‘ওরা যাবে কোথায়? যাবার তো ওদের কোনও জায়গা নেই। কী ক্ষতি যদি থাকে!’ ‘অনেক ক্ষতি, অনেক ক্ষতি।’
কী ক্ষতি, তা মুজিবর রহমান তোমাকে বুঝিয়ে বলেন না। এই বচসায় তুমি হেরে যাও। তোমার চেয়ে মুজিবর রহমানের দাপট বেশি। তিনি পুরুষ। মুজিবর রহমান আর সাইদুল ইসলাম পুরুষ এবং অফিসার হওয়ার দাপটে যখন সন্ত্রস্ত করে রাখে আপিসের সহকারিদের, কর্মীদের, তুমি অফিসার হয়েও মিশে থাকো কেরানি আর কর্মীদের সঙ্গে। তোমাকে অফিসার বলে মনে হয় না, তোমাকে মনে হয় তুমি ওইসব অল্প বেতন পাওয়া মানুষদের একজন। ওদের পাশের বাড়ির মেয়ে তুমি অথবা ওদের খালাতো বোন নয় মামাতো বোন। কর্মীরা তাদের জীবনের খুঁটিনাটি অকপটে বলতে থাকে তোমার কাছে। তুমি শুনতে থাকো। যেহেতু তুমি আপিসের সকলের চাইতে বয়সে ছোট, তোমাকে দেখলেই তোমার দ্বিগুন ত্রিগুণ বয়সের কর্মীদের চকিতে দাঁড়িয়ে স্লামালেকুম ম্যাডাম বললে তুমি অস্বস্তি বোধ কর। যেন এটি না করে কেউ, তুমি অনুরোধ কর। তোমার মায়ের বয়সী আয়শা খাতুনও তুমি ঘরে ঢুকলে দাঁড়িয়ে তোমাকে স্লামালেকুম ম্যাডাম বলতেন, তিনি সোজাসুজি বলে দিয়েছো এই কাজটি করলে তুমি আর ঘরে ঢুকবেই না। তুমি স্বস্তি বোধ কর সহজ মেলামেশায়, কথায়, কৌতুকে। তুমি যত প্রিয় ওঠো নিচুতলায়, তত তুমি অপ্রিয় হও উঁচুতলায়। দেখা যায়, তুমি অফিসার হয়েও অফিসার নও। তুমি, আপিসের পিয়নটি তার মেয়েকে ইশকুলে ভর্তি করাবে কিন্তু টাকা নেই, টাকা দিচ্ছ। কারও টাকা ধার লাগবে, দিচ্ছ এবং ইচ্ছে করেই ভুলে যাচ্ছে! টাকা ফেরত নেওয়ার কথা। কারও চিকিৎসা হচ্ছে না, চিকিৎসার ব্যবস্থা করছ। আপিসে যেহেতু কোনও কাজ নেই, তুমি কাজ খুঁজতে খুঁজতে একটি কাজ নিজে ইচ্ছে করেই নাও। কাজটি মূলত সাইদুল ইসলামের, তিনি মাঝে মধ্যে পরিবার পরিকল্পনার কর্মীদের নিয়ে গ্রামে গঞ্জে যান স্টেরিলাইজেশন ক্যাম্প করতে। গ্রামের কোনও ইশকুল ঘরে কর্মীদের মাধ্যমে যোগাড় করা মানুষদের লাইগেশন আর ভ্যাসেকটমি করেন তিনি। তুমিও এখন নৌকোয়, রিক্সায়, গরুর গাড়িতে, হেঁটে যেতে থাকো সেসব ক্যাম্পে। লাইগেশন করতে থাকো, ভ্যাসেকটমিও কদাচিৎ কর। ভ্যাসেকটমি যাদের কর, তারা আশি নব্বই বছরের দরিদ্র বুড়ো, রাস্তায় যায় যায় হৃদপিণ্ড নিয়ে হয়ত চিৎ হয়ে পড়ে ছিল, কর্মীরা কাঁধে করে এনে ক্যাম্পে ফেলেছে। পুরুষ সে যে বয়সেরই হোক না কেন, ধন হারাতে চায় না। ক্যাম্পে বিভিন্ন বয়সের মেয়েদেরই ভিড়। তুমি জানতে পারো, যে, যে মেয়েদের ছটি সাতটি করে সন্তান এবং শরীর কাহিল হচ্ছে ঘন ঘন সন্তানজন্মদানে, তারা সকলে বন্ধ্যাকরণে রাজি হলেও ক্যাম্পে আসার অনুমতি পাচ্ছে না। না পাওয়ার কারণ তাদের স্বামী। স্বামীরা মনে করছে আল্লাহ তায়ালা সন্তান দিতে ইচ্ছে করছেন তাই দিচ্ছেন, আল্লাহ তায়ালার ইচ্ছের বিরুদ্ধে কিছু করা অন্যায়। তুমি জানতে পারো, যে, লেখাপড়া শিখিয়ে মানুষ করে তোলা তো দূরের কথা, সন্তানের মুখে দুবেলা ভাত দেবার যাদের সামর্থ নেই তারাও বছর বছর সন্তান জন্ম দিচ্ছে কিন্তু আল্লাহ তায়ালার ভয়ে বন্ধ্যাকরণের দিকে পা বাড়াচ্ছে না। কর্মীদের বলে দিচ্ছে, আল্লাহ সন্তান দিতাছে, আল্লাহই খাওয়াবো। এও জানতে পারো তুমি, যে, পাঁচটি বা ছটি বা সাতটি সন্তান জন্ম দেবার পরও মেয়েরা গর্ভবতী হচ্ছে, কারণ সেসব মেয়েদের স্বামীরা পুত্রসন্তানের অপেক্ষা করছেন। আরেকটি জিনিস তুমি লক্ষ্য কর, যে, মেয়েরা যারা য়েচ্ছ!য় লাইগেশন করতে আসে, তারা মূলত আসে একটি শাড়ি আর নগদ একশ কুড়ি টাকা পাওয়ার জন্য। সরকার থেকে লাইগেশনের উপহার এই ই দেওয়া হয় কি না। তুমি আবিস্কার করতে থাকো, যে, যদিও যার অন্তত দুটি সন্তান নেই এবং ছোট সন্তানের বয়স অন্তত পাঁচ বছর নয়, তার লাইগেশন করা নিষেধ কিন্তু চরম দারিদ্র অনেক মেয়েদের মিথ্যে বলিয়ে নিয়ে আসে ক্যাম্পে, সে কেবল ওই সরকারি উপহারের জন্য। তুমি এও আবিস্কার কর যে ওই মাত্র একশ কুড়ি টাকা থেকেও ভাগ বসায় কিছু পরিবার পরিকল্পনার দালাল। তুমি আবিস্কার করতে থাকো যে যারা নিজেদের বয়স তিরিশ বা পঁয়ত্রিশ বলছে এবং নিজেদের দু সন্তানের মা বলছে, তাদের অনেকের বয়স ষোলো কী সতেরো এবং তারা নিঃসন্তান। একটি সস্তা সুতির শাড়ি আর একশ কুড়ি টাকার জন্য তারা সারাজীবনের জন্য বন্ধ্যা হতে চাইছে। তুমি আবিস্কার কর তোমার দেশের দারিদ্র। তুমি শিহরিত হও। তুমি কাঁদো।
০২. খুঁটিনাটি
যে মেয়েটির সঙ্গে কলেজের শেষ দিকে আমার বন্ধুত্ব জমে উঠেছিল সে শিপ্রা, শিপ্রা চৌধুরি। শিপ্রার দুটি জিনিস আছে, যে জিনিসটি আমাকে আকর্ষণ করে তা তার রসবোধ আর যে জিনিসটি বিকর্ষণ করে তা হল যে কোনও কিছু নিয়ে তার উদ্বিগ্নতা। দেখছে ক্লাসের একটি মেয়ে লিভারের অসুখগুলো পড়ছে শিপ্রা সঙ্গে সঙ্গেই উদ্বিগ্ন, কেন মেয়েটি লিভারের অসুখ পড়ছে, নিশ্চয়ই এ নিয়ে পরীক্ষায় প্রশ্ন থাকবে! তক্ষুনি সে রাত জেগে লিভারের অসুখ পড়া শুরু করে দিল। কেউ একজন বলল, হোস্টেলে থেকে লেখাপড়া না করলে মেডিকেলের লেখাপড়া ঠিক হয় না। যেই না বলা, যদিও বাড়িতে বসে শিপ্রার লেখাপড়া চমৎকার হচ্ছিল, ব্যাগে কাপড় চোপড় ভরে সে হোস্টেলে রওনা হল। শিপ্রার পড়ার সঙ্গী ছিল একটি ছেলে। ভাল ছাত্র হিসেবে ছেলের নাম ছিল। এরপর আরও ভাল ছাত্র হিসেবে যখন আরও কজনের নাম হল, তখন শিপ্রা সেই আরও ভালর দিকে নজর দিতে শুরু করল, মুখ চোখ ওর বিষাদাচ্ছত। কেন সে সেই আরও ভালদের পাচ্ছে না সঙ্গী হিসেবে! শিপ্রার স্বস্তি নেই সহজে। শিপ্রার বাড়ি শহরে। খাগডহর পার হয়ে জেলখানা, জেলখানার কাছে পুরোনো বোম্বাই কলোনি, সেখানে তার মা আর সে থাকে। বাবা অনেক আগেই শিপ্রার মাকে ছেড়ে চলে গেছে। শিপ্রার মা চাকরি করেন কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে। চাপাই নবাবগঞ্জের মানুষ তিনি, বদলির চাকরিতে ঘুরতে ঘুরতে এই ময়মনসিংহে এসে থিতু হয়েছেন। শিপ্রার মাকে দেখলে অগাধ শ্রদ্ধা জাগে। এমন স্বনির্ভর, এমন আত্মপ্রত্যয়ী মা খুব একটা দেখা হয়নি আমার। শিপ্রা এই শহর থেকেই বিদ্যাময়ী পাশ করে আনন্দমোহন পাশ করে মেডিকেলে ঢোকে। এতবছর এ শহরে থেকেও শিপ্রা কথা বলে রাজশাহীর ভাষায়। ময়মনসিংহের ভাষার তুলনায় পরিচ্ছত, সুন্দর। আইবাম, খাইবাম, যাইবাম চন্দনার মত রপ্ত করা শিপ্রার পক্ষে সম্ভব হয় না, এখনও সে আসব খাব যাবতে রয়ে গেছে। তা থাক, শিপ্রা যেমন আছে, তেমন থাকলেই দেখতে ভাল লাগে। শিপ্রা লম্বায় আমার চেয়ে দুইঞ্চি বেশি, মেদ মাংসে আমার চেয়ে কেবল দুইঞ্চি নয়, অনেক ইঞ্চিই বেশি। ক্লাসের সবচেয়ে লম্বা মেয়ে বলে আমার পরিচয়খানি শিপ্রার সামনে এসে খুব ম্লান না হলেও খানিকটা তো হয়ই। এই ম্লানতা আমাকে, আমি লক্ষ্য করেছি, ছুঁতে পারে না।