নাইমের সঙ্গে ওই শোয়াশোয়ির শুরুতেই ঘটনা বা দুর্ঘটনাটি ঘটে। রুদ্রর সঙ্গে দীর্ঘদিন শুয়েও যে ঘটনাটি ঘটেনি, তা নাইমের সঙ্গে দুদিন শুয়েই ঘটে যায়। পেটে বাচ্চা আসে। সারা শরীরে আশ্চর্য এক পরিবর্তন লক্ষ করি। মনেও। যেন এ আমি অন্য আমি। এ আমাকে আমি চিনি না। নিজের রূপান্তরিত এই অস্তিত্বটি অভাবিত এক শিহরণ সৃষ্টি করে আমার ভেতর। এই রূপটিকে আগে কখনও আমি কল্পনা করিনি। ভয়, লজ্জা, সুখ, স্বপ্ন, সব বিজলির মত চমকাতে থাকে আমার আকাশ জুড়ে। নাইম আমাকে অনেক চমকে দিয়েছে। কিন্তু এবারের চমকটি ভিন্ন। এই চমকটির কোনও তুলনা হয় না।
চল ক্লিনিকে চল।
ক্লিনিকে কেন?
এবরশন করতে চল।
মানে?
মানে কিছু না। এবরশন করতে হইব।
এবরশন করতে হইব কেন?
আরে এহনই আবার বাচ্চা কাচ্চা কি? এইসব পরে চিন্তা করলেই হইব।
আমার কোনও আপত্তি নাইম মানে না। সে আমাকে গুলশানের একটি ক্লিনিকে টেনে নিয়ে গিয়ে আমার গর্ভপাত ঘটায়। আমি জানি কেন ঘটায় সে এটি। তার ধারণা, ভ্রূণের জন্য যে স্পার্মের প্রয়োজন হয়, তা অন্য কোথাও থেকে আমি সংগ্রহ করে এনেছি। নাইমের জন্য আমার মায়া হয়, সন্দেহের মন তার নিজের বাচ্চাকে মেরে ফেলতে দ্বিধা করেনি। সন্দেহ এমনই এক ভয়ংকর আগুন, আমি পুড়ে ছাই হয়ে যেতে থাকি। আমি কোথায় যাচ্ছি, কার সঙ্গে কথা বলছি, কে আমাকে জন্মদিনে কি উপহার দিচ্ছে, কেন দিচ্ছে এসব নিয়ে সন্দেহের চোখ ক্রমশ বাঘের মত হতে থাকে, আমাকে ছিঁড়ে খেতে চায় সে চোখ। মায়া হয় নাইমের জন্য, তার সন্দেহের মন এ কথা তাকে বুঝতে দেয় না যদি কারও সঙ্গে আমার কোনও রকম শারীরিক মানসিক সম্পর্ক থেকে থাকে, তবে তা তার সঙ্গেই, আর কারও সঙ্গে নয়। নাইম ভেবেছে আমি তার সঙ্গে চালাকি করেছি, তাই সে অতি চালাকি করে আমার চালাকির জবাব দিয়েছে। মন ধীরে ধীরে নয়, খুব দ্রুতই ওঠে নাইম থেকে।
একসময় খবরের কাগজ আপিসেও শুরু হয় নাইমের অতি চালাকির বিরুদ্ধে বিস্ফোরণ। কাজী শাহেদ আহমেদের ব্ল্যাংক চেক এর অপব্যবহার করেছে নাইম। কাজী শাহেদ অর্ধচন্দ্র নয়, পূর্ণচন্দ্র দিয়েই বিদেয় করেন নাইমকে। কাগজের মালিক কাজী শাহেদ নিজে সম্পাদকের দায়িত্ব নেন। যে কাজীর প্রশংসায় নাইমের মুখে খই ফুটত, সেই একই কাজী সম্পর্কে সে বলে বেড়াতে লাগল তাঁর মত বদ লোক দুনিয়ায় আর নেই। কুৎসা ছাড়া আর কিছু তার মুখে ফোটে না। তাকে তার বিশালাসন থেকে নামিয়ে দেবার শোধ সে যে করেই হোক নেবে। নাইমের ঘটে বুদ্ধি কম নয়, এই বুদ্ধির জোরেই সে খবরের কাগজ সাপ্তাহিকীটি জনপ্রিয় করে আজকের কাগজ নামে একটি দৈনিকে হাত দেয়। রাতারাতি আজকের কাগজ দেশের এক নম্বর না হলেও দু নম্বর জনপ্রিয়তার তালিকায় চলে আসে, বুদ্ধি আছে, তবে সেই বুদ্ধির সঙ্গে কিছু কিছু কুবুদ্ধি সব কিছু গোলমাল করে দেয়। নাইম দমে যাওয়ার পাত্র নয়। আজকের কাগজের কাজ ফুরিয়ে গেলে সে যে বিমর্ষ বসে থাকবে তা নয়, দল বল জোগাড় করে ভোরের কাগজ নামে একটি পত্রিকা বের করে। আজকের কাগজে যে লেখকদের দিয়ে লেখাতো, অনেককে সরিয়ে নিয়ে আসে নতুন কাগজে। ভোরের কাগজ জনপ্রিয় হতে থাকে ধীরে ধীরে।
নাইম যখন বুঝতে পারে আমি আর তাকে বিশাল কিছু বলে মনে করছি না, সে উঠে পড়ে লেগে যায় প্রতিশোধ নিতে। তার বিনয় ঝুলে পড়ে মরা ডালের মত, তার ভদ্রতা নম্রতা সৌজন্য সব গ্যাসবেলুনের মত শূন্যে উড়ে যায়, সত্যিকার নাইম তার চোখ রাঙানো, দাঁত দেখানো, গলা ফাটানো নিয়ে প্রকাশিত হয়। তার কোনও আচরণ আমাকে কষ্ট দেবে কি না, ক্ষুব্ধ করবে কি না তা নিয়ে আর সে চিন্তিত নয়। আমার চেনা পরিচিত আত্মীয় বন্ধু যাকেই সে চেনে সবার কাছে গিয়ে সে আমার জন্য সে এই করেছে সেই করেছে আর আমি তার জন্য এই করিনি সেই করিনির লম্বা ফিরিস্তি দিয়ে বুঝিয়ে আসে যে তার মত এত অনুগত, অনবদ্য, অসাধারণ ছেলের সঙ্গে আমি খুব অন্যায় করেছি। আমি অকৃতজ্ঞ। আমি অপয়া। আমি অশালীন। আমি অবিবেচক। আমি অপ্রকৃতিস্থ।
নাইম যখন বুঝতে পারে যে তাকে আমি র্নিদ্বিধায় ত্যাগ করতে পারি, তখন সে জোঁকের মত আমাকে আঁকড়ে ধরতে চায়। যখন সে টের পায় যে তার সন্দেহের ধারে কাছে আমি আর যেতে চাইছি না, সে ফেটে পড়ে রাগে। যখন সে দেখে তার রাগের আমি মোটেও পরোয়া করছি না, সে আমাকে হেনস্থা করার পরিকল্পনা আঁটে। পরিকল্পনায় নাইম বরাবরই বড় পাকা।
মিটফোর্ড হাসপাতালের কাছে আরমানিটোলায় একটি বাড়ি ভাড়া করে থাকছি। হঠাৎ একদিন দরজায় কড়া নাড়ে কেউ। খুলে দেখি নাইম। তার জানার কথা নয় আমার ঠিকানা। কিন্তু বাজপাখির চোখ ঠিক ঠিক চিনে নেয় কোথায় শিকার তার। দরজা সে এমন জোরে ধাককাতে থাকে যে আশেপাশের লোক জমে যায়। অতিষ্ঠ হয়ে বেরিয়ে এসে তাকে জানিয়ে দিই, কিছুতেই আমি তাকে ভেতরে ঢুকতে দেব না। ঢুকতে তাকে দিইনি কারণ আমি চাইনি রুদ্রকে সে একফোঁটা অসম্মান করুক। একসময় নাইম সরে যায় আমার দরজা থেকে, কিছু করার পরিকল্পনা নিয়েই সে সরে। এক, আমাকে এ বাড়ি থেকে উচ্ছেদ করা। দুই, সত্যিকার একটি বিয়ে করা।
০৯. সুখের সংসার
মিটফোর্ডের ব্লাড ব্যাংকে পোস্টিং আমার। রক্ত বিক্রি করার জন্য দরিদ্র কিছু লোক আসে, সেই লোকদের শরীর থেকে রক্ত কি করে নিতে হয়, কি করে রক্তের ব্যাগে লেবেল এঁটে ফ্রিজে রাখতে হয় তা ডাক্তারদের চেয়ে টেকনিসিয়ানরাই জানে ভাল। সকাল আটটা থেকে বেলা দুটো পর্যন্ত খামোকা বসে থাকতে হয় আমার। মাঝে মধ্যে কিছু কাগজে সই করা ছাড়া আর কোনও কাজ নেই। এরকম কাজহীন বসে থাকা আমার অসহ্য লাগে। ব্লাড ব্যাংকের পাশেই স্ত্রীরোগ ও প্রসূতি বিভাগ। ওখানে ডাক্তাররা দম ফেলার সময় পায় না এমন ছুটোছুটি করে কাজ করে। দেখে আমার বড় সাধ হয় ব্যস্ত হতে। দিন রাত কাজ করতে। একদিন গাইনি বিভাগের প্রধান অধ্যাপক বায়েস ভুঁইয়ার কাছে একটি আবেদন পত্র লিখে নিয়ে যাই। ‘আমি গাইনি বিভাগে কাজ করতে আগ্রহী, আমাকে কাজ করার অনুমতি দিয়ে বাধিত করবেন।’ অধ্যাপক বায়েস ভুঁইয়া আমাকে বাধিত করেন।