অবকাশ দিন দিন আমার কাছে আরও অসহ্য হয়ে উঠছে। কারও নরম গরম কোনও কথাই আমার ভাল লাগে না। ইচ্ছে করে এ বাড়ি থেকে চলে যাই কোথাও। কোথাও আমি নিজের মত করে থাকি। ইয়াসমিন চলে যাওয়ার পর বাড়িটিতে আমার আর কেউ নেই যার সঙ্গে আমি দু কথা বলে সময় কাটাতে পারি। বুকের ধন সুহৃদও নেই। বড় ফাঁকা লাগে সবকিছু। বড় হু হু করে বুক। বাড়িটিকে আর বাড়ি বলে মনে হয় না। মার নিজের জগতটি বড় সংকীর্ণ, রান্নাঘর আর পীরবাড়ি, বাবার জগতে এ বাড়ির কারও কোনও স্থান নেই, যদি থাকে কারও, সে দাদার। দাদা আরোগ্য বিতানের দায়িত্ব নেওয়ায় বাবার সঙ্গে দাদার একটি ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে উঠেছে। আরোগ্য বিতানে চুরি হল এক রাতে। দাদা সন্দেহ করলেন শরাফ মামাকে, বাবাও তাই। টুটু মামা একবার দাদার কাছ থেকে টাকা ধার নিয়ে আর ফেরত দেন নি, সে নিয়ে দাদা প্রায়ই মামাদের গুষ্ঠি উদ্ধার করেন। মাকে উঠতে বসতে টুটু মামার টাকা নেওয়ার এবং না দেওয়ার কেচ্ছ! শোনান। দাদার অনেক আচরণই বাবার মত। বাবা যেমন নানিবাড়ির কাউকে আপন বলে ভাবেন না, দাদাও তেমন। বাপকা বেটা সিপাইকা ঘোড়া, কুছ নেহি তো থোড়া থোড়া। হাশেম মামা আকুয়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান হয়েছেন। বক্তৃতা ভাল করতে পারেন না বলে বীর মুক্তিযোদ্ধা হয়েও ইউনিয়ন পরিষদের ওপরের কোনও ধাপে পা ফেলতে পারেন না। মুখে খই না ফুটলে আর নানারকমের প্রতিশ্রুতি, সে মিথ্যে হোক, না দিতে পারলে কারও ভোট জোটে না। হাশেম মামা তাঁর ভাতের দোকানে বসে থাকেন, দোকানেই বন্ধুদের ডেকে ডেকে রাজনীতির আলাপ করেন। দোকান করে সংসার চালাতে হয় হাশেম মামাকে। একটি ছোট্ট ঘরে বউ আর পাঁচ কন্যা নিয়ে গাদাগাদি করে থাকেন, কন্যাদের সবাইকে লেখাপড়া করাচ্ছেন। একটি মাত্র ছেলে সুমন, খুনের মামলার আসামী হয়ে আরও কজন সমবয়সী ছেলের সঙ্গে জেল খাটছে। হাশেম মামা ম্যালা টাকা ঢালছেন ছেলে যে নির্দোশ এই প্রমাণ নিয়ে হাই কোর্টে মামলা করার জন্য। কোনও অবৈধ পথে টাকা ঢালতে তিনি চান না, চাইলে ছেলেকে ছাড়িয়ে আনতে পারতেন অনেক আগেই। মামাদের মধ্যে এক হাশেম মামারই আগ্রহ খুব আমার বই পড়ার। দেখা হলে প্রায়ই তিনি বলেন, ‘কই তোমার বই টই কিছু বাইর হইছে? দেও একটা বই দেও।’ একদিন হাশেম মামা এসে পাঁচশ টাকা ধার নিয়ে গেলেন আমার কাছ থেকে। টাকা চাইতে লজ্জা হচ্ছিল তাঁর, তারপরও উপায় ছিল না। সুমনের মামলার জন্য খরচের কোনও মা বাপ ছিল না। তবু হাশেম মামার আমার কাছ থেকে টাকা নেওয়াটি মার ভাল লাগে নি। মা মুখ কালো করে বসে রইলেন, খবরটি বাবা বা দাদার কানে গেলে মার চৌদ্দ গুষ্ঠির বাপান্ত করে ছাড়বেন। হাশেমমামাকে খুব ভালবাসেন মা, তাঁর নীতির জন্যই ভালবাসেন। নীতির কথা কইতে হাশেমমামা নিজের বাপকে ছেড়ে দেন না। এমন মানুষটিকে কেন আজ ভাগ্নীর কাছে হাত পাততে হয়! না খেয়ে থাকতে হবে, না খেয়ে থাক, তবু যেন হাত না বাড়ায় কারও কাছে। মা যতই গুষ্ঠি নিয়ে ভাল কথা বলতে চান, গুষ্ঠি নিয়ে তাঁর লজ্জাও কম নয়। মা খুব একা, মার জগতটিতে মা ছাড়া আর কেউ নেই। সংসারে যখন কোনও অঘটন ঘটে অথবা ছেলেমেয়েদের কারও কোনও গোপন সংবাদ যদি বাবা আহরণ করতে চান অথবা কারও বিরুদ্ধে অভিযোগ করতে চান, তবেই মার ডাক পড়ে। আজকাল মাকে তিনি পই পই করে জিজ্ঞেস করেন আমার গতিবিধি, কী করছি , কী ভাবছি, বাকি জীবনের জন্য কোনও পরিকল্পনা করছি কী না। নাকি এরকম যা ইচ্ছে তাই করে বেড়াবো। এরকম ঢাকা ময়মনসিংহ। এরকম আগল বাঁধনহীন জীবন যাপন। মা আমার পরিকল্পনার কথা পরিস্কার করে বাবাকে কিছু বলতে পারেন না।
বাবা বাড়ি এসে আমাকে শুনিয়ে শুনিয়ে মাকে বলেন, ‘শহরে কারও কাছে মুখ দেখানো যায় না। আজকেও একটা লোক আইসা কইল, আপনার মেয়ে তো ডাক্তার হইছে, তার কি বিয়া টিয়া দিছেন? জামাই কি ডাক্তার নাকি? সে যে একটা বিয়া করছিল, তা অনেকে জানে। ব্যাডা মদারু মাগীবাজ এইসব না জাইন্যা বিয়া করছিল কেন? এহন এই মেয়েরে কেডা বিয়া করব? সব ব্যাডাই এরে লইয়া ঘুইরা বেড়াইব। বিয়া কেউ করব না। মাইনষের সামনে আমি মুখ দেখাইতে পারি না। মাইনষে জিগায়, মেয়ে বিয়ার উপযোগী হইছে তো বিয়া দেন না কেন? মাইনষে খবর জানতে চায়। কী উত্তর দিব মানুষের প্রশ্নের! মুখটা নামাইয়া রাখতে হয়। আমি কি কইরা বলব যে মেয়ে নিজের ইচ্ছ!য় বিয়া করছিল, জামাইরে ছাইড়া দিছে, এহন ব্যাডাইন লইয়া ঘুরে। মানুষে কি খবর রাখে না, ঠিকই রাখে। ছি ছি করে। কোনও ডাক্তার ছেলেরে বিয়া করলে বালা অইলো না অইলে? এতদিনে দুই তিনডা বাইচ্চা কাইচ্চা লইয়া সংসার করতে পারত।’
মা মাথা নাড়েন, হ্যাঁ পারত। আমার বয়সী মুন্নির বিয়ে হয়েছে, বাচ্চা হয়েছে, লক্ষ্মী মেয়ের মত সুন্দর সংসার করছে। উদাহরণটি মা দেন। উদাহরণের অভাব নেই। যেদিকে তাকান মা, আমার বয়সী এমনকী আমার বয়সে ছোটোদেরও চমৎকার সংসার হয়েছে দেখেন। কেবল আমারই হয়নি।
ভীষণ উৎপাত শুরু হয় বাড়িতে। উঠতে বসতে আমাকে কথা শুনতে হয়। কেউ ফোন করলে কে ফোন করেছে, কেউ চিঠি লিখলে কে চিঠি লিখেছে, কেউ বাড়ি এলে কে এই লোক, কি সম্পর্ক, সম্পর্ক যদি ভাল হয়, তাহলে কেন এখনো বিয়ে করছি না! সারাজীবন একা কাটাবো, বিয়ে করব না এ কথা স্পষ্ট করে জানিয়ে দিলে বাবার কড়া হুকুম, খুব ভাল কথা, বিয়ে না করেও অনেকে মেয়েরো বেঁচে থাকে, তবে ছেলেপিলেদের সঙ্গে মেলামেলা বন্ধ করতে হবে, বান্ধবী থাকতে পারে, তবে কোনও বন্ধু নয়। কেবল হুকুম দিয়েই তিনি শান্ত হন না, জরুরি অবস্থাও জারি করেন, আমার কোনও বন্ধু নামক পদার্থ যদি এ বাড়িতে আসে, তবে তার সঙ্গে জোর করে বিয়ে দিয়ে দেবেন আমাকে। ইয়াসমিনকে মেরে বাড়িছাড়া করেছেন, আমাকে তিনি মারেন না। আমার শরীরে না পড়লেও মনে পড়তে থাকে শক্ত শক্ত চাবুকের ঘা। কুঁকড়ে যেতে থাকি যন্ত্রণায়। ইয়াসমিন নেই যে বিকেলে বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়ব দুজন রিক্সা করে শহর ঘুরতে, অথবা গানের নাচের কবিতার অনুষ্ঠানে যাবো। একা কোথাও যেতে ইচ্ছে করে না। ও চলে যাওয়ার পর সকাল কবিতা পরিষদও একরকম ভাঙা ভাঙা। আমি একটি অপদার্থ, অলক্ষ্মী হিসেবে প্রতিদিন চিহ্নিত হতে থাকি। রুদ্রকে বাড়ির কেউই পছন্দ করেনি, রুদ্রকে ছেড়ে আসায় সকলে প্রথম প্রথম খুশি হয়েছিল, কিন্তু ধীরে ধীরে আমার ডিভোর্সী পরিচয়টিই আমার সবচেয়ে বড় পরিচয় হয়ে ওঠে, আমার স্বামীহীন জীবন কারও কাছে আর তেমন ভাল লাগে না। একটি খাঁচা না হলে যেন আমাকে আর মানাচ্ছে না। খাঁচাহীন নিরীহ জন্তুটিকে খেয়ে ফেলবে যে কেউ, তাই কোনও একটি যেন তেন খাঁচায় আমাকে যে করেই হোক ঢুকতেই হবে। এফসিপিএস এ পড়ার জন্য আমার কোনও আগ্রহ নেই, আমি একটা যাচ্ছেত!ই ভবিষ্যত গড়ে তুলছি আমার, এসব নিয়ে বাবা এত বিরক্ত যে জঘন্যতম নোংরা কথা বলতে তাঁর আর বাঁধে না এখন। আমার মনে হতে থাকে যে স্বামী সংসার না থাকলেও একটি মেয়ে যে ভাল হতে পারে, তা প্রমাণ করার একটিই উপায়, কিছু অর্জন বা বর্জন। কিছু বাড়তি যোগ্যতা। কিছু বাড়তি দক্ষতা। বর্জনের মধ্যে পুস্টিকর আহারাদি বর্জন, সাধ আহলাদ আরাম আয়েস বর্জন, বিধবারা যা করে থাকে। অথবা সন্ন্যাস বরণ। অথবা আত্মহত্যা। অথবা চিতায় ওঠা। অর্জনের মধ্যে অসামান্য সাফল্য লাভ করা কোনও কিছুতে। কোনও কিছুর শীর্ষে ওঠা। সবোগচ্চ পদে অধিষ্ঠিত হওয়া। এফসিপিএস পাশ করা। এফসিপিএস এর আবরণে স্বামীহীনতার গ্লানি আমাকে ঢাকতে হবে। অসাধারণ কোনও যোগ্যতা বা দক্ষতা দেখাতে হবে আমার অস্বাভাবিক জীবনকে সহনীয় করার জন্য। যেন বয়স হলে স্বামী সন্তান না থাকাটা একধরনের পাপ, এই পাপ মোচন করতে হলে আমাকে প্রায়শ্চিত্য করতে হবে নির্বোধের মত খেটেখুটে বড় একটি ডিগ্রি নিয়ে। স্বামীহীনতা একটি যেন বিশ্রি ঘা, এটিকে ঢেকে রাখতে হলে আমার একটি মূল্যবান রঙিন চাদর চাই। আমি যেমন আছি তেমন থেকে আমার পাপ মোচন করতে পারবো না। গ্লানি দূর করতে পারবো না। কারও ক্ষমার যোগ্য হব না। অন্য কোনও মেয়ের এই বাড়তি যোগ্যতা না থাকলেও চলে, না থাকলে তাদের কেউ মন্দ বলবে না। কিন্তু স্বামীকে ছেড়েছো যখন, তোমার কয়েক ধাপ ওপরে উঠতেই হবে অন্য মেয়েদের চেয়ে। কয়েক ধাপ ওপরে উঠেই অন্য মেয়েদের কাতারে দাঁড়াবার যোগ্যতা অর্জন করবে। কী জানি, তারপরও কি অর্জন হয়! পঞ্চম শ্রেণী পাশ করা স্বামীর সংসারে গতর খেটে মরা একটি মেয়ের দিকে তো এত করুণ আর এত নিস্করুণ দৃষ্টি নিয়ে কেউ তাকায় না, আমি ডাক্তার হওয়ার পরও কেবল আমার স্বামী নেই বলে আমার দিকে যেভাবে তাকায়!