আমি বললাম, তাকে সেই ছোটবেলায় দেখেছো, এখন কি মিলবে তোমার মনের সঙ্গে? দেখ ভেবে।
শিপ্রা ভাবতে বসল। হুমায়ুন মস্কোয় মানুষের ডাক্তার না হলেও মানুষের দাঁতের ডাক্তার হয়েছে, এ আর এমন কি খারাপ! সাধারণত মানুষের ডাক্তাররা গরুর ডাক্তার, দাঁতের ডাক্তার এসব হাবিজাবি ডাক্তারদের পাত্তা দেয় না। কিন্তু শিপ্রা এমন মরিয়া হয়ে উঠেছিল যে শেষ পর্যন্ত সে হুমায়ুনকে মস্কোতে একটি চিঠি পাঠিয়ে দেয়, ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে কোনও কথা নয়, একেবারে সরাসরি, আমি তোমাকে বিয়ে করতে চাই। হুমায়ুন কোনও এক কালে উলুঝুলু চোখে তাকিয়েছিল তার দিকে, সেটিকে সম্বল করেই শিপ্রার এই আবেদন। হুমায়ুন রাজি হওয়ার পর শিপ্রা আর দেরি করেনি, সোজা উড়ে গেছে মস্কোয়, ওখানে বিয়ে করে মাস দুয়েক স্বামীর হোস্টেলে কাটিয়ে পেটে বাচ্চার ভ্রুণ নিয়ে দেশে ফিরেছে। শিপ্রার বাচ্চা হয় জোবায়েদ হোসেনের হাতে। বাচ্চাটি দেখে তিনি বলেছিলেন, হাতির পেট থেকে মুষিক বেরিয়েছে রে। মুষিকের নাম শিপ্রা রাখে আনন্দ। আনন্দ তার নানির যত্নে বড় হচ্ছে। শিপ্রা চাকরি করছে, মানুর সঙ্গে প্রতিদিনই তার দেখা হচ্ছে। মানুরও একটি ছেলে আছে, নাম হৃদয়। মানুর মত লোক ছেলের নাম হৃদয় রাখতে পারে, খানিকটা আশ্চর্যই হয়েছিলাম। মানুর মুখখানা সুন্দর হলেও, শরীরখানা মেদহীন হলেও, কথা বলতে গিয়ে ময়মনসিংহি আঞ্চলিকতার বাইরে একটি শব্দও উচ্চারণ করতে পারে না, শিপ্রা বলছে যেতে হবে, মানু বলছে যাইতে অইব। শিপ্রার সাহিত্য সংস্কৃতি বিষয়ে উৎসাহ থাকলেও মানুর সামান্যতমও নেই। লম্বায় শিপ্রার চেয়ে দু ইঞ্চি খাটো খাঁটি ময়মনসিংহি গাট্টাগোট্টা কালচে মানু যখন ঝড়ের বেগে মোটরসাইকেলে শহর চষে বেড়ায়, দেখে যে কেউ বলবে ডাক্তার না হয়ে পাড়ার মাস্তান হলে তাকে মানাত বেশি। মানুর কোটরে আর কিছু নয়, পরিস্কার দুটো গরুর চোখ। এমন চোখ ছেলেদের মুখে ঠিক মানায় না। মানায় না বলেই মানুর ইস্পাতি শরীরটির কাঠিন্য চোখদুটোই আড়াল করে রাখে। শিপ্রা ভুলেই গেছে স্বামী বলে একটি বস্তু তার আছে, বস্তুটি একদিন মস্কো থেকে ফিরে আসবে দেশে, বস্তুটি তাকে আর তার ছেলে আনন্দকে নিয়ে একটি সংসার গড়ে তোলার স্বপ্ন নিয়ে ফিরবে। হুমায়ুনের স্বপ্ন নিয়ে শিপ্রা মোটেও উদ্বিগ্ন নয় বস্তু নিয়ে, উদ্বিগ্ন মানুকে নিয়ে। মানু তাকে সত্যি ভালবাসে তো! আমার কাছে জানতে চায় কী মনে হয় আমার, মানু তাকে ভালবাসে কি না। আমি কি করে বলব, মানুর মনে কি আছে। তখন একবার কেবল দেখেছি তাকে, শিপ্রা পরিচয় করিয়ে দিতে চেয়েছে, মানু তাকে থামিয়ে উনারে চিনি ত! বলে আমার দিকে তেরচা চোখে সব জানি ভঙ্গিতে তাকিয়ে ডাক্তার রজব আলী ত আপনের বাবা বলে দৃষ্টিটি আমার মুখ থেকে সরিয়ে শিপ্রার মুখে মুহূর্তের জন্য ফেলে, তা থেকেও আবার সরিয়ে হাতের একটি কাগজে ফেলল। কাগজটি জরুরি কোনও কাগজ নয়, কিন্তু মানুর কাছে তখন খুবই জরুরি। শিপ্রার মুখে সেদিন মিষ্টি মিষ্টি হাসি আর মানুর মুখে বিন্দু বিন্দু ব্যস্ততার ঘাম। ঘাম মুছে ফেললেই হত, মানু মুছে ফেলেনি। আমি খুব নিশ্চিত হতে পারিনি মানুর আদৌ কোনও দুর্বলতা আছে কি না শিপ্রার জন্য। শিপ্রার এই মানু-প্রেম গড়িয়ে গড়িয়ে আপিসের অঙ্গন ছাড়িয়ে যায়। অবকাশের ধূলির ওপর শিপ্রার পদধূলির আস্তর জমে ওঠে। দীর্ঘক্ষণ মানুর লাল মোটর সাইকেলের দাঁড়িয়ে থাকায় অবকাশের মাঠের ঘাস জন্মের মত মাটির সঙ্গে মিশে যেতে থাকে। বৈঠকঘরে বসে তারা সময় কাটাতে থাকে কথা বলে, তর্ক করে, অভিমান করে, রাগ করে, হেসে, কেঁদে, ঠাট্টা করে, চিমটি কেটে, কালপরশুর জন্য প্ল্যান করে। একসময় আমার বৈঠকঘর তাদের জন্য মোটেও প্রয়োজন হল না। কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক এলাকায় শিপ্রার বাড়ির মাঠেই মানুর মোটর সাইকেল থামতে থামতে ওখানের ঘাসগুলোকে চিড়ে চ্যাপ্টা করে, হলুদ করে, মেরে, মাটির তলায় ডুবিয়ে দিতে থাকে। মানুর সঙ্গে তখন আর খুনসুটি নয়, রীতিমত বিছানায় গড়াগড়ি যায় শিপ্রা। গভীর রাতে মানু বাড়ি ফিরে যায়। শিপ্রার মা পাশের ঘরে বসে শব্দ শোনেন সবকিছুর, মোটর সাইকেল আসার যাওয়ার, শিৎকারের চিৎকারের। কিন্তু মেয়ের জীবনে তিনি নাক গলাতে পছন্দ করেন না। মেয়ে তাকে বলে দিয়েছে, ওই হুমায়ুনের সঙ্গে শোয়া আর না শোয়া সমান কথা, ও লোক মোটেও তাকে তৃপ্ত করতে পারে না। শিপ্রা আমাকে নিখুঁত বর্ণনা করেছে বিছানায় হুমায়ুনের ভূমিকা — উঠল, কী করল সে নিজেই জানে, নেমে পড়ল। শিপ্রা তার শরীর খানা আর হুমায়ুনের জন্য খরচ করতে চায় না।
হুমায়ুন পাকাপাকিভাবে দেশে ফেরার পরও মানু গিয়েছে শিপ্রার বাড়িতে, স্বামীর সামনেই শিপ্রা মানুর সঙ্গে ঘন হয়ে বসেছে, ফিসফিস করেছে, ঢলে পড়েছে মানুর শরীরে হাসতে হাসতে। সে পারে না নিজের আবেগের আগুন কোনও কিছু দিয়ে চাপা রাখতে। দাউ দাউ করে যার তার সামনে লাল জিভ বেরিয়ে আসে। হুমায়ুনের সঙ্গে রাতে সে ভাই বোনের মত পাশাপাশি শুয়ে ঘুমোয়, শরীরে হুমায়ুনের হাত তো নয় হাতের ছায়া পড়ার আগেই শিপ্রা বলে ওঠে, বিরক্ত কোরো না তো!
হুমায়ুন রাজশাহীতে চলে গেল দাঁতের একটি ক্লিনিক তৈরি করতে। হুমায়ুনের কি হবে না হবে তার কিছুই না ভেবে শিপ্রা মানুর জন্য দিন দিন উন্মাদ হয়ে ওঠে। মানু শিপ্রাকে বলেছে যে তার বউকে সে তালাক দিয়ে শিপ্রাকে বিয়ে করবে। শিপ্রা বিশ্বাস করেছে সব। শিপ্রা জানে না যে মানুর সঙ্গে তার সাদামাটা ধার্মিক ডাক্তার বউ শিরিনএর খুব ভাল সম্পর্ক, আনু নামের এক ডাক্তারকে সে অনেকটা রক্ষিতা হিসেবে রেখেছে এবং শিপ্রাকে সে ব্যবহার করছে প্রেমিকা হিসেবে। মানু প্রতিদিন তিন রমণীকে ভোগ করে যাচ্ছে, এবং তিনজনকেই সে তিন রকম ভাবে ভালবাসার কথা শোনাচ্ছে। শিপ্রা জানে না যে মানু আসলে কাউকেই ভালবাসে না, ভালবাসে কেবল নিজেকে।