মানুর এই চরিত্রের কথা আমি জেনেছি ইয়াসমিনের কাছ থেকে। ইয়াসমিনের জেনেছে তার সহপাঠী বন্ধু মিলনের কাছ থেকে, মিলন মানুরই আপন ছোট ভাই। এর চেয়ে ভাল আর কী প্রমাণ থাকতে পারে।
শিপ্রাকে আমি বলেছি, ‘দেখ এত উন্মাদ হয়ো না, মানু শুধু তোমাকে ভোগ করতে চায়, তোমাকে সে ভালবাসে না।’
‘কিন্তু মানু তো আমাকে বলেছে যে সে আমাকে ভালবাসে।’
‘মিথ্যে বলেছে।’
শিপ্রা মিথ্যে বলে না, তাই সে ভেবেছে অন্যরাও বুঝি মিথ্যে বলে না।
‘তোমার সঙ্গে শুয়ে সে আনুর বাড়িতে আনুর সঙ্গে শুতে যায়, তারপর আনুর বাড়ি থেকে এসে শিরিনের সঙ্গে শোয়।’
‘মানু আমাকে বলেছে, এক আমার সঙ্গে শারীরিক সম্পর্ক ছাড়া আর কারও সঙ্গে তার এই সম্পর্ক নেই।’
এরপর শিপ্রা উঠে পড়ে লাগে সত্যতা যাচাই করতে। মানু এদিকে কোরান শরীফ মাথায় নিয়ে কসম কেটে বলছে আনুর সঙ্গে তার কোনও সম্পর্কই নেই, আনুর ছায়া মাড়ায় না মানু, কথা বলা তো দূরের কথা। শিপ্রা কোরানে বিশ্বাস না করলেও মানু করে। কোরানে বিশ্বাস করা লোক কোরান নিয়ে মিথ্যে কথা বলতে পারে না, শিপ্রার ধারণা। কিন্তু একদিন শিপ্রা একটি অদ্ভুত কাজ করে। সে তার গায়ে একটি কালো বোরখা চাপিয়ে, বাসে করে মুক্তাগাছায় গিয়ে, মুক্তাগাছা স্বাস্থ্য কেন্দ্রে, যেখানে মানু আর আনু দুজনেই চাকরি করে, ঢোকে। রোগীদের কাতারে দাঁড়িয়ে থাকে রোগীর মত। বোরখার আড়াল থেকে লক্ষ্য করে মানু আর আনুকে। মানু আর আনু দুজনে গল্প করছে, হাসছে । শুধু দেখাই তার উদ্দেশ্য ছিল না, দেখা দেওয়াও ছিল উদ্দেশ্য। হঠাৎ মানু আর আনুর সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে শিপ্রা বোরখার মুখটি চকিতে খুলে ফেলে। মানু ভূত দেখার মত চমকে ওঠে। দুজনকে হাতে নাতে ধরার পরই শিপ্রার সঙ্গে মানুর সম্পর্ক শেষ হতে পারতো কিন্তু হয় না। মানু ক্ষমা টমা চেয়ে কেঁদে কেটে একাকার করে শিপ্রাকে আবার বশে আনে।
যে শিপ্রা হিসেব করে জীবন চলত, যে শিপ্রা যে কোনও কিছুতেই উদ্বিগ্ন হত, সেই শিপ্রা কী ভীষণ রকম পাল্টো গেছে! আমাদের বয়সী ডাক্তাররা এফসিপিএসএ ভর্তি হবার জন্য দিন রাত পড়াশোনা করছে জেনেও শিপ্রা কোনও আগ্রহ দেখায় না এফসিপিএসএর জন্য। তার নাওয়া খাওয়া সব গোল্লায় গেছে। শরীর শুকোচ্ছে। সুন্দর মুখটিতে কালো কালো দাগ পড়ছে। যে শিপ্রা প্রাণখুলে হাসতো, অন্যদের হাসাতো, যার রসবোধ ছিল অতুলনীয়, সেই শিপ্রা শুকনো মুখে বসে থাকে মরা গুঁড়ির মত, শূন্য চোখে তাকিয়ে থাকে রং ওঠা দেয়ালের দিকে। মানুর জন্য পাগলের মত কাঁদে সে। যার আত্মমর্যাদা বোধ ছিল অত্যন্ত প্রখর, সে ই কি না নিজেকে অপমানিত হতে দিচ্ছে একটা অসৎ অর্থলোভীর কাছে। মানু এর মধ্যেই নদীর পাড়ে একটি চেম্বার খুলে বসেছে, রিক্সাঅলা-দালালদের দিয়ে গুদারাঘাটে গ্রাম থেকে শহরে ডাক্তার দেখাতে আসা রোগী ধরে আনে। খামোকা রোগীর মল মুত্র রক্ত পরীক্ষা করার নাম করে রোগীর কাছ থেকে প্রচুর টাকা খসিয়ে নেয়। শিপ্রা দেখে সব, দেখেও তার চক্ষু বুজে থাকে। তার চলাফেরা নিয়ে কে কি বলল না বলল এ নিয়েও তার কোনও উদ্বেগ নেই। সে যে করেই হোক, যা কিছুর বিনিময়েই হোক, মানুকে চায়। মানু শিরিনকে আজ তালাক দেবে, কাল দেবে করে করে বছর চলে যাচ্ছে তালাক দিচ্ছে না। শিপ্রা কি বোঝে না এসব! বোঝে না যে মানু তাকে ধোঁকা দিচ্ছে! আসলে সে কোনওদিনই ওই গর্দভ বউটিকে তালাক দেবে না! শিপ্রার এই বোধবুদ্ধিহীন প্রেমটি দেখলে আমার বড় বিরক্তি ধরে।
একদিন শিপ্রা আমার বাড়ি এসে অনেকক্ষণ বসে থাকে। অনেকক্ষণ কাঁদে, একসময় দীর্ঘ শ্বাস ফেলে বলে, ‘জীবনে আমি অন্তত একবার অরগাজমের স্বাদ পেতে চাই।’ আমি তো অবাক, ‘বল কি! তুমি অরগাজম পাওনি আজও?’
শিপ্রা বলল সে পায়নি। হুমায়ুনের কাছ থেকে তো প্রশ্ন ওঠে না। মানু যেহেতু সঙ্গমে পটু, দীর্ঘক্ষণ, চাইলে দুঘন্টাও চালিয়ে যেতে পারে, মানুর পক্ষেই হয়ত সম্ভব তাকে অরগাজম দেওয়া।
শিপ্রার ওপর আমার রাগ হয় আবার মায়াও হয়।
অরগাজম নিয়ে এরপর আমি একটি জরিপ চালিয়ে দেখেছি বেশির ভাই মেয়েই জানে না জিনিসটি কী। শিপ্রা কোনওদিন এটি না পেলেও জানে অরগাজম বলে একটি ব্যপার আছে. তাই সে এটি পেতে চায়। যারা জানে না এটি কি জিনিস, তারা তো কোনওদিন এটি চায়ও না।
আমার জীবন কেবল শিপ্রার ব্যক্তিগত সুখ দুঃখ নিয়ে কাটে না। নিজের ডাক্তারি বিদ্যেটি কাজে লাগানোর জন্য আমি যত রকম চেষ্টা করা যায়, করতে থাকি। নাম ডিগ্রি লিখে রোগী দেখার সময় উল্লেখ করে একটি সাইনবোর্ড লিখিয়ে অবকাশের কালো ফটকে টানিয়ে দিই। জমান প্রিন্টার্স থেকে ডাক্তার লেখা প্যাড করেও নিয়ে আসি। সবই হয়। রোগীও আসতে শুরু করে। কিন্তু পাড়ার রোগী, চেনা মুখ। যখনই ওরা ডাক্তারের ফি দিতে যায়, লজ্জায় আমার কান লাল হয়ে যায়। কান যেন লাল না হয়, কানের রং যেমন আছে, তেমন যেন থাকে তার জন্য চেষ্টা করেছি, তারপরও লাল হওয়া কমেনি। পাড়ার লোকের কাছ থেকে টাকা নিতে হাত ওঠে না, প্রেসক্রিপশান লিখে হাত টেবিলের তলায় গুটিয়ে রাখি। এরপর আরও একটি শখ হয় আমার। শখটি একটি ক্লিনিক করার। বেদনা নাশক ব্যবহার করে প্রসূতিদের সন্তান প্রসব করানোর জন্য অবকাশের সামনের ঘরটিকে ছোটখাটো একটি ক্লিনিক করার স্বপ্ন নিয়ে বাড়ির উঠোনে একটি পড়ে থাকা বড় একটি টিন ধুয়ে মুছে রং করিয়ে ডাক্তার তসলিমা নাসরিন, এম বি বি এস, বি এইচ এস(আপার), স্ত্রীরোগ ও প্রসূতিবিদ্যায় বিশেষ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত, এখানে বেদনা নাশক ব্যবহার করে বাচ্চা ডেলিভারি করা হয় ইত্যাদি লিখিয়ে আনি গোলপুকুর পাড়ে জয়ন্ত তালুকদারের দোকান শিল্পশ্রী থেকে। যেদিন সাইনবোর্ডটি অবকাশের সামনে টাঙালাম, সেদিনই বাবা এটি খুলে বারান্দায় এনে রেখে বললেন ক্লিনিক শুরু করতে গেলে লাইসেন্স লাগে, যেখানে সেখানে ক্লিনিক বসিয়ে দিলেই হয় না। ডাক্তারি করার জন্য আমার অতি-উৎসাহ দেখে বাবা নিজেই আমাকে একটি চাকরি দিলেন, চাকরি পেয়ে আমি মহাখুশি। তাঁর চেম্বারের বারান্দায় ছোট একটি ঘর বানিয়ে একটি প্যাথলজি ক্লিনিক দিয়েছেন, টেবিলে মাইক্রোসকোপ, তাকে লাল নীল শিশি সাজানো। বিকেলে সেখানে বসব। তিনি তার রোগীদের মলমুত্রকফথুতু পাঠাবেন আমার কাছে, আমি পরীক্ষা করে দেব। কুড়ি টাকা করে পাবো প্রতি পরীক্ষায়। এসময় বাবার সঙ্গে আমার বেশ সখ্য গড়ে ওঠে। রাতে বাড়ি ফিরে বাবা আমার সঙ্গে মাঝে মাঝে দাবা খেলতে বসেন, অবশ্য আমাকে হারিয়ে দিতে তাঁর খুব বেশি সময় কখনও লাগে না। সে এক দেখার বিষয় হয় আমাদের দাবা খেলা। বাড়ির সকলে আমার পক্ষে, বাবার পক্ষে কেবল এক বাবাই। মা খুব চান আমি যেন বাবাকে হারিয়ে দিই। বাবা আমার ঘোড়া খেয়ে নিলেন তো মা অস্থির হয়ে বলতে থাকেন, ইস, ঘোড়াটা আগেই সরাইয়া ফেলতা, দেখ না তোমার বাবা কেমনে চিন্তা কইরা খেলে। তুমি চিন্তা ছাড়াই গুটি সরাও কেন? আমি হারলে আমি আর কত, আমার চেয়ে অনেক বেশি নিরানন্দে ভোগেন মা। বাবার প্যাথলজিতে গিয়ে মলমুত্র পরীক্ষায় একসময় ভাটা পড়ে যখন পপুলার ক্লিনিক থেকে কল আসা শুরু হয়। পুপুলার ক্লিনিকটি সি কে ঘোষ রোডে, দাদার বাচুপান কা দোস্ত জাহাঙ্গীর ক্লিনিকের মালিক। ওখানে ডাক্তারি ভাষার মেনস্ট্রুয়েশন রেগুলেশন, সংক্ষেপে এমআর, সাধারণের ভাষায় এবরশান করাতে আসে মেয়েরা, তাদের জন্যই আমার ডাকা। প্রতি এমআরে তিনশ টাকা দেওয়া হয় আমাকে। বাকি এক হাজার বা বারোশ টাকা ক্লিনিক নিয়ে নেয়। এম আর এ আমার হাত মোটেও পাকা ছিল না। এ বিষয়টি ডাক্তারি শাস্ত্রের তেমন কোনও জরুরি বিষয় নয়। একটি মোটা মত সিরিঞ্জে উল্টো চাপ দিয়ে জরায়ুর ভেতরের ভ্রূণ বের করে নিয়ে আসতে হয়। অপারেশন থিয়েটারে নার্সরাই রোগীকে টেবিলে শুইয়ে তৈরি করে রাখে, আমাকে শুধু গিয়ে হাতে গ্লবস পরে ব্যপারটি সারতে হয়। প্রথম প্রথম দুএকজন রোগীর জরায়ু পরিষ্কার হয়নি, ইনফেকশনে ভুগেছে, আবার ফেরত গেছে ভেতরের রয়ে যাওয়া জিনিস বের করতে। ওই দুএকটি দুর্ঘটনা দেখে আমি মরমে মরেছি। ধীরে ধীরে হাত পেকে যায় এমআরে। ছায়াবাণী সিনেমার কাছে সেবা নার্সিং হোমেও আমার ডাক পড়ে এমআর করার জন্য। বাড়তি টাকা উপার্জন হচ্ছে বেশ। বাবা ডাক্তারি ব্যপার নিয়ে আমার আগ্রহ উসকে দেন তবে ছোটখাটো চাকরি আর খুচরো কিছু এবরশান নিয়ে আমার পড়ে থাকা তিনি চান না, চান আমি পড়াশোনা করি। এফসিপিএস ডিগ্রি নিই। এফসিপিএস না পাশ করলে এমবিবিএস দিয়ে কাজের কাজ কিμছু হবে না। চিরকাল গাঁওগেরামের ডাক্তার হয়ে থাকতে হবে। এমবিবিএস আজকাল অলিতে গলিতে পাওয়া যায়। সত্যিকার ডাক্তারি করতে চাইলে এক্ষুনি যেন আদা জল খেয়ে যেন বই নিয়ে বসে পড়ি এফসিপিএসে ভর্তি হওয়ার জন্য। বই নিয়ে আমার বসা হয়, তবে ডাক্তারি বই নয়, কবিতার বই নিয়ে। বাবা প্রতিদিনই আমার ক্লাসের কোন কোন ছেলে মেয়ে পিজিতে পোস্ট গ্রাজুয়েশান করতে গেছে তার খবর নিয়ে আসেন আর আমার জন্য হা হুতাশ করেন। আমার শখের ডাক্তারি করার ইচ্ছেকে তিনি প্রথম প্রথম আসকারা দিলেও অথবা বাধা না দিলেও, বাধা না দেওয়াই আমাদের কাছে একরকম আসকারা, অপছন্দ করা শুরু করলেন। পপুলার ক্লিনিক আর সেবা নার্সিং থেকে যে তিনশ টাকা করে আয় করি, ও নিয়েও একদিন ভেঙচি কাটেন, হু, এফসিপিএস পাশ করলে একটা অপারেশন কইরাই তিন লাখ টাকা পাইতি। বাবা নিজের কথা বলেন, তিনি একটি গরিব কৃষকের ছেলে হয়ে কৃষক না হয়ে ডাক্তার হয়েছেন। তিনি এমবিবিএস ডাক্তার, তাঁর সন্তান কেন এমবিবিএসে পড়ে থাকবে! সে এফসিপিএস ডাক্তার হবে, বিদেশে গিয়ে এফআরসিএস এফআরসিপি ডিগ্রি নিয়ে আসবে। পড়াশোনার এমন সুযোগ আমি নষ্ট করছি খামোকা, এ তিনি মেনে নিতে পারেন না। যে সময় যাচ্ছে, সে সময় আর যে ফিরে আসবে না, যে সুযোগ আমি নষ্ট করছি, সে সুযোগ যে আমি আর পাবো না তা তিনি দিনে দশবার করে বলতে থাকেন।