জানি দুঃসময় ঝাঁক বেঁধে আসে। কিন্তু ঝাঁক বেঁধে আসতে থাকলেও তো সীমা থাকে সব কিছুরই। কিন্তু সীমা ছাড়িয়ে যাওয়া দুঃসময় আমার ওপর ভারী ভারী পাথরের মত পড়তে থাকে। চূড়ান্ত দুঃসময়টি আসে এক সকালে। তিরিশ হাজার টাকা ধার নিয়ে মাত্র পাঁচ হাজার টাকা শোধ করেছি, বাকিটা এখনও শোধ করছি না বলে আবদুল করিম তুলকালাম কাণ্ড বাঁধান অবকাশে। আমি তাঁর টাকায় বেড়াতে গিয়েছি ভারতে, আমি একটা বদমাশ মেয়ে মানুষ, আমার মত খারাপ তিনি ইহজীবনে কাউকে দেখেননি ইত্যাদি বলে বাড়ি মাথায় তোলেন। আবদুল করিমের কাছ থেকে ভারত যাওয়ার আগে টাকা ধার নিয়েছিলাম, কিন্তু ফেরত দেওয়ার কথা ছিল প্রতিমাসে মাইনে পেয়ে। তিনি রাজি হয়েছিলেন, আর এখন হুট করে বাকি সবটা টাকাই একবারে চাচ্ছেন। এই আবদুল করিমও কম কৌশল করেননি আমাকে নাগাল পেতে। বুঝতে দিইনি কখনও, যে, আমি বুঝতে পারছি তাঁর কৌশল। ফুল ফুলের চারা দেখাতে আবদুল করিম একদিন আমাকে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন ছোটবাজারের এক ব্যবসায়ীর বাড়িতে। সাদা মনে সেই বাড়িতে গিয়ে দেখি সবুজ পাঞ্জাবি পরা, পকেটে টাকার বাণ্ডিল নিয়ে ঘোরা মধ্যবয়সী ব্যবসায়ী আর আবদুল করিম বসে আছেন একটি অন্ধকার অন্ধকার ঘরে। ব্যবসায়ীটির অনেক টাকা, আমার টাকা পয়সার দরকার হলে তাঁর কাছে চাইলেই দিয়ে দেবে, এমনকী শোধ না দিলেও চলবে এধরনের কথা যখন আবদুল করিম বলছিলেন, যেন বুঝিনি তিনি কি ইঙ্গিত করছেন, হেসে, চা খেয়ে, সবুজ পাঞ্জাবির সবজি-বাগানের ব্যবসা নিয়ে সাধারণ কিছু আলাপ করে আমার হাসপাতালে যাবার তাড়া আছে এক্ষুনি না গেলেই নয় বলে বেরিয়ে এসেছি। এই আবদুল করিমই অবকাশে এসে আমাকে ডেকে একদিন বলেছেন, ‘ডাক্তার, আমার একটা অসুখ আছে, কী করা যায় বল তো!’ কি অসুখ জানতে চাইলে তিনি গলা চেপে বলেন, তাঁর সেক্সুয়াল ডিজায়ার অত্যন্ত বেশি, দুই বউএর কেউই তাঁকে হ্যাপি করতে পারছে না, তিনি যত বেশি চান, তারা তত বেশি মিইয়ে যায়, তিনি স্টে করেন অনেকক্ষণ, তারা খুব তাড়াতাড়িই ফিনিশ। শুনে, এ যেন হরহামেশা হচ্ছে এমন সহজ রোগ, যেন সর্দি জ্বর, যেন আমাশা, যেন অম্বল— কান নাক চোখ ঠোঁট যথাসম্ভব অপরিবর্তিত রেখে অত্যন্ত সহজ সুরে, টাক মাথা, উপরি টাকায় পকেট বোঝাই করা, পান-দাঁতে হাসা, হাসিতে ভুঁিড় কাঁপা লোকটির চিকিৎসা করি, চিকিৎসা বলতে উপদেশ ‘এ তো এমন কোনও সমস্যা না, আপনি যৌনরোগবিশেষরি কাছে যান, ওখানে ভাল ট্রিটমেন্ট পাবেন, আমি তো যৌনরোগের বিশেষজ্ঞ না।’
‘কী বল, তুমি ডাক্তার হইছ, তুমি ট্রিটমেন্ট করতে পারবা না কথা হইল!’
‘আপনের যে রোগ করিম ভাই, তার জন্য বিশেষজ্ঞ দরকার।’
‘কী যে বল, তুমি হইলা আপন মানুষ, আত্মীয়। বাইরের ডাক্তারের কাছে এইসব বলা যাবে নাকি!’
‘কেন যাবে না? রোগ তো রোগই।’
‘নাহ, এই রোগ কোনও ডাক্তারে সারাইতে পারবে না।’
‘আমি তো ডাক্তার, আমার কাছে তাইলে বললেন কেন!’
ফ্যাক ফ্যাক করে হাঁসের মত হেসে করিম বললেন, ‘আমার চিকিৎসা কি তা আমি জানি।’
কি চিকিৎসা তা জিজ্ঞেস করি না, তিনি নিজেই বলেন, ‘আমার একটা ইয়ং মেয়ে দরকার।’
আমি বলি, ‘কিরণ আর কুমুদ তো আছে, আপনের দুই মেয়ে। ইয়ং মেয়ে।’
করিম জিভে কামড় দিয়ে বলেন, ‘ওরা তো আমার সন্তাান। বলতাছি আমার নিজের জন্য।’
‘ও তাই বলেন!’
না বোঝার এই ভানটুকু আমার না করলেই নয়। আমি লোকটিকে জুতোপেটা করে বাড়ি থেকে তাড়াতে চাই না, লোকটি এবাড়ির আত্মীয়। কিন্তু লোকটিকে বুঝতে দিতেও চাই না যে তাঁর কোনও ইঙ্গিত আদৌ আমার বোধগম্য হয়েছে। আমি বুঝেছি তিনি যা বলতে চেয়েছেন, তা যদি তিনি বোঝেন, তবে এটুকুই তাকে যৌনতৃপ্তি দিত হয়ত। ভানটুকু করেছি, কারণ, তাঁকে, যত কুকথাই তিনি বলুন, ভাল মানুষ হিসেবেই বিচার করি, তিনি যে কোনও অশোভন ইঙ্গিত দিতে পারেন তা যে আমি কল্পনাও করতে পারি না, তাও বোঝানো। এটুকু যদি তাঁকে অন্তত আমার সঙ্গে আর কখনও এমন আলাপচারিতায় আগ্রহী না করে, যে আলাপের রস গ্রহণ করার মত যোগ্যতাও আমার নেই।
সেই করিম।
সেই আবদুল করিম।
বাড়ি মাথায় তুলছেন চেঁচিয়ে। আমি খারাপ মেয়ে। আমি তাঁর টাকায় লাঙ নিয়ে ফুর্তি করে এসেছি। আমি মৌজ করে এসেছি, আমোদ করে এসেছি। এইসব খারাপ চরিত্রের মেয়েদের যে কেউ চাইলেই পেতে পারে! ইত্যাদি ইত্যাদি।
মা ধমকে থামান করিমকে। বলেন, ‘বাজে কথা বলতাছো কেন! টাকা ধার নিছে। টাকা দিয়া দিবে। আজ না পারে, কাল দিবে, এইজন্য এইসব কথা বলার তুমি কে?’
করিম থামেন। ওদিকে হাসিনা কিন্তু দরজায় দাঁড়িয়ে করিমের প্রতিটি কথা শুনে যাচ্ছিল, কোনও রকম প্রতিবাদ করেনি। করার কোনও কারণ নেই, কারণ তার একধরণের আনন্দই হচ্ছিল কথাগুলো শুনতে। এরকম মোক্ষম সুযোগ ছেড়ে দেওয়ার সে কোনও মানে দেখে না।
যখন ইয়াসমিন ঘরে ঢোকে মিলনকে নিয়ে, করিম চলে গেছেন। গয়নাগাটি আমার যেখানে যা ছিল বের করে নিয়ে যাই সোনার দোকানে, ইয়াসমিন সঙ্গে যায়। যত দাম সোনার, তার চেয়ে অর্ধেক দাম বলে দোকানী, সেই দামেই দিয়ে দেখি কুড়ি হাজার টাকা হচ্ছে। ইয়াসমিন মিলনের কাছ থেকে পাঁচ হাজার টাকা ধার নিয়ে দেয়। পঁচিশ হাজার টাকা সেদিনই হাসিনার হাতে তুলে দেওয়া হয় তাঁর ভদ্রলোক বোন জামাইকে যেন দিয়ে আসে। টাকা হাতে পেয়ে হাসিনার মুখে কোনও স্বস্তির ছোঁয়া দেখা যায় না, যেন আমি দীর্ঘদিন এই দেনায় বেঁধে থাকলে তার আনন্দ হত।