কিছু কিছু আমন্ত্রণ আছে আশার অতীত। খবরের কাগজে লেখার জন্য এই আমন্ত্রণটি আমি কখনই আশা করিনি। এমন একটি জনপ্রিয় কাগজে কিছু লেখার সুযোগ পাওয়া ভাগ্যের ব্যপার। ভাগ্যের পেছনে মানুষ দৌড়োয়। ভাগ্য আমার দোরগোড়ায় এসে পড়ে থাকে। আমি তাকে মোটে ছুঁয়ে দেখি না। কিন্তু নাইমের উৎসাহ এবং তাগাদা আমাকে কাগজ কলম হাতে নিতে বাধ্য করে। কী লিখব কী লিখব ভাবতে ভাবতে হাত কচলাতে কচলাতে বাহুতে ঘসতে ঘসতে চিহ্নটি চোখে পড়ে। ডান বাহুতে সাদা একটি বৃত্ত, সিগারেটে ত্বক পোড়ার স্মৃতি। ঘটনাটি মনে পড়ে, অনেক বছর আগে একটি রাস্তার ছেলে আমার বাহুতে জ্বলন্ত সিগারেট চেপে ধরে হা হা করে হাসছিল আনন্দে। যখনই ওই দৃশ্যটি মনে পড়ে আমার, আমি সেই পোড়ার কষ্টটি অনুভব করি। সামনে কাগজ কলম, আর আমি সেই কষ্টটি অনুভব করছি। এই অনুভবটিই আমাকে লেখায় সেদিনের সেই ঘটনাটি। সিনেমা থেকে বেরিয়ে রিক্সায় চড়েছি, রিক্সা ধীরে ধীরে চলতে শুরু করেছে, তখনই অনুভব করি ডান বাহুতে তীব্র একটি যন্ত্রণা। ‘আধখাওয়া জ্বলন্ত একটি সিগারেট আমার বাহুতে চেপে ধরেছে বারো তেরো বছর বয়সের একটি ছেলে। .. ভাবছিলাম চিৎকার করব, কাউকে ডাকব, বিচার চাইব। কিন্তু কিছুই করিনি। কারণ, লোকেরা ভিড় করে আমাকে দেখবে, আমার যন্ত্রণা, আমার আর্তস্বর, আমার ক্রোধ আমার কান্না দেখবে। সবাই তারা আমাকে উপভোগ করবে। আমার ডান বাহুতে এখনও পোড়া দাগ, আমি সেই নির্যাতনের চিহ্ন এখনও বহন করে চলেছি। এ আমার সৌভাগ্য যে এখনও কেউ এসিড ছুঁড়ে আমার মুখ পোড়ায়নি, আমার দুচোখ অন্ধ করেনি, আমার সৌভাগ্য যে রাস্তাঘাটে এক পাল পুরুষ আমাকে ধর্ষণ করেনি। আমার সৌভাগ্য যে আমি এখনও বেঁচে আছি। আমার যে অপরাধের কারণে আমি এত সব অত্যাচারের আশঙ্কা করছি তা হচ্ছে আমি মেয়েমানুষ। আমার শিক্ষা আমার রুচি আমার মেধা আমাকে মানুষ করতে পারেনি, মেয়েমানুষ করেই রেখেছে। এই দেশে মেয়েরা কোনও যোগতা বলেই মানুষে উত্তীর্ণ হতে পারে না।..’ এক টানে লিখে ফেলি। নাইম ময়মনসিংহে আসে লেখা নিতে। লেখাটি দেব কী দেব না তখনও ভাবছি। এও ভয় হচ্ছে নিশ্চয়ই পড়ে ওরা বলে দেবে কিμছু হয়নি। বিষম সংকোচে লেখাটি শেষ পর্যন্ত দিই, তবে দেওয়ার সময় বলি, ‘দেখ, কলাম কি করে লেখে তা তো আমি জানি না। নিজের জীবনের একটা অভিজ্ঞতার কথা লিখেছি শুধু।’ শক্ত শক্ত শব্দ ব্যবহার করে বলিষ্ঠ কিছু একটা লেখা আমার দ্বারা হবে না বোধহয়। নাইম লেখাটি নিয়ে যায়, তবে আমার একটি সন্দেহ থেকে যায় আদৌ ওটি ছাপা হবে কী না। চমকে দেওয়া নাইমের স্বভাব। লেখাটি যেদিন ছাপা হয় সেদিনই সে ময়মনসিংহে আসে হাতে একটি পত্রিকা নিয়ে। দেখে বিশ্বাস হয় না এত বড় বড় লেখকদের কলামের পাশে আমার কলাম। এরপর প্রতি সপ্তাহেই কলাম লিখতে হয়। কী লিখব কী লিখব এ নিয়ে আর খুব একটা ভাবতে হয় না। লেখা ছাপা হওয়ার পর থেকে আমার লেখা নিয়ে প্রচুর চিঠি আসতে থাকে খবরের কাগজ আপিসে। প্রশংসা করে, নিন্দা করে। তবে প্রশংসাই বেশি। কেউ বলে, বাহ, চমৎকার। কেউ বলে, সাংঘাতিক। কেউ বলে, খুব সত্য কথা। কেউ বলে, মেয়েটি খুব সাহসী। কেউ বলে, কলাম পড়ে আমি কেঁদেছি। কেউ নাক সিঁটকায়, বলে, এসব ওর ব্যক্তিগত ব্যপার। কেউ বলে, পুরুষ বিদ্বেষী। যে পড়ে সে-ই বলে, কিছু না কিছু বলেই।
আমার কলাম নিয়ে কাগজ আপিসে, আপিসের বাইরে প্রেসক্লাবে, সাহিত্যের আড্ডায় নাকি আলোচনার ঝড় বইছে, নাইম জানায়। পাঠক নাকি সাংঘাতিক খাচ্ছে আমার কলাম। কী লিখলে পাঠক খায়, কী লিখলে খায় না তা আমার জানা নেই। পাঠক খাওয়ানোর উদ্দেশ্য আমার নয়। প্রতিটি কলাম লিখতে লিখতে আমি জানি আমার চোখ ভিজে ওঠে জলে। প্রতিটি বাক্য, প্রতিটি বাক্যের প্রতিটি শব্দ আমার কলম থেকে নামে না, হৃদয় থেকে নামে। কষ্ট গুলো বুকের ভেতরে জমা কষ্টের ঝাঁপি খুলে বেরোয়। আমার নিজের দেখা আশপাশ নিয়েই মূলত লিখি। বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক হুমায়ূন আজাদ বড় বড় প্রবন্ধের বই লিখেছেন, নতুন একটি প্রবচনের বইও লিখেছেন, মেয়েদের সম্পর্কে তাঁর নিজের অশ্লীল মন্তব্যগুলোর নাম দিয়েছেন প্রবচন। দেশের প্রখ্যাত বুদ্ধিজীবী হুমায়ুন আজাদের ভাষায় বিশ্ববিদ্যালয়ের সব মেয়েই পতিতা। এসব বলে তিনি তাঁর পুরুষভক্তদের কাছ থেকে বাহবা পান, নিজেও দেঁতো হাসি হেসে বাহবা উপভোগ করেন। তিনি যত বড় লেখকই হন, তাঁকে ছেড়ে কথা কই না আমি। এমন কি যে সৈয়দ শামসুল হকের যে চরিত্র আমি দেখেছি, সেই চরিত্র সম্পর্কে আমার যে মত, তাও প্রকাশ করি। প্রকাশ করি এইজন্য যে, সাহিত্য জগতের বড় বড় অনেক রুই কাতলার আচরণ যে পুরুষতান্ত্রিক সমাজের কোনও বদ পুরুষের আচরণের চেয়ে খুব বেশি পৃথক নয় তা বোঝাতে। যে জগতে আমার বিচরণ, সেই জগতের কথা নিজের অভিজ্ঞতা থেকে বর্ণনা করলেও সমাজের সব স্তরের মেয়েদের প্রতি পুরুষের আচরণও স্পষ্ট হয়ে ওঠে। আমার ব্যক্তিগত ব্যপার তখন আর আমার ব্যক্তিগত থাকে না, সমষ্টিগত হয়ে যায়। আমি খুব নিজে লক্ষ্য করি না, কিন্তু লোকে বলে আমার ভাষা খুব ধারালো, মেয়েদের নিয়ে অনেকে অনেক কথা ই এ যাবৎ লিখেছে কিন্তু এমন করে কেউ লেখেনি।
নাইম একসময় জানালো আমার লেখা ছাপা হলে পত্রিকার কাটতি বেড়ে যায়। অবাক লাগে। বিশ্বাস হতে চায় না। এমন কাণ্ড কি ঘটে বা ঘটতে পারে! কিন্তু পারে। খবরের কাগজে হুমায়ূন আজাদের কলামটি বেশ জনপ্রিয় ছিল, তাঁর লেখা পড়ে পাঠকরা প্রচুর চিঠি লিখত, সে সব ছাপাও হত। এখন কেন তাঁর কলাম সম্পর্কে চিঠি ছাপা হয় না, তসলিমার লেখা বিষয়ে বেশির ভাগ চিঠি ছাপা হয়, এ নিয়ে হুমায়ুন আজাদ অভিযোগ করলেন, ক্ষেপে আগুন তিনি। পত্রিকার লোকেরা বলে দিয়েছে, তসলিমার বাহিরে অন্তরে কলামের আলোচনা সমালোচনা করেই মানুষ আজকাল বেশি লেখে, আপনি আপিসে নিজে এসে দেখে যেতে পারেন চিঠির স্তূপ। তারপরও নাকি ভীষণ চেঁচামেচি। এত নাম আছে লোকটির, তারপরও নাম চাই। তিনি গভীর ভাবে বিশ্বাস করেন, এ দেশে সব খারাপ লেখক, এক তিনিই শুধু ভাল। তিনিই একমাত্র কবি। আর যারা কবিতা লেখে, সবাই অকবি। শেষ অবদি এমন হল যে তিনি নিজের লেখার প্রশংসা করে ছদ্মনামে চিঠি পাঠাতে লাগলেন খবরের কাগজের চিঠিপত্র কলামের জন্য। যে লোকটি দিয়ে তিনি কলাম পাঠান কাগজ আপিসে, সেই লোকই সেসব চিঠি বহন করে নিয়ে আসে। হায় কাণ্ড, মহীরূহরা তুচ্ছ তৃণকে ঈর্ষা করছেন!