- বইয়ের নামঃ নির্বাসন
- লেখকের নামঃ তসলিমা নাসরিন
- বিভাগসমূহঃ আত্মজীবনী
০১. নিষিদ্ধ মত, দ্বিখণ্ডিত পথ
নির্বাসন
আত্মজীবনী সপ্তম খণ্ড
তসলিমা নাসরিন
প্রথম প্রকাশ জানুয়ারী ২০১২
মদনজিৎ সিং শ্রদ্ধাস্পদে
.
০১. নিষিদ্ধ মত, দ্বিখণ্ডিত পথ
হারভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে একটা অদ্ভুতও নয়-চমৎকারও নয়-খুব যাচ্ছে তাই নয়-আবার খুব ঝলমলেও নয় জীবন পার করেছি। টানা এক বছর। হারভার্ড ল’ ইস্কুলের উল্টোদিকে পঞ্চাশ ল্যাঙ্গডন স্ট্রিটের সাদা তিনতলা বাড়ির তিনতলাটি ভাড়া নিয়ে নিই হঠাৎ একদিন। বাড়ি থেকে হেঁটে হেঁটে হারভার্ডের কেনেডি ইস্কুলএ যাই। কেনেডি ইস্কুল অব গভর্মেন্ট। হারভার্ডের এই ইস্কুলটিই শুনেছি সবচেয়ে নামি-দামি। নামি, দামি, বিখ্যাত, বিরাট এসব শব্দ আমাকে আকষ্ট করে না। মানুষগুলো ভালো কি না, সৎ কি না, মনে যা, মুখে তা-ই কি না সেটাই আমি আগে দেখি। কেনেডি ইস্কুলের হিউম্যান রাইটস সেন্টারে আমার জন্য অফিস, ডেস্ক, কমপিউটার, ইন্টারনেট, প্রিন্টার, কাগজ, কলম, স্টেপলার, আলপিন খুঁটিনাটি। অফিসের দরজা খুলে বেরোলেই করিডরে চা কফি বিস্কুট। নিচের ক্যাফেটেরিয়ায় সুস্বাদু স্বাস্থ্যকর খাবার। গলায় আমার হারভার্ডের আইডি ঝোলে। ‘রিসার্চ স্কলার’, কেনেডি ইস্কুল, হারভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়। এই আইডি জাদুর মতো কাজ করে। হারভার্ডের অলি গলি চষে বেড়ানো যায়। অত বড় লাইব্রেরি থেকে যখন তখন দুষ্প্রাপ্য বই নিতে পারা, রাতে যতক্ষণ খুশি অফিসে কাটাতে পারা, দু’মিনিটে ব্যাংকের অ্যাকাউন্ট হয়ে যাওয়া, মুহূর্তে চিকিৎসা হয়ে যাওয়া যে কোনও অসুখের! কী নয়।
দিনে প্রায় সারাদিন অফিসেই থাকি। কাছের কোনো রেস্তোরাঁয় খেতে যাই দুপুরে। কখনও ভারতীয় রেস্তোরাঁ, কখনও সাদামাটা আমেরিকান, কখনও সী ফুড। বিকেলে সাঁতার কাটি নয়তো মানুষের গোছানোবা এলোমেলো জীবন দেখতে দেখতে অনেকটা পথ অবধি আনমনে হাঁটি। ওজন পঞ্চাশ কিলো। জিনস, টপস। দেখতে কিশোরী কিশোরী। সুদর্শন হারভার্ড ফেলো গ্রেগ কারের সঙ্গে বন্ধুত্ব হতে হতে হয় না, স্টেডিয়ামে পাশে বসিয়ে হারভার্ড আর ব্রাউনের ফুটবল খেলা বোঝালো, সুইটি টুইটি বলে বেশ ই-মেইল করলো অনেকদিন, ফেরারিতে চড়ে চলে এলো বাড়িতে, নেমন্তন্নও করলো তার পেন্টহাউজে। কিন্তু হঠাৎ কী কারণে জানি না, আমেরিকার ইরাকে বোমা ফেলাকে পছন্দ করিনি বলে নাকি এ নিয়ে বেজায় তর্ক করেছি বলে, যোগাযোগ দুম করে প্রায় বন্ধ করে দিল। অত প্রেম নিমেষে উড়ে গেল! বড়লোকদের শখ আর রকম সকমে আমার উৎসাহ চিরকালই কম। তবে গ্রেগ কারকে আমি শ্রদ্ধা করি এবং করবো, হারভার্ডে হিউমেন রাইটসের সেন্টার খুলেছেন বলে। টাকা তো অনেকের হাতেই আছে, ক’জন আর মানবাধিকারের সেবায় কোটি কোটি টাকা ঢালে! হারভার্ডের ফেলো আর প্রফেসরের সঙ্গে মাঝে মাঝেই জগতের একশ’ বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়। কবিতা লিখি। আত্মজীবনী লিখি। প্রবন্ধ লিখি। দূরের কোনো অচেনা মানুষের জন্য প্রেমের চিঠি লিখি। আবার হারভার্ডের জন্য সেকুলারিজম এর ওপর একটা বড় লেখাও লিখতে হয়। মাঝে মাঝে এদিক ওদিক যাওয়া হয়, দেশে, দেশের বাইরে, ইউরোপে, কিছু না কিছুতে, পুরস্কার আনতে, নয়তো কবিতা
পড়তে, বক্তৃতা দিতে। বক্তৃতাটা বিশ্ববিদ্যালয়ে, বস্টন বিশ্ববিদ্যালয়ে, বক্তৃতা অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের জেনারেল অ্যাসেম্বলিতে, সঙ্গে জাতিসঙ্ঘের মানবাধিকার নেত্রী মেরি রবিনসন, বস্টনের কেমব্রিজ সেন্টারে কবিতা পাঠ, সঙ্গে ভ্যাজাইনা মনোলগ-এর ইভ এন্সলার, হারভার্ডের উইমেন স্টাডিস ডিপার্টমেন্টের ফাণ্ড রেইজেংএ সাহায্য করা, মাইকেল ইগনাটিফ বা স্যামুয়েল হান্টিংটঙের ক্লাস বা হারভার্ডে আসাবিখ্যাত অতিথিদের বক্তৃতা শোনা, নোয়াম চমস্কির সঙ্গে তাঁর এমআইটির ঘরে আড্ডা আর ইমেইলে ইরাক যুদ্ধ নিয়ে আলোচনা, যুদ্ধের প্রতিবাদে আমার লেখালেখি, দল বেঁধে বস্টনের ফেনওয়ে স্টেডিয়ামে গিয়ে রেড সক্সএর বিখ্যাত বেইসবল দেখা, হঠাৎ ক্যান্সারে আক্রান্ত দীর্ঘদিনের বন্ধু স্টিভ লেসিকে দেখতে যাওয়া, হারভার্ড চ্যাপলেন্সিতে মানববাদীদের সঙ্গে মানববাদ নিয়ে আলোচনা, সুয়ানি হান্টের বাড়িতে পাঁচমিশেলি অনুষ্ঠানে অংশ গ্রহণ করা, মাঝে মাঝে কিছুদিন নিউইয়র্ক, হঠাৎ আবার কলকাতা ঘুরে আসা বইমেলায়। আবার হারভার্ড।
.
এর মধ্যে খবর পাই বাংলাদেশ তেতে উঠেছে। বিবিসি খবরটা দেয়। কলকাতায় প্রকাশিত আমার আত্মজীবনীর তৃতীয় খণ্ড ‘দ্বিখণ্ডিত’র বাংলাদেশ সংস্করণের নাম ‘ক’। প্রথমে ‘ক’ ই ছিল নাম। পশ্চিমবঙ্গের প্রকাশক ‘ক’ নামটায় আপত্তি করায় নাম দিয়েছি”দ্বিখণ্ডিত। ‘ক’ বেরোবার সঙ্গে সঙ্গেই নাকি আগুন জ্বলছে। আমাকে যাচ্ছেতাই ভাষায় গালাগালি করা হচ্ছে সব পত্রিকায়। লেখক-শিল্পী-সাহিত্যিক আমার বিরুদ্ধে ক্লান্তিহীন নিন্দায় মেতে আছেন। কার কার সঙ্গে শুয়েছি তাই নাকি লিখেছি আমি বইয়ে, আমার মতো নির্লজ্জ বেশ্যা’ আর জগতে নেই। বইয়ের যে পাতায় লেখা আছে আমার ‘শোয়াশুয়ি’র ঘটনা, সেই পাতা ফটোকপি করে ছড়ানো হচ্ছে সবখানে। সৈয়দ শামসুল হক একবার আমাকে বেড়াতে নিয়ে গিয়েছিলেন দুরে। সেখানে গিয়ে আমার যে ধারণা জন্মেছে তাঁর সম্পর্কে, নিতান্তই তার নিটোল বর্ণনা ছিল এক জায়গায়। এ নিয়ে তাঁর রাগ করার কিছু আমি দেখি না। কিন্তু শুনেছি তিনি রাগে নাকি হায়েনার মতো করছেন। এ কথা প্রথম জানিয়েছিলেন মেজবাহউদ্দিন, বইয়ের প্রকাশক। তাঁর শ্যালিকার সঙ্গে তাঁর যে একটা গোপন সম্পর্ক আছে, তা আমার লুকোনো উচিত ছিল, কিন্তু আমি লুকোইনি। সৈয়দ হকের রাগের কারণ এটিই। শ্যালিকা নিয়ে লেখা বইয়ে একটিই বাক্য সম্ভবত আছে, ওই বাক্যটি পড়েই তিনি উত্তেজিত। আমি নাকি যা লিখেছি সব মিথ্যে, মামলা ঠুকে দিলেন ১০ কোটি টাকার। সাক্ষাৎকার দিচ্ছেন সবখানে, ‘তসলিমা আমার চরিত্র হনন করেছে। মান-সম্মান ধুলোয় মিশিয়ে দিয়েছে। ৫২ বছরে লেখক হিসেবে আমি যে সম্মান কুড়িয়েছিলাম তা আজ ধুলোয় ধূলিস্যাৎ। নিশ্চয়ই এর পিছনে কিছু রহস্য আছে। না হলে তিনি দেশের এত সম্মানিত লেখক ও সুশীল সমাজের প্রতিনিধিদের বিরুদ্ধে লিখতে সাহস পেতেন না। আমার মনে হয়েছে, প্রতিবাদ করা দরকার। তাই মামলা ঠুকে প্রতিবাদ জানালাম। তসলিমার বইয়ে এ ধরনের আরও যাদের নাম রয়েছে, আমি আশা করবো তারাও কোনো না কোনো পদক্ষেপ নেবেন। আমারটা আমি ভেবেছি, আইনের আশ্রয় নিয়ে করবো।’