খবরের কাগজের কলামগুলোর কারণে অনেক অভাবনীয় কিছু ঘটতে লাগল। বিদ্যাপ্রকাশের খোকা আমার বই ছাপার জন্য পাগলের মত খুঁজতে লাগলেন আমাকে। অন্য পত্রিকা থেকে কলাম লেখার আমন্ত্রণ এলো। নাইমের বিশেষ অনুরোধে খবরের কাগজ ছাড়া অন্য কোথাও লেখা থেকে বিরত রইলাম কিন্তু বিদ্যাপ্রকাশ থেকে বই বের হল। একটি নয়, দুটি। নির্বাসিত বাহিরে অন্তরে আর আমার কিছু যায় আসে না। যেহেতু নির্বাসিত বাহিরে অন্তরে সকাল প্রকাশনী থেকে বেরিয়েছে, সেটি প্রথম দিই নি। আমার কিছু যায় আসে নার পাণ্ডুলিপি দেওয়ার পর খোকা আবদার করলেন নির্বাসিত বাহিরে অন্তরেও দিতে হবে। দুটো কবিতার বই ছাপতে না ছাপতেই বিক্রি হয়ে গেল। খোকা ব্যস্ত নতুন মুদ্রণে। নতুন মুদ্রণও শেষ হয়ে আসে কদিনেই। তিনি মুদ্রণ দিয়ে কুলিয়ে উঠতে পারছেন না। কোনও কবিতার বই এভাবে বিক্রি হতে বাংলাবাজারের কোনও প্রকাশকই দেখেনি আগে। এমন কি সৈয়দ হকও বইমেলায় বিদ্যাপ্রকাশের স্টলে গিয়ে রাগ দেখিয়ে এসেছেন, কারণ তাঁর বইএর চেয়ে তসলিমার বই ভাল চলছে। আমার বিশ্বাস করতে কষ্ট হয়েছে সৈয়দ হকের মত বড় লেখক এ নিয়ে রাগ করতে পারেন। তাঁর সঙ্গে আমার কোনও তুলনা হয় না এ তিনি নিজেও জানেন। যে সৈয়দ হক নিজে চিঠি লিখে আমাকে পাঠিয়েছিলেন বিদ্যাপ্রকাশের কাছে, তাঁর বরং খুশি হওয়ার কথা আমার বই ভাল চললে। খোকা জানালেন, সৈয়দ হক অখুশি।
খবরের কাগজের সাফল্যের পর নাইমের একটি পরিকল্পনা ছিল একটি দৈনিক পত্রিকা প্রকাশ করার। নাইম যা পরিকল্পনা করে, তা সে যে করেই হোক করে ছাড়ে। ঠিক ঠিকই একদিন সে আজকের কাগজ নাম দিয়ে একটি দৈনিক পত্রিকা বের করে ফেলল। ধানমণ্ডিতে কাজী শাহেদ আহমেদর বিশাল বাড়িটির দোতলায় যে ছোট একটি ঘর বরাদ্দ ছিল খবরের কাগজ আপিসের জন্য, সেটি বড় হতে হতে বিশাল হয়ে উঠল। অনেক সাংবাদিক, অনেক টেবিল, অনেক চেয়ার। খবরের কাগজ সাপ্তাহিকীটির মত আজকের কাগজ দৈনিকটিও খুব দ্রুত জনপ্রিয় হয়ে উঠল।
আমার কবিতার বইদুটো অভাবিত সাফল্য পাচ্ছে। কলামের কারণে খবরের কাগজের বিক্রি বেড়ে গেছে, প্রশংসা করে হাজার হাজার চিঠি আসছে কাগজ আপিসে। এসব যখন ঘটছে, ময়মনসিংহে কিন্তু অবস্থা সম্পূর্ণ অন্যরকম। নাইম প্রায়ই ময়মনসিংহে চলে আসে আমার সঙ্গে দেখা করতে, বার কয়েক তাকে অবকাশে দেখার পর বাবা বলতে শুরু করেছেন, ‘কে এই ছেলে, কী এত মাখামাখি এর সাথে! বাড়ির সবার মুখে চুনকালি দিয়া বিয়া করছিল নিজের ইচ্ছ! মত। তারপর কি হইল? জামাইয়ের সাথে তো দুইদিনও টিকতে পারে নাই। এহন আবার কোন ব্যাডার সাথে ঘুরাঘুরি করে? মাইনসে তো বেশ্যা কইব এরে। কোনও পুরুষ মানুষ আমার বাসায় যেন না আসে।’ মা বলেছিলেন ‘নাইম নামের ছেলেডা নাকি ওর বন্ধু।’ বাবা দাঁত খিঁচিয়ে বলেছেন, ‘বন্ধু আবার কী! বন্ধু জিনিসটা কি, শুনি? কোনও ছেলের সাথে আমি যেন মিশতে না দেখি। মিশতে হইলে যেন বিয়া কইরা লয়। আমি যদি আমার বাসায় কোনও ব্যাডারে দেখি, ঘাড় ধইরা বাসা থেইকা দুইডারেই বাইর করে দিব।’ অপমান আমাকে কামড়ে খায়। মা বলেন, ‘তর বাপে তরে বিয়া করতে কইছে। বিয়া ছাড়া এই যে মিশছ ব্যাডাইনগর সাথে, ওরাই বা কি কয়! ওরা তো খারাপ কয়।’ এ মার গরম হয়ে বাবার কথাগুলোই চালান করা। নরম হয়ে মা আবার বলেন, ‘তুমি নিজের জীবনের কথা একটু ভাব। নাইম যদি ভাল ছেলে হয়, যদি তোমার ভাল লাগে তারে, তাইলে বিয়ার কথা ভাব। বিয়া তো করতেই হইব। সারাজীবন কি একলা থাকবা?’
নাইম এরপর ফোন করলে বলে দিই হুট করে ময়মনসিংহে যেন সে আর চলে না আসে। এরপর একদিন সে ফোনে বলে যে কাল ভোর ছটার সময় আমি যেন কালো ফটকের বাইরে বেরোই। কেন বেরোবো, কি হবে বেরোলে তার কিছুই সে বলে না। পরদিন ভোরবেলা বেরিয়ে দেখি, নাইম দাঁড়িয়ে আছে রাস্তায়। পরদিনও একই জিনিস ঘটে। প্রতিদিন ভোরবেলা সে ভোরের ট্রেনে ঢাকা থেকে চলে আসে ময়মনসিংহে। যেহেতু তার জন্য অবকাশ নিষিদ্ধ হয়ে গেছে, অবকাশের বাইরের রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকে, আমাকে এক পলক দেখার আশায় তার এই দাঁড়িয়ে থাকা। অগত্যা আমাকে ভোরে উঠতে হয়, কারও ঘুম ভাঙার আগে আমাকে নিঃশব্দে দরজা খুলে বেরোতে হয়, (হাতে টুথব্রাশ নিয়ে, বাড়িতে কেউ যদি হঠাৎ জেগে ওঠে ভাব দেখাতে হয় রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে দাঁত মাজতে যাচ্ছি। এটি উদ্ভট কিছু নয়, পাড়ার লোকেরা অহরহ করে।) খুব আস্তে কেউ যেন শব্দ না পায় এমন করে কালো ফটক খুলে বেরোতে হয়। নাইমের সঙ্গে পাঁচ কি দশ মিনিট রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে কথা বলি, কোনও জরুরি কথা নয়, ওটুকুতেই সে তুষ্ট হয়ে সকালের ট্রেনেই চলে যায় ঢাকায়। এমন পাগল ছেলে আমি আগে দেখিনি। নাইমকে বলেছি, ‘তুই এমন পাগলামি করস কেন? কোনও মানে হয় না এভাবে এত দূর চলে আসার। তোর কষ্ট হয় না জার্নিতে?’
নাইম না বলে, তার নাকি মোটেও কষ্ট হয় না বরং ভোরবেলার ঘুম ঘুম নীরব জগতটি দেখতে তার খুব ভাল লাগে। প্রতি ভোরে আমার বের হওয়া সম্ভব হয় না বাইরে, ঘুমই ভাঙে না অথবা ঘুম ভাঙলেও দেখি বাবা জেগে উঠেছেন। নাইম রাস্তায় অনেকক্ষণ অপেক্ষা করে ফিরে যায়। নাইমের এই আচরণ আমাকে প্রথম ভাবায়, সে কি আমাকে ভালবাসে! নাকি আমি ছাড়া তার আর কোনও সত্যিকার বন্ধু নেই! যদি সে ভালই বাসে, কোনওদিন তো বলেনি যে সে আমাকে ভালবাসে!