সইএর ঘটনার পর থেকেই নাইমের সংকীর্ণ, প্রতিশোধপরায়ণ, অনুদার, হিংসুক চেহারাটি ধীরে ধীরে এত প্রকট হয়ে ফুটে ওঠে যে ভাবতে লজ্জা হয় এই নাইম সেই নাইম, যাকে আমি নিজের সবচেয়ে ভাল বন্ধু বলে মনে করেছিলাম। আমার ওপর কর্তৃত্ব করার স্পৃহা তাকে উন্মাদ করে তুলেছে।
আমি ময়মনসিংহে যেতে চাইলে নাইম বলে এখন যাওয়ার দরকার নাই।
মানে?
মানে হইল এখন যাওয়ার দরকার নাই।
তাইলে কখন যাওয়ার দরকার?
পরে।
পরে কবে?
আমি বলব।
যেদিন নাইম সিদ্ধান্ত নেবে সেদিন আমাকে ময়মনসিংহে যেতে হবে। যেদিন সে আমাকে বাইরে বেড়াতে নেবে, সেদিন আমাকে বাইরে বেড়াতে যেতে হবে।
সইএর আগে নাইম যেমন সারাক্ষণ ব্যস্ত ছিল আমাকে আনন্দ দেওয়ার জন্য, সই এর পর সে ব্যস্ত হয়ে যায় তার ইচ্ছের খাঁচায় আমাকে বন্দি করার জন্য। বন্দি হতে না চাইলে নাইম চিৎকার করে, দপদপ করে কাঁপতে থাকে তার কপালের শিরা। সই এর আগে তার যে গাড়িটি আমি মাঝে মধ্যে চালাতাম, সইএর পর কৌশলে সেই গাড়ির চালকের আসনে আমার বসা সে বন্ধ করে দেয়। সইএর আগে প্রতি সপ্তাহে আমার কলাম ছাপার জন্য ভীষণ আগ্রহ ছিল তার, সইএর পর সেই আগ্রহ আর থাকে না। আমি ক্রমশ নাইমের হাতের পুতুল হয়ে উঠি। আমি যদি একটি কলম চাই, নাইম আমাকে দশটি কলম এনে দেবে কিন্তু সে দেবে, আমাকে সংগ্রহ করতে দেবে না। আমার সব ইচ্ছে আকাঙ্খা নাইম মেটাতে চায়, আমাকে সে কিছুই মেটাতে দেয় না। আমাকে সে আমার জন্য অহংকার করতে দেয় না, আমার জন্য অহংকার সে নিজে করতে চায়। আমার সব দায়িত্ব সে নিজে নিতে চায়, যেখানে আমার কোনও ভুমিকা থাকবে না, কেবল তার ভুমিকাই থাকবে। সে যে আমার চেয়ে সবদিক দিয়ে বড়, তা বোঝাতে এমন মরিয়া হয়ে উঠল যে আমার কৃতিত্ব ক্রমে ক্রমে তার কাছে তুচ্ছ বিষয় হয়ে ওঠে, যে কৃতিত্ব নিয়ে তার একসময় গৌরবের সীমা ছিল না। যে নাইম নিজেকে নিয়ে হাস্যরস করত, বলত ‘আমি কিচ্ছু জানি না, আমার কোনও ধারণাই নাই, আমি হইলাম একটা গবেট,’ সেই নাইমই নিজেকে জ্ঞানের আধার, সর্বগুণে গুণান্বিত, সর্ববিদ্যায় পারদর্শী বলতে কোনও দ্বিধা করে না। নিজের মহানুভবতার কথা চোখ ফুলিয়ে, নাক ফুলিয়ে, বুক ফুলিয়ে, পেট ফুলিয়ে অনর্গল বলে যায়। আমার মনে হতে থাকে নাইমের আগের চরিত্রের আদ্যোপান্ত ছিল আমাকে জয় করার জন্য। আসল চেহারাটি মানুষের কোনও না কোনও সময় বেরোয়, মুখোশ একসময় খুলে পড়েই। আমাকে যে করেই হোক সে তার মুঠোয় পেয়েছে। মুঠোর মধ্যে কোনও মেয়েমানুষ এসে গেলে তাকে আর মাথা ছাড়াতে দিতে কোনও পুরুষেরই ইচ্ছে করে না। নাইম তো পুরুষই।
নাইম নিজের বাবার প্রশংসায় পঞ্চমুখ, প্রায়ই উল্লেখ করে বাবা তার পকিস্তান আমলে সংসদ সদস্য ছিলেন। এ নিয়ে গৌরবের কিছু আছে বলে আমার মনে হয় না। কারণ তার এই বাবাই কুমিল্লার দেবীদ্বারে মুসলিম লীগের নেতা ছিলেন, এমনকি মুক্তিযুদ্ধের সময় কেবল রাজাকারই নয়, শান্তি কমিটির বড় নেতা ছিলেন। নাইম কখনও তার বাবার অতীতের ভূমিকা নিয়ে গ্লানিতে ভোগে না। একবারও বলে না যে তার বাবা ভুল করেছিলেন। বাবাকে এমনই সে ভালবাসে যে আমাকে কোনও কারণ ছাড়াই তাঁর রক্তচাপ মাপতে বলে। একবার মেপে দেখেছি রক্তচাপ ঠিক আছে, পরদিনও আবার সে মাপতে বলে। পরদিনও মাপি। তার পর আবারও। আমি অবাক হয়ে বলি, কেন? নাইম বলে, এমনি। এমনি কেন? এমনি এমনি প্রতিদিন কারও রক্তচাপ মাপার তো কোনও অর্থ হয় না। বাবা তার রীতিমত সুস্থ মানুষ, রক্তচাপে কোনও ওঠানামা নেই, কিন্তু তার বাবা বলেই, বাবাকে সে ভালবাসে বলেই আমাকে খামোকা তাঁর রক্তচাপ মাপতে হবে। আমি না বলে দিই, আমি মাপবো না। নাইম রাগে থরথর করে কাঁপে। এমনিতেই তার আঙুল কাঁপে কোনও কারণ ছাড়াই। রেগে গেলে সারা গা কাঁপে। চোখ বেরিয়ে আসে গর্ত থেকে। নাইম যেমনই হোক, নাইমের পরিবারের সকলে খুব চমৎকার মানুষ। নাইমের মা দেখতে অপূর্ব সুন্দরী, সুন্দরীর স্বামীটি অসুন্দরের ডিপো। ডিপো হলেও আমি যে কটাদিন নাইমের বাড়িতে ছিলাম আমার সঙ্গে মধুর ব্যবহার করেছেন। কেবল তিনিই নন, বাড়ির সকলেই আমাকে মাথায় তুলে রেখেছে। মাথায় তুললেই কি সুখ হয়!
নাইমের বিনয়ী স্বভাবে অনেকে আকৃষ্ট হয়, কিন্তু ভেতরে ভেতরে অহংকার তার প্রচণ্ড। নিজেকে নিয়ে যেমন, তার বাবাকে নিয়েও তার অহংকারের শেষ নেই। নাইমের রাজনৈতিক বিশ্বাস নিয়ে আমার মনে প্রশ্ন জাগে। খবরের কাগজের দায়িত্ব নেওয়ার আগে সে চাকরি করত ইনকিলাব পত্রিকায়। ইনকিলাব পত্রিকাটি একশ ভাগ মৌলবাদিদের পত্রিকা। এর সম্পাদক প্রকাশক মাওলানা মান্নান দেশের নামকরা রাজাকার। স্বাধীনতার পক্ষের শক্তির বিরুদ্ধে হামেশা লিখে যাচ্ছে। দেশে ইসলাম ধর্ম প্রচারে সবচেয়ে বড় ভূমিকা পালন করছে। নাইম এই পত্রিকাার বিরুদ্ধে একটি বাক্য উচ্চারণ করে না। বরং ইনকিলাব পত্রিকাটির মেক আপ গেট আপ, ইনকিলাবের ছাপাখানার অকুণ্ঠ প্রশংসা করে। খবরের কাগজও সে ছাপে ইনকিলাবের ছাপাখানা থেকে। একদিন রাতে আমাকে নিয়ে ইনকিলাবের আধুনিক ছাপাখানা দেখিয়ে আনে। দেশে দুটি পক্ষ, একটি মৌলবাদ, আরেকটি মৌলবাদের বিরুদ্ধ। খবরের কাগজের সম্পাদকের ভূমিকায় এসে মৌলবাদের বিরুদ্ধ শক্তির সঙ্গে তার খাতির জমে ওঠে, কিন্তু সে নিজে খুব স্পষ্ট করে কোনও পক্ষ নেয় না। ইনকিলাবের অন্ধকার গুহা থেকে বেরিয়ে সে এক আলোকিত জগতে এসেছে। সাংবাদিকতায় বিশ্ববিদ্যালয় পাশ করা নাইম খবরের কাগজ আর আজকের কাগজের কোনও সম্পাদকীয় আজ পর্যন্ত লেখেনি, আশেপাশের ডেস্কে বসা পাতি সাংবাদিকদের দিয়ে সম্পাদকীয় লিখিয়ে নেয়। কোনও রাজনৈতিক বা সামাজিক নেতার বা কোনও কবি লেখকের কোনও সাক্ষাৎকারও সে আজ পর্যন্ত নেয়নি। এসবে তার দক্ষতা নেই। তার দক্ষতা বাণিজ্যে। কাজী শাহেদ আহমেদ তাকে পছন্দ করে সম্পাদকের দায়িত্ব দিয়েছেন। বড় বড় লেখকদের জড়ো করে কলাম লিখিয়ে কাগজের বাণিজ্যিক সাফল্য অর্জন করেছে তার ওপর জনপ্রিয়তা জুটিয়েছে। নাইম যদিও লেখালেখির জগতে উড়ে এসে জুড়ে বসা একটি নাম তার পরও তার কৃতিত্বের জন্য সে বাহবা পাওয়ার যোগ্যতা রাখে। এরকম হঠাৎ এসে ঝড় তোলা কম কথা নয়।