এখন থেকে প্রায় একশো বছর আগে বেগম রোকেয়া লিখেছিলেন, আমাদের যথাসম্ভব অবনতি হওয়ার পর দাসত্বের বিরুদ্ধে কখনও মাথা তুলিতে পারি নাই, তাহার প্রধান কারণ এই বোধ হয় যে যখনই কোনো ভগ্নী মস্তক উত্তোলনের চেষ্টা করিয়াছেন, তখনই ধর্মের দোহাই অথবা শাস্ত্রের বচন রূপ অস্ত্রাঘাতে তাহার মস্তক চূর্ণ হইয়াছে। আমাদের অন্ধকারে রাখিবার জন্য পুরুষগণ ওই ধর্মগ্রন্থগুলিকে ঈশ্বরের আদেশপত্র বলিয়া প্রকাশ করিয়াছেন। এই দুঃসাহসী সত্যঘোষণার জন্য তাকে যথেষ্টনিগ্রহ সইতে হয়, এবং গ্রন্থাকারে প্রকাশের সময়ে নবনূর এ প্রকাশিত মূল প্রবন্ধটির কিছু অংশ বাদ দিতে হয়। একশো বছর পরেও প্রস্তাব শুনছি তসলিমার বইটি থেকেও কিছু অংশ বাদ দিলে সেটির ওপরে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহৃত হতে পারে। একশো বছর পরেও কি আমরা অতীত সময়ের সেই দুঃসহ বিন্দুটিতে দাঁড়িয়ে?
পশ্চিমবঙ্গের অনেক কাগজেই বই নিষিদ্ধ করার প্রতিবাদ বেরিয়েছে। অনেক কাগজের সম্পাদকীয় বা কলামে অনেকে বই নিষিদ্ধের বিরুদ্ধে মুখর হয়েছেন, যদিও বড় কিছু লেখক এবং শিল্পী সরকারি নিষেধাজ্ঞাকে সমর্থন করেছেন। ঢাকার কোনো কাগজেই বই নিষিদ্ধ করার বিরুদ্ধে খুব বেশি কেউ টু শব্দ করেননি বরং প্রায় সবাই সায় দিয়েছেন বই নিষিদ্ধের মতো নিষিদ্ধ কাজে। ঘৃণার মতো সংক্রামক আর কিছু নেই। কেউ যদি একবার কারও বিরুদ্ধে ঘৃণা প্রচার করে, সেই ঘৃণা সম্পূর্ণই মিথ্যের কাঁধে ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা হলেও আলোর গতিরও আগে ছোটে সেই ঘৃণা।
কত কিছু ঘটে গেল ‘দ্বিখণ্ডিত’ নিয়ে। নিষিদ্ধ হল একটি মত, ‘দ্বিখণ্ডিত’ হল পাঠকের পথ। কেউ বলছে নিষিদ্ধ হোক, কেউ বলছে না হোক। কেউ বলছে ধর্ম নিয়ে নিজের মত প্রকাশ করা যাবে না, কেউ বলছে যাবে। কেউ ভয়ে কেঁপে উঠে বলছে, দাঙ্গা লেগে যাবে। কেউ ঠোঁট উল্টে বলছে, দাঙ্গার কোনোআভাসই কখনো দেখা দেয়নি। কেউ বলছে, মুসলমানের ভোট পাওয়ার জন্য সরকারের এই নিষিদ্ধকরণ। কেউ বলছে, পয়গম্বরকে অশ্রদ্ধা করা হয়েছে সুতরাং নিষিদ্ধ হওয়াই বাঞ্ছনীয়। যে যাই বলুক, আমি মত প্রকাশের স্বাধীনতার পক্ষে। কেবল নিজের মত নয়, অন্যের মতও, সে মত আমার মতের যতই বিপরীত হোক। এ বিষয়ে আমার নিজের বিশ্বাস সামান্যও খণ্ডিত হয়নি। আমি অখণ্ডই থেকে গেছি যেমন ছিলাম।
বাংলাদেশ আমার পাঁচটি বই নিষিদ্ধ করেছে। সে তুলনায় পশ্চিমবঙ্গ কম করেছে। একটি। কিন্তু নিষিদ্ধ করার কারণ দু সরকারই একই দেখিয়েছে, মানুষের ধর্মীয় মূল্যবোধে আঘাত করেছি। ধর্মীয় মূল্যবোধ রক্ষার অজুহাতে চিরকালই শাসককুল মানুষের কণ্ঠরোধ করেছে। আমরা তো এখনও সেই যুগকেই ‘অন্ধকার যুগ’ বলি, যে যুগে ধর্ম দ্বারা রাষ্ট্র পরিচালিত হত!
‘দ্বিখণ্ডিত’ নিষিদ্ধ করায় যে অন্ধকার কেঁপে নেমেছিল, সে থেকে মানুষকে বাঁচাবার দায়িত্ব প্রথম নিয়েছিলেন সুজাত ভদ্র। তিনিই আদালতে গেলেন জরুরি একটি প্রশ্ন নিয়ে, ‘আমি এ দেশের নাগরিক, এ দেশে প্রকাশিত ‘দ্বিখণ্ডিত’ নামের বইটি আমি পড়তে চাই। কে আমার পড়ার অধিকার খর্ব করছে? তাঁকেই সাহায্য করতে গিয়ে মত প্রকাশের স্বাধীনতার পক্ষে জয়মাল্য বাগচি তাঁর অসাধারণ যুক্তি পেশ করে আদালত মুগ্ধ করলেন। ব্যক্তিগতভাবে কৃতজ্ঞতা আমি সুজাত ভদ্র বা জয়মাল্য বাগচিকে জানাইনি। জানাইনি মহামান্য বিচারকদেরও, যারা দ্বিখণ্ডিত’ নিষিদ্ধ হওয়ার বিপক্ষে রায় দিয়েছেন। জানাইনি, কারণ যদিও বইটি আমার লেখা, আপাতদৃষ্টিতে এ আমার ব্যক্তিগত বটে, কিন্তু নিষিদ্ধ হওয়ার পর ব্যাপারটি মোটেই আমার ব্যক্তিগত নয়। নিষিদ্ধ হলে আপনাতেই লেখক আড়ালে চলে যান, সামনে এসে দাঁড়ায় বড় প্রশ্নবোধক চিহ্নের মতো লেখার অধিকার। কেবল তার নয়, সবার। সবার ন্যায্য অধিকারের পক্ষে চিরকালই লড়াই করেন গুটিকয় মানুষ। তারা অলক্ষ্যে অজান্তে ইতিহাস রচনা করেন। সভ্যতার ইতিহাস। সুজাত ভদ্র এই ভারতবর্ষে এক আকাশ আলো ছড়িয়ে সেই ইতিহাসটিই রচনা করলেন। দু’বছর নিষিদ্ধ থাকার পর ‘দ্বিখণ্ডিত’ মুক্তি পেল। আদালতের রায়ে নিষিদ্ধ ‘দ্বিখণ্ডিত’র মুক্তি পাওয়া আমার ব্যক্তিগত কোনো জয় নয়, এ জয় মুক্তচিন্তার জয়, বাক স্বাধীনতার জয়, এ মত প্রকাশের অধিকারের জয়। অনেকেই যোদ্ধা ছিলেন। লেখক আর প্রকাশক তো ছিলেনই, আদালতে শুনানির দিন নিষিদ্ধের বিপক্ষে, অনেকে আবার বাক স্বাধীনতার পক্ষে উপস্থিত থাকতেন। যত দুরাশাই দেখা দিক, একটি সান্ত্বনা এই, অধিকাংশ মানুষ বই নিষিদ্ধ হোক চায় না, সে যে মতের বইই হোক না কেন। তবে একই সঙ্গে একটি আশংকা এই, অধিকাংশ এই মানুষ মুখ বুজে থাকে।
০২. হঠাৎ একদিন
হারভার্ডের জীবন শেষ হওয়ার পর ভাবি এবার কোথায়! কোন দেশ? কোন শহর! কোথাও দাঁড়াতে চাই, পায়ের তলায় মাটি চাই। যাযাবর জীবনের ইতি বারবার টানতে গিয়েও ব্যর্থ হয়েছি, আর যেন ব্যর্থ না হই। বাংলার মেয়ে বাংলায় ফিরবো। দীর্ঘদিনের এই স্বপ্ন আমায় তাড়া করে, আমার পায়ে পায়ে হাঁটে, সেঁটে থাকে গায়ে। এত কিছু ঘটে গেল বাংলায়! বই নিষিদ্ধ, অবান্তর কুৎসা, নিন্দা, তারপরও বাংলায় ফেরার ইচ্ছে। বিশুদ্ধ জল হাওয়া, ঝলমলে নগর, নিরাপদ জীবন ফেলে কলকাতায় ফিরি। বিদেশ থেকেই ট্রায়াংগুলার পার্কে একটি আসবাবওয়ালা বাড়ি এক মাসের জন্য ভাড়া নেওয়ার ব্যাপারটা পাকা করে, তবে। হোটেলে থাকার আর একদমই ইচ্ছে নেই। ইচ্ছে কি কোনওকালে ছিল। উপায় ছিল না বলে থাকতে হয়েছে। ট্রায়াংগুলার পার্কের বাড়িতে মানুষে, কোলাহলে, বন্ধুতে, ব্যস্ততায়, বিস্ময়ে, কৌতূহলে পুরো একমাস কাটাই। খোঁজ করতে থাকি একটি বাড়ির যেখানে অস্থায়ী নয়, রীতিমত স্থায়ী বাস করব, যতদিন বেঁচে থাকি, ততদিন। স্বপ্নগুলো পাখা মেলতে থাকে, সেইসব অচিন দেশের অচিন পাখির অচিন পাখা। অতিকায় সব পাখা আমাকে অদৃশ্য করে ফেলে।