পরিবার পরিকলল্পনার পরিকল্পনাহীন দপ্তরে যা ইচ্ছে তাই হচ্ছে, ওষুধ চুরি, টাকা চুরি, পুরুষ কর্তাদের আধিপত্য, সুন্দরী কোনও কর্মী দেখলেই হাত বাড়ানো। এসবের বিরুদ্ধে উচ্চয়রে কথা বলতে গিয়ে দেখি আমি একা। আমি হেরে যাচ্ছি। পুরুষ কর্তারা আমাকে হেনস্থা করার জন্য ওত পেতে থাকেন। গ্রামে গঞ্জে ক্যাম্প করে যখন লাইগেশন বা টিউবেকটমি করি, বেশ ভাল লাগে, কোনও একটি কাজের মধ্যে থাকলে সাংসারিক দুঃখ শোকগুলো সরিয়ে রাখা যায় দূরে। ক্যাম্প যদি না না থাকে তবে আপিসে যাও, বসে থাকো, কে কেমন আছে দেখ, কে কী বলে শোনো, মাছি মারো বসে বসে। কোনও একদিন হারুন-উর-রশিদ, বড়কর্তা ওরফে ডিপুটি ডিরেক্টর, যাকে লোকে ডিডি বলে ডাকে, বিকেল পাঁচটায় অনেকটা প্রমোদবিহারে যাওয়ার মত পানে মুখ লাল করে, লাল চশমা পরে দেখতে গেলেন কালিবাড়ির টিনের ঘরটি। টিনের ঘরে মুজিবর রহমান আর আম্বিয়া কপোত কপোতির মত সময় কাটাচ্ছেন। বাকিরা সব বাড়ি চলে গেছেন। সাইদুল ইসলাম নেই। তিনি নেই, তাঁর না থাকার একশ একটা কারণ আছে, কিন্তু আমি নেই কেন! ঢাকার স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে পাঠিয়ে দিলেন নালিশ। কেবল একবারই নয়, ঘন ঘন তিনি আমার বিরুদ্ধে নালিশ করছেন। তাঁর আর সইছিল না তাঁর মধুর আহবানকে যে আমি হেলা করেছি সেই অপমান। তিনি তাঁর আকুয়ার আপিসে আমাকে প্রায়ই যেতে বলতেন। আমি গিয়েছিলাম একদিন। তিনি আমাকে তাঁর আপিসে ঘরে বসিয়ে বেল টিপে বেয়ারাকে ডেকে দাঁড় করিয়ে আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘কি খাবেন, দুধ চা না রং চা?’
‘রং চা।’
‘একটা দুধ, একটা রং।’ বেয়ারার দিকে চোখ। বেয়ারা আদেশ মাথায় নিয়ে চলে গেল।
‘রং চা খান কেন? রং চা খেলে তো গায়ের রং নষ্ট হয়ে যায়। আপনারা মেয়েমানুষ, রং এর কথা তো ভাবতে হবে। হা হা।’ কুমড়োর ওপর বসানো বত্রিশটি শুকনো সীমির বীচি।
‘খেয়ে অভ্যেস বলে খাই। .. রংএর কথা আমি অত ভাবি না।’
‘সুন্দরী মেয়েদের অবশ্য অত কিছু না ভাবলেও চলে। হা হা।’
প্রসঙ্গ সঙ্গে সঙ্গে অন্যদিকে ফেরাই, ‘আমাকে যে আসতে বলেছেন, কোনও কাজ আছে স্যার?’
‘কী আর কাজ! ফ্যামিলি প্ল্যানিংএ আবার কোনও কাজ থাকে নাকি.. হা হা হা।’
‘তাহলে যে আসতে বলেছেন, কোনও দরকারে?’
‘বসেন গল্প করি। আমার ওয়াইফ বাচ্চাদের নিয়ে ঢাকায় গেছে কয়েকদিনের জন্য। আপনি একদিকে ভালই আছেন। লাইফ এনজয় করতে পারছেন। ফ্যামিলি থাকলে লাইফ এনজয় করা যায় না।’
আমি চোখ নামিয়ে চা খাওয়ায় মন দিই।
‘আপনি কি খুব শাই নাকি!’
‘না তো!’ চোখ ওঠাই।
‘আপনিই যদি শাই হন, তা হইলে আর মেয়েরা কি হবে বলেন।’
আমার চোখ দেয়ালে, দেয়ালের টাঙানো ছবিতে। দূর থেকে ছবির অনেক কিছু চোখে পড়ে না কিন্তু এমন ভাবে তাকিয়ে থাকি যেন ছবির খুঁটিনাটি গুলো আমার এখন না উদ্ধার করলেই নয়।
‘আপনার কথা এইবার কিছু বলেন। আপনি তো দেখছি কথাই বলতে চান না। আপনার জীবন তো খুব ইন্টারেস্টিং জীবন! ঠিক না?’
‘ কই না তো! আমার জীবন খুব সিম্পল..’
‘কী বলেন! আমি তো শুনি মানুষের কাছে, বেশ ইস্টারেস্টিং লাইফ আপনার। আপনি তো অনেকটা ড্যাম কেয়ার। এই ক্যারেকটারটা অবশ্য ভাল। হা হা হা।’ সীমির বীচিগুলো ঝলসে ওঠে।
‘স্যার, ক্যাম্প ট্যাম্প কিছু হবে নাকি শিগরি!’ জানি ক্যাম্প আছে আগামী বুধবারে। তবু জিজ্ঞেস করি।
‘ক্যাম্প? হ্যাঁ তা আছে। নেক্সট ক্যাম্পে আপনি তো আমার গাড়িতেই যেতে পারেন। আপনি চলে আসবেন সকালে। আমার সঙ্গে যাবেন আপনি।’
‘আমার তো যাওয়ার কোনও অসুবিধা নাই..’
‘আপনি তো একদিন ডাক্তার সাইদুলের সাথে তার মোটর সাইকেলে গেলেন.. হা হা হা। মোটর সাইকেলের চেয়ে তো জিপে যাওয়া ভাল। আরামের যাওয়া।’
আমি চুপ করে থাকি।
‘তা বলেন, লাইফএর প্ল্যান কি আপনার?’
‘না, কোনও প্ল্যান নাই।’
‘প্ল্যান নাই! বিয়ে টিয়ে করবেন না?’
‘নাহ!’
‘বলেন কী! এইভাবে ইয়াং বয়সটা নষ্ট করে দিবেন নাকি!’
‘নষ্ট হবে কেন! লেখালেখি করি অবসর সময়ে। এইভাবেই তো ভাল।’
হাসির চোটে কুমড়ো নড়ছে।
‘ও আপনি তো আবার কবি।..ভাবুক মানুষ। হা হা হা’
পরিবার পরিকল্পনার বড়কর্তা আমাকে আরও অনেকক্ষণ বসিয়ে রাখেন। আরও অনেকক্ষণ অর্থহীন কথাবার্তা বলেন। অর্থহীন হাসেন। আমি যতবারই উঠে আসতে চাই, ততবারই তিনি বসতে বলেন। শেষ পর্যন্ত, জরুরি কাজ আছে বলে আমাকে উঠতে হয়। যখন উঠছি, বলেন, ‘আপনি পরশু বিকালে চলে আসেন। আমি কাজ টাজ সেরে ফ্রি হয়ে থাকব। আমার ওয়াইফ ফিরবে আর সাতদিন পর। সুতরাং কোনও অসুবিধা নাই।’
পরশু বিকেলে কেন, আমি কোনওদিনই আর তাঁর আপিসে যাইনি। তাঁর আর সইছিল না আমার স্পর্ধা। তাঁর আর সইছিল না তাঁর অশোভন আহবানে সাড়া না দেওয়ার জন্য সুন্দরী কর্মীদের আমার ইন্ধন যোগানো। এই ময়মনসিংহ থেকে তিনি আমাকে সরিয়ে দেওয়ার যতরকম ষড়যন্ত্র সম্ভব, করে যাচ্ছেন। বাড়ির বাইরে ডিডির বিরোধিতা, বাড়িতে বাবার —- আমাকে কাবু করতে করতে এমন অবস্থায় ফেলল যে আমার আত্মহত্যা করতে ইচ্ছে হতে থাকে।
ইয়াসমিনের ওপর যত অভিমান ছিল, সব অভিমান একদিন ধুয়ে মুছে ওর কাছে যাই, ওকে দেখি আর সেই সচল সজল উচ্ছল উতল দিনগুলোর কথা ভাবি। দিনগুলো কখনও আর ফিরে আসবে না। ইচ্ছে করে ইয়াসমিনকে নিয়ে এ বাড়ি থেকে পালিয়ে যাই কোথাও, কিন্তু শৃঙ্খলে ও নিজেকে এত বেশি জড়িয়েছে, এত বেশি আপোস করে জীবন যাপন করতে চাইছে যে ওকে নিয়ে কোথাও এক পা যাওয়া সম্ভব হয় না। ‘চল ঘুরে আসি, চল আগের মত। চল কথা বলি, হাসি, চল আগের মত।’ আমার এইসব আবদার অনুরোধ এখন আর ওকে স্পর্শ করে না। গৃহবধূ তার গত জীবনের ইতি টেনেছে, এই জীবনটি ওর স্বপ্নের ধারে কাছে না হলেও ও আর বদনাম কামাতে চায় না। এক বোনের সংসারহীন জীবনের বদনামই যথেষ্ট সংসারে। আরেক বোন না হয় প্রায়শ্চিত্যই করল নিজের জীবন দিয়ে। শ্বশুরবাড়ির চৌহদ্দিতে ইয়াসমিন বন্দি। আমি ঘন ঘন ওর শ্বশুর বাড়িতে যাই, তা ও চায়ও না। বুঝি আমাকে নিয়ে ও বাড়িতে মুখরোচক কথা হয়। এ বয়সে সকলে ঘর সংসার করে, সকলের স্বামী থাকে, আমারই নেই, আমি মানুষটি ঠিক স্বাভাবিক নই, এসব। আমার বিয়ে ভেঙে গেছে, আমি পাপী তাপী নষ্ট ভ্রষ্ট মেয়ে, এসব। আমার সঙ্গে লক্ষ্মী গৃহবধূর এত মাখামাখি থাকবেই বা কেন! তাই মাখামাখিতে যায় না ও। ওর মাখামাখি শ্বশুরবাড়ির লোকদের সঙ্গে, ওর মন শ্বশুরবাড়ির মানুষের মন যোগাতে। বাবাকে বলে শ্বশুর বাড়ির আত্মীয়দের নেমন্তন্ন করায়। মা ভুতের মত রান্না করেন। কদিন পর পরই ইয়াসমিন তার শাশুড়ি, স্বামী, ভাসুর, আর ভাসুরবউদের নিয়ে অবকাশে এসে নেমন্তন্ন খেয়ে যায়। ভারত থেকে আনা জিনিসপত্রগুলো ইয়াসমিনকে দিয়ে দিই, ও খুশি হয়। সোনার গয়নাতেও আকর্ষণ নেই আমার, গয়নাগুলোও দিয়ে দিই, ওর চোখ ঝিকমিক করে আনন্দে।