করতে হচ্ছে–যাকে এই কদিন আগে ছেড়ে আসতে হচ্ছে ভারতের মতো বিরাট একটা গণতান্ত্রিক দেশ তাকে ডাকা হয়নি, ডাকা হয়েছে অগুনতি অজ্ঞাত অখ্যাত লেখকদের। আমেরিকান পেন ক্লাব সাহিত্য উৎসবের আয়োজন করেছে। আমেরিকার এই লেখক সংগঠন কি আমাকে চেনে না? খুব চেনে। এ খবর কি জানে না যে এখন আমি নিউ ইয়র্কে। না জানার কোনো কারণ নেই। তবে কেন অন্য লেখকরা আজ তাদের মত প্রকাশের স্বাধীনতার কথা বলছে, কিন্তু তাদের চেয়েও অনেক বেশি অত্যাচারিত হওয়ার পরও আমি বলার অধিকার পাচ্ছি না। ভারতে আমার লেখার। কারণে মুসলিম মৌলবাদীর হামলা, আমাকে পশ্চিমবঙ্গ থেকে বের করে দেওয়া, দিল্লিতে অজ্ঞাতবাসে আমাকে রাখা, অবশেষে আমার ভারত ছাড়তে বাধ্য হওয়া এসব অন্য কেউ যদিও না জানে, পেন এর সভাপতি তো জানেন নিশ্চয়ই। সভাপতি সালমান রুশদি। তবে কি সালমান রুশদি সভাপতি বলেই এ শহরে আমি উপস্থিত থেকেও আন্তর্জাতিক মত প্রকাশের স্বাধীনতা বিষয়ে সেমিনারে আমি আমন্ত্রিত হতে পারি না! কী অপরাধ আমার। সেই যে কতকাল আগে জার্মানির ডাস্পিগাল পত্রিকায় ‘মৌলবাদীদের কাছে সালমান রুশদির ক্ষমা ভিক্ষে চাওয়া উচিত হয়নি’ বলেছিলাম বলে? সত্য কথা শুনে তখন রেগে আগুন হয়েছিলেন জানি, রাগ যে এত কাল পুষে রেখেছেন তা কে জানবে!
ইয়াসমিনের বাড়িতে থাকছিলাম। ভালোবাসা কিছুতেই রাজি নয় আমি ও বাড়িতে থাকি। ও আস্ত একটা বাস্তবজ্ঞানবর্জিত অদ্ভুত মানুষে পরিণত হয়েছে। হাত পা ছুরি দিয়ে কাটছে। কেন? তার বয়ফ্রেন্ড নেই, নিশ্চয়ই সে কুৎসিত, তা না হলে সবার বয়ফ্রেণ্ড থাকে, তার নেই কেন! ইয়াসমিনকে অনেক বলেছি ওকে সাইকিয়াট্রিস্টের কাছে নিতে। ইয়াসমিন রাগে ফেটে পড়ে সাইকিয়াট্রিস্টের নাম শুনলে! তার মেয়ের কেন মাথা নষ্ট হতে যাবে। তার মেয়ে কি পাগল নাকি! অ্যানাল ফিশারে অনেকদিন ভুগে ওটাই ওর হয়ে উঠেছিল অবসেশন, এখন ভালোবাসা অবসেশন। ভালোবাসা ঘরের রানী, আর তার বাপ মা তার চাকর বাকর। এই ধরনের একটা রোলপ্লে চলে ইয়াসমিনের বাড়িতে। অসুস্থ পরিবেশ, জানি। আমি নিজের জন্য হন্যে হয়ে একটা অ্যাপার্টমেন্ট খুঁজি। অ্যাপার্টমেন্ট পাওয়া কি আর চাট্টিখানি কথা। ক্রেডিট হিস্টরি লাগবে, যেটি নেই আমার। কত উপার্জন করি বছরে তার একটা প্রমাণপত্র দেখাতে হবে। যদি লক্ষ ডলার বছরে না উপার্জন করি, কেউ আমাকে বাড়ি ভাড়া দেবে না। তারপরও খুঁজি। শেষ পর্যন্ত ভাড়া নিই বটে না থাকা-টুইন-টাওয়ারের কাছে, হাডসন নদীর প্রায় পাড়ে, একজন গ্যারেন্টর জাদুর মতো যোগাড় হয়েছিল বলে। আমি যদি বাড়ি ভাড়া নেওয়ার শর্তগুলো পূরণ করতে না পারি, তবে আমাকে তার আশ্রয় নিতে হবে, যার ক্ষমতা আছে ওই শর্ত পূরণ করার। গ্যারেন্টর পাওয়াটা অমাবস্যার চাঁদ পাওয়ার মতো। যে দীর্ঘ বছর ধরে আমাকে চেনে একজন সৎ মানুষ হিসেবে, সে পিছিয়ে গেল, এগিয়ে এলো এমন একজন মানুষ, যার সঙ্গে আমার জানা নেই শোনা নেই, কিছু নেই। পৃথিবী বড়ই বিচিত্র।