আমি পালাই ময়মনসিংহ থেকে। শ্বাস নিতে যাই কোনও শুদ্ধ হাওয়ায়। ঢাকায় গীতার দুর্ব্যবহার যথারীতি চলে। ঢুকতে দেয় তো বসতে দেয় না, বসতে দেয় তো শুতে দেয় না। সুহৃদকে নাগাল থেকে সরিয়ে রাখে। সুখের সময় গীতা হয়ত পিঁড়ি দেয় বসতে, দুঃখের সময় দূর দূর করে তাড়ায়। গীতার যে কত রকম নিয়ম আছে অপদস্থ করার, তা বোঝার সাধ্য থাকে না আমার। নাইমের কাছে যাই ভাঙা মন নিয়ে। হীনতা স্বার্থপরতা আর কুটকচাল এসব তার নেই তো নেই ই, বরং কী করলে আমি খুশি হব, কী করলে আমি তাকে বেশ বুদ্ধিমান মনে করব, কী করলে মনে করব তার কোনও সংকীর্ণতা নেই, কী বললে মনে করব নারী পুরুষে যে কোনও রকম বৈষম্যের সে বিরোধী, প্রগতিশীল রাজনীতিতে, মুক্তিযুদ্ধের চেতনায়, ধর্মনিরপেক্ষতায় বিশ্বাসী, কী বললে তাকে অসাম্প্রদায়িক ভাবব, কী করলে তাকে স্বচ্ছল, স্বচ্ছ, উদার, উচ্ছল, প্রাণবান বলে ভাবব এবং তার প্রতি আকৃষ্ট হব, তার সবই সে করার বলার প্রাণান্ত চেষ্টা করে যায়। নাইমের এত চেষ্টার পরও তার প্রতি আমার জন্য কোনও ভালবাসা জন্ম নেয় না। আমার অনাথ অভুক্ত অবাধ অসার শরীরটি নাইমের স্পর্শে স্পর্শে যেদিন জেগে ওঠে, সেদিনও তার জন্য আমার কোনও প্রেম জাগে না। চল বিয়ে করি! নাইম বলে সেই বিকেলেই, যে বিকেলে শরীর জাগে। বাক্যটি এমনভাবে সে বলে যে মনে হয় সে অন্য যে কোনও দিনের মত চল চা খাই, চল মেলায় যাই বা চল ঘুইরা আসি বলছে। বাক্যটি আমাকে মোটেও চমকে দেয় না। নাইমের যে কোনও প্রস্তাবে আমি রাজি হই, যেহেতু আমি জানি যে সে আমার সবচেয়ে বড় বন্ধু, জানি যে পৃথিবীর আর কেউ চাইলেও সে আমার কোনও অমঙ্গল চায় না। নাইমকে আমার কোনও খাঁচা বলে মনে হয় না। লাঞ্ছনা আর অপমানের পুঁতিগন্ধময় পরিবেশ থেকে নাইম আমার জন্য একরকম মুক্তি।
সেই বিকেলেই ধানমণ্ডির দিকে রিক্সা করে ঘুরে বেড়াতে বেড়াতে রাস্তার পাশে ছোট্ট একটি ঘরে নাইম থামে, ঘরটির মাথায় ছোট একটি নোটারি পাবলিক লেখা সাইনবোর্ড ঝোলানো। স্যাঁতসেঁতে অন্ধকার ঘরটিতে ভূুতের মত একটি লোক বসা ছিল, নাইম জিজ্ঞেস করল বিয়ে করতে হলে কি করতে হয়। দুজনের দুটো সই, আর কিছু টাকা। পাঁচ মিনিটের মধ্যে সইও হল, টাকাও দেওয়া হল। সে রাতে নাইমের ইস্কাটনের বাড়িতে ফিরে দুজনের শোয়া হল, প্রথম শোয়া। শুতে হলে কি সই করে শুতে হয়! সই না করেও তো হয়! সই ব্যপারটিকে আমার খুব গুরুত্বপূর্ণ কিছু বলে মনে হয় না। আপিসের কাগজপত্রে সই চাইলেই সই দিয়ে দিই। আমি একটি তুচ্ছ মানুষ, আমার সই এর মূল্যই বা কী! সই হয়। এতে আমার কিছু না হলেও নাইমের হয়। শুতে হলে নাইমের সই করে শোয়ার সংস্কারটির একটি রফা হয়। ঘর ভর্তি বাবা মা ভাই বোন, বোন জামাই, ভাই বউ সবার মধ্যেই নাইম আমাকে নিয়ে পুরোটা রাত না হলেও অর্ধেক রাত কাটায়। এ বাড়িতে নাইমের অধিকার আছে যা কিছু করার। এ বাড়িতে নাইমই হল কর্তা, সে যা করে, তাতে কারও জিভে প্রতিবাদের টুঁ ওঠে না কারণ বাড়ির বাসিন্দাদের খাওয়া পরার সব খরচ নাইমই জোগায়, মন্ত বড় বাড়িটির ভাড়াও। এ বাড়িতে তার বন্ধু বান্ধবীরা অহরহ আসছে, খাচ্ছে, রাত কাটাচ্ছে। এ বাড়িতে এক রাতে আমিও থেকেছি, নাইম তার ঘরটি আমার জন্য ছেড়ে দিয়েছিল। এবারের থাকা অন্যরকম যদিও, সই করে থাকা, কিন্তু আমার মোটেও অন্যরকম মনে হয় না। যেমন বন্ধু ছিল নাইম, তেমনই থেকে যায়। তেমনই তুই তোকারি।
ময়মনসিংহে পানে লাল হওয়া জিভের, লাল চশমার,পরিবার পরিকল্পনার সুন্দরী কর্মীদের দিকে বাঁকা বাঁকা হাসি হাসা ডিজির আবেদনে কাজ হয়েছে। বদলি চৌদ্দগ্রামে। এক লাথিতে চৌদ্দ পুরুষের নাম ভুলিয়ে দিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। আমি যে খুব নিরানন্দে ভুগেছি বদলির আদেশ পেয়ে তা নয়। একরকম চাচ্ছিল!মও অবকাশ থেকে দূরে যেতে, পরিবার পরিকল্পনার অসুস্থ পরিবেশ থেকে, যে অসুস্থতার বিরুদ্ধে কোনও জীবানুনাশক কাজ করে না, চাচ্ছিল!মও সরতে। চৌদ্দগ্রাম চলে যাবো শুনে মা চিৎকার করে কাঁদলেন। কিন্তু যেতে তো হবেই। বদলির চাকরি। চৌদ্দগ্রামের স্বাস্থ্য কেন্দ্রে যোগ দিয়ে কদিন আসা যাওয়া কুমিল্লায় নাইমদের বাড়িতে থেকে করেছি। ওখানে প্রায়ই চলে যেত নাইম, ভোরে উঠে আবার ঢাকা ফিরত।
আমাকে চমকে দেওয়ার অভ্যেস তখনও যায়নি নাইমের। হঠাৎ একদিন একটি কাগজ হাতে দিল নাইম, আমার বদলির কাগজ। চৌদ্দগ্রাম থেকে দু সপ্তাহের মধ্যেই ঢাকার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ ও মিটফোর্ড হাসপাতালের রক্তব্যাংকে মেডিকেল অফিসার পদে বদলি। নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারি নি। প্রভাব বুঝি একেই বলে! আমার পক্ষে জীবনে কখনও সম্ভব ছিল না কোনও ভাল জায়গায় বদলি হওয়া, ঢাকা শহরে মোটে দুটো মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল। লোকে বলে মামা কাকার জোর না থাকলে এসব জায়গায় পোস্টিং হয় না। আমার মামা কাকারা কেউ ওপরতলায় বাস করেন না। সুতরাং আমার কপালে চৌদ্দগ্রাম, পঞ্চগ্রাম, অষ্টগ্রামই ছিল। একটি সাপ্তাহিক পত্রিকার সম্পাদকের দৌড় খবরের কাগজ আপিস পর্যন্ত না হয়ে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় পর্যন্ত যে হতে পারে, তা কটি লোক জানে! নাইমের এই চমকটি আগের সব চমককে ছাড়িয়ে যায়। কিন্তু এতদসত্বেও তার সঙ্গে সইএর সম্পর্কটিও আমার দুমাসও টেকেনি। নাইমের ইচ্ছে ছিল একদিন ঘটা করে বিয়ের অনুষ্ঠান করবে, বন্ধু বান্ধব চেনা পরিচিত সবাইকে জানাবে বিয়ের খবর। তার এই ইচ্ছেটি সফল হয় না। একদিন রিক্সা নিয়ে ধানমণ্ডির দিকে যেতে যেতে হঠাৎ থেমে ওই ছোট্ট অন্ধকার ঘরটিতে গিয়ে কিছু টাকা আর একটি সই দিয়ে আসি, এবারের সইটি আগের সইটির উল্টো। সই থাকা না থাকায় কোনও কিছু যায় আসে না। আমি সেই আগের আমি। আমার মনে হয় না কিছু হারিয়েছি বা কিছু পেয়েছি আমি। প্রথমবার এখানে সই করতে এসেও যেমন নিস্পৃহ ছিলাম, এবারও তাই। সই এর গুরুত্ব আমার কাছে বন্ধুত্বের চেয়ে বেশি নয়। বন্ধুত্ব যদি ম্লান হয়ে আসে, সেখানে কোনও সই কোনও সম্পর্ক ধরে রাখতে পারে না।