বাবা যাই বলুন না কেন, এফসিপিএস এর জন্য পড়াশোনা আমার হয়ে ওঠে না। খুচরো ডাক্তারিতেই সময় কাটতে থাকে। কিন্তু এই ডাক্তারি নিয়েও দীর্ঘদিন মেতে থেকে একসময় দেখি আমি হাঁপিয়ে উঠছি, আমি অন্য কিছু একটা করতে চাই। সেই অন্য কিছুটা একদিন করে বসি। সকাল কবিতা পরিষদ নামে একটি সংগঠন করি। কবিতা পরিষদের কার্যালয় অবকাশের সামনের ঘরটি, যে ঘরটিতে একটি ক্লিনিক করার ইচ্ছে ছিল আমার।
০৩. জীবনগুলো
জীবন আমার দুটো শহরে ভাগ হয়ে যায়। ময়মনসিংহে বাড়ি, আত্মীয় স্বজন, চাকরি। ঢাকায় সাহিত্য, সংস্কৃতি, বন্ধুবান্ধব। ঢাকা আমাকে টানে খুব। হাতে টাকা হলেই বাসে নয়ত ট্রেনে চড়ি। ঢাকা যাওয়ার আরও একটি নতুন কারণ হল সুহৃদ। সুহৃদ এখন ঢাকায়। সুহদকে ঢাকা নিয়ে যাওয়া খুব সহজ ব্যপার ছিল না। ছোটদা এসে ওকে ধরে বেঁধে কাঁদিয়ে ভাসিয়ে নিয়ে গেলেন একবার, ঢাকার ইশকুলে ভর্তি করাবেন বলে। মাও বলেছিলেন, তিনি আর কুলিয়ে উঠতে পারছেন না। এরপর মা নিজেই ঢাকায় গিয়ে ছোটদা আর গীতার হাতে পায়ে ধরে ঘরের ছেলেকে ঘরে নিয়ে এলেন, অবশ্য হাতে পায়ে ধরার দরকার ছিল না, গীতা এমনিতেই ছেলেকে বিদেয় করতে পারলে বাঁচে। ওর আচরণ দেখে গীতা আকাশ থেকে পড়ে। এ ছেলে তার নিজের, এ ছেলেকে সে গর্ভে ধারণ করেছে দীর্ঘ নমাস, তার গর্ভ থেকেই গড়িয়ে নেমেছে ছেলে, নাড়ির বন্ধন যদি থাকে কারও সঙ্গে, তা তার সঙ্গেই আছে, কিন্তু সে ডাকলে ছেলে কাছে আসবে, ঝাঁপিয়ে পড়বে তার কোলে, তা নয়ত দৌড়ে পালায়। চলে যায় ওর দাদুর কোলে নয়ত ফুপুদের কাছে। এত সাহস এই ছেলে পেল কোত্থেকে, গীতা বুঝে পায় না। রেগে গা আগুন করে বসে থাকে, গা থেকে ধোঁয়া বেরোয়। সেই ধোঁয়ার ভেতর থেকে গীতা চিৎকার করতে থাকে, ‘তোমার গুষ্ঠির মধ্যে পইড়া আমার ছেলে নষ্ট হইয়া গেছে। তাগর যদি এত ছেলে দরকার থাকে, তাইলে তারা বিয়াইয়া লউক একটা। গীতার সামনে হাঁটু গেড়ে বসে ছোটদা বলতে থাকেন, গীতা ও গীতা, আমি তোমার ছেলেকে তোমার কাছে যেমনেই হোক আইন্যা দিতাছি।’ এরকম শপথে গীতার মন ভরে না, ছোটদা তার মন ভরানোর জন্য বলেন যে সব দোষ তাঁর, তাঁর দোষেই আজ গীতাকে কষ্ট পেতে হচ্ছে, তাঁর উচিত ছিল না ছেলেকে জন্মের পর অবকাশে পাঠানো, তাঁর দোষেই আজ গীতার নিজের ছেলে আজ গীতার কাছ ঘেঁসতে চায় না। তাঁকে আরও বলতে হয় যে তাঁর মা আর তাঁর দু বোনের কারণে সুহৃদ নষ্ট হয়ে গেছে, ওকে মানুষ করতে হলে এখন গীতা ছাড়া গতি নেই। গীতা শোনে। চিৎকার আপাতত থামিয়ে সে ওঠে, ঢকঢক করে এক গেলাস জল খেয়ে সে ছোটদাকে ঘর থেকে বের করে শব্দ করে শোবার ঘরের দরজা বন্ধ করে টাকা পয়সা গয়নাগাটি আর শাড়িতে ঠাসা আলমারি খুলে ইস্ত্রি করা সুতির শাড়িগুলোর কিনার দিয়ে হাত ঢুকিয়ে সুহৃদের ছবির অ্যালবাম বের করে অবকাশে আমাাদের সঙ্গে তোলা ওর সব ছবি ছিঁড়ে টুকরো করে, আস্ত রাখে কেবল তার সঙ্গে সুহৃদের ছবিগুলো।
সুহৃদকে নিয়ে অবকাশে আমাদের আবেগ আর উচ্ছঅ!সের শেষ নেই। কদিন পর পরই ওর ছবি তোলা হয়, ইয়াসমিন তার এক বান্ধবীর ভাইয়ের খোঁজ পেয়েছে, যার স্টুডিওর দোকান আছে, সেই ভাইয়ের ক্যামেরা এনে প্রচুর ছবি তুলে যেদিন নিয়ে এল ছবিগুলো, হুমড়ি খেয়ে একেকজন দেখতে থাকি, গীতা সেদিনই ছোটদাকে নিয়ে আসে ময়মনসিংহ, ছবিগুলো আমাদের মত অত উৎসাহ নিয়ে দেখে না, না দেখলেও উৎসাহ নিয়েই বলে, ছবিগুলো সব যেন তাকে দিয়ে দেওয়া হয়। কারণ আমরা তো সুহৃদকে জলজ্যান্ত পাচ্ছি, সে যেহেতু পাচ্ছে না, ছবি দেখেই তার সাধ মেটাতে হবে। এ কথাটি ঠিক সে বলেও না, আমরাই অনুমান করে নিই। অনুমান করে সুহৃদের যত ছবি যেখানে ছিল, সবই তাকে উদার হস্তে দান করা হয়। এই দানে মার আহা আহা-ভূমিকা ছিল সবচেয়ে বড়। সেই বিকেলেই ইয়াসমিনের বান্ধবী কৃষ্টি এলে ইয়াসমিন যখন সুহৃদের ছবিগুলো গীতার কাছে চায় কৃষ্টিকে দেখাবে বলে, গীতা মুখের ওপর বলে দেয়, না, ছবি এখন দেওয়া যাবে না, কেন যাবে না? যাবে না। কারণ কি? অসুবিধা আছে। কি অসুবিধা? আছে। কাউকেই ছবি দেখতে দেয়নি। ব্যাগে করে সে ঢাকা নিয়ে এসেছিল। তারপর এই তার ছিঁড়ে ফেলা। নিগেটিভগুলোও কেটে টুকরো করে রান্নাঘরের ময়লা ফেলার ঝুড়িতে ফেলে রাখল। এতে তার মন আপাতত শান্ত হয়, কিন্তু হাতগুলো নিশপিশ করতে থাকে, হাতগুলোর ইচ্ছে করে নখের আঁচড়ে আমাকে, ইয়াসমিনকে আর মাকে রক্তাক্ত করতে। কী দোষ আমাদের! নিশ্চয়ই আমাদেরই দোষ, আমরা অন্যের বাচ্চাকে নিজের বাচ্চা বানিয়ে নিয়েছে, এই দোষ আমাদের। আদরে আহলাদে মানুষ হওয়া সুহৃদ এমনিতেই কারও ডাকে পেছন ফেরে না, মা যে কত ডাকেন সুহৃদ যখন দৌড়ে ছাদে বা মাঠে চলে যেতে থাকে, ভয়ে যে কখন আবার কোথাও পড়ে গিয়ে ব্যথা পায়, সুহৃদ ফেরে না। বাতাসের আগে আগে ছোটে সে, যখন ছোটে। কিন্তু গীতার প্রশ্ন সে তার ছেলেকে ডাকলে ছেলে তো শুনতে বাধ্য, কিন্তু ছেলে কেন শোনে না তার ডাক? কেন দাঁড়াতে বললে দাঁড়ায় না, বসতে বললে বসে না! সুহৃদের অবাধ্য আচরণ দেখে গীতা ভীষণ ক্ষুব্ধ, বিরক্ত। পৃথিবীর আর কেউ ডাকলে সুহৃদ না ফিরুক, কিন্তু গীতা যখন ডাকে, তখন তো ওর জানা উচিত কে ওকে ডাকছে! ও কি জানে না গীতা কে! গীতা বিষম রোষে দাপায়, সুহৃদকে হাতের কাছে পেয়ে হ্যাঁচকা টেনে কাছে এনে চোখ রাঙিয়ে দাঁত খিঁচিয়ে বলেছে, ‘আমি যে তোমার মা হই, তা জানো? আমি যে তোমার সবচেয়ে বেশি আপন, তা জানো? আমি ডাকলে সঙ্গে সঙ্গে আসো না কেন? কারণ কি? এরপর আমি একবার ডাক দিলেই সঙ্গে সঙ্গে আমার কাছে আইসা দাড়াইবা, মনে থাকবে?’ সুহৃদ হতবাক দাঁড়িয়ে মনে থাকবের মাথা নেড়ে দৌড়ে গিয়ে মার আঁচলের তলে নিজেকে লুকিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদে। ওর কান্না দেখে বুক ফেটে যায় আমাদের। মা প্রতিদিনই ওকে বলেন, নিজের বাবা মাকে যেন ও ভালবাসে। তবে গীতাকে যখন মা রিমঝিম সুরে বলতে নিচ্ছিলেন, ‘আদর কইরা কইলেই তো ছেলে বুঝে..।’ গীতা বজ্রপাত ঘটায়, ‘আমার ছেলেরে আদর কইরা বলি কি মাইরা বলব, সেইটা আমি বুঝব।’ মা চুপ হয়ে যান। আমরাও চুপ হয়ে বসে থাকি। অনেকক্ষণ চুপ থেকে মা বলেন, ‘ছেলে এইখানে থাকে বইলা আমাদের চেনে, আমাদের কাছে আসে, আমাদের প্রতি টান তার। তুমি যখন নিয়া যাইবা ওরে, তখন তোমার প্রতিও টান হইব। তখন তো তোমার কাছ থেইকা ও আমাদের কাছেই আসতে চাইব না।’ গীতা দুদিনের জন্য অবকাশে বেড়াতে এসে সুহৃদকে বশংবদ ভৃত্য বানানোর জন্য চেষ্টা করতে থাকে। গীতার হাত থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য সুহৃদ ছটফট করে। এরপর ছোটদা আর গীতা যখনই সুহৃদকে ঢাকা নিয়ে যাওয়ার কথা বলেছে, ও ভয়ে কেঁপে আমাদের আঁকড়ে ধরে কানে কানে বলেছে, ‘আমাকে কোথাও লুকাইয়া রাখো, আমাকে যেন না নিয়া যাইতে পারে।’ আমরা ওকে লুকিয়ে না রাখলে ও নিজেই লুকোনোর জায়গা খুঁজে খুঁজে টিনের ঘরের খাটের নিচে কাগজের বাক্সের মধ্যে নিজেকে সারাদিন লুকিয়ে রেখেছে। গীতা লক্ষ্য করে অবকাশের মানুষগুলোই সুহৃদের আপন এবং ঘনিষ্ঠ, সুহৃদ তাদেরই ভালবাসে, গীতার জন্য ওর কোনও ভালবাসা নেই। গীতা ওর কাছে মূর্তিমান রণচণ্ডী বিভীষিকা ছাড়া, ভয়ংকর ত্রাস ছাড়া কিছু নয়। সুহৃদকে টেনে হিঁচড়ে আলাদা ঘরে ডেকে নিয়ে গত কয়েক যাত্রা গীতা বলে আসছে, ‘এই দুনিয়ার কেউ তোর আপন না, আমি ছাড়া।’ সুহৃদ ফ্যালফ্যাল করে গীতার দিকে তাকিয়ে দৌড়ে পালাতে চায়, গীতা সাঁড়াশির মত ধরে রাখে ওর ঘাড়। কেঁদে ওঠে সুহৃদ, কান্না দেখে গীতার ইচ্ছে হয় বেয়াদব ছেলেটিকে খুন করতে।