আমি মুগ্ধ নয়নে পূর্ণেন্দু পষনীকে দেখছি, কথা বলতে গেলে যদি ভুল কিছু বলে ফেলি, এই ভয়ে কথাই বলছি না কিন্তু, নাইম, দিব্যি, যেন পষনী তার খালাতো ভাই এমন গলগল করে তাও আবার কুমিল্লার উচ্চারণে লেখা চাইছে। যেন লেখা চাইছে কোনও সংববদপত্রের ছাপোষা কলামিস্টের কাছে। এত বড় বড় কবির সঙ্গে নাইমের কোনও ভেবে চিন্তে কথা বলতে হয় না। লেখা চাওয়া তার কাছে কি ভাই লেখাটা এহনও দিতাছেন না যে! যত তাড়াতাড়ি পারেন লেখাটা রেডি কইরা রাইখেন, কালকের মধ্যেই চাই এর মত সহজ। নাইম কারও লেখা পড়েনি, কাউকেই তার বিশাল কিছু মনে হয় না। নাইমের উচ্চাকাংখা প্রচণ্ড। নামী দামী সাহিত্যিককে দিয়ে লেখাতে পারলে তার পত্রিকা ভাল চলবে, সম্পাদক হিসেবে তার নাম হবে, এটিই তার কাছে বড়। কারও সময় আছে কী না কলাম লেখার, কেউ আদৌ কলাম লিখতে চান কী না বাংলাদেশের একটি নতুন কাগজে, তাও জানতে চায় না। সে টাকার কথা বলে, এও জানতে চায় না তার ওই কটি টাকার কারও প্রয়োজন আছে কী না। অবশ্য লিখেছেন অনেকে, সে পূর্ববাংলাকে ভালবাসেন বলেই লিখেছেন, আমার মনে হয় না অন্য কিছুর জন্য।
সৌমিত্র মিত্র একসঙ্গে ঠিক কতগুলো কাজ করেন, তা আমার পক্ষে ধারণা করা শক্ত। যতক্ষণই তাঁকে দেখেছি, তিনি কিছু না কিছু নিয়ে ব্যস্ত। আবৃত্তি করেন, ওদিকে আবার সরকারি তথ্য অফিসারের চাকরি করেন। কুমুদ মান্না নামের এক ব্যবসায়ী লোককে বলে আমাদের নৌকো চড়াবার ব্যবস্থা করলেন একদিন। রাতের গঙ্গা। গঙ্গা দেখার বড় শখ ছিল আমার। গঙ্গার জল ছলাৎ ছলাৎ করে শব্দ তুলে আমার পা ভিজিয়ে দেয়। আমি ব্রহ্মপুত্রের সঙ্গে গঙ্গার কোনও অমিল দেখতে পাই না। আমি যখন গঙ্গার বিভোর ছিলাম, নাইম গঙ্গার দিকে পেছন ফিরে তার ভাবনার গভীর জলে ডুবে ছিল কী করে আমাকে আরও বেশি বিহ্বল করা দেওয়া যায়, আমাকে আরও বিমুগ্ধ করা যায়!
হঠাৎ নাইম আমাকে এক সকালে বলল, ‘তাড়াতাড়ি রেডি হ। একজায়গায় যাইতে হইব।’কোন জায়গা তার কিছুই বলে না সে। তারপর ইস্টিশনে নিয়ে ট্রেনে ওঠালো, সৌমিত্র মিত্রও যাচ্ছেন আমাদের সঙ্গে, তিনি বললেন যে শান্তিনিকেতনে যাচ্ছি আমরা। শান্তিনিকেতন! ঝিরঝির শান্তি ঝরতে থাকে হৃদয়ে। আমার আনন্দিত চোখদুটো নাইম দেখল। প্রতিদিনই নাইম আমাকে চমক দিচ্ছে। গোপনে যে সে আয়োজনটি করে রেখেছিল, তার কোনও আভাস পাইনি। শান্তিনিকেতনে পৌঁছে আমার জীবন সার্থক হয়। শান্তিনিকেতনে তখন মিষ্টভাষী মৃদুভাষী কবি শঙ্খ ঘোষ ছিলেন। প্রিয় লেখক, প্রিয় কবিদের সঙ্গে দেখা হলে কী কথা বলব ভাবতে ভাবতেই আমার সময় যায়। বেশির ভাগই বাকরুদ্ধ বসে থাকি। কী এক ঘোরের মধ্যে সারাদিন রবীন্দ্রনাথের বাড়িঘর, ছাতিমতলা, আম্রতলা সব ঘুরে ঘুরে দেখি। যে সব জায়গায় দর্শকের ঢোকা নিষেধ, শান্তিনিকেতনের উপাচার্যের কল্যাণে সে সব জায়গাতেও আমাদের ঢোকার অনুমতি মেলে। রবীন্দ্রনাথের চেয়ারে বসিয়ে নাইম আমার ছবি তুলতে চাইছিল, এত বড় স্পর্ধা আমার হয়নি সেই চেয়ারে বসার, আমি মেঝেয় বসি। সবকিছু আমার যেন কেমন স্বপ্নের মত লাগছিল, রাতে গেস্ট হাউজে ফিরে গিয়ে রবীন্দ্রনাথের বিশালতার কথা ভেবে আমার আবেগ উপচে পড়ে। কেঁদে ভাসাই। কোনও কল্পিত ঈশ্বরের পায়ে পড়ে লোকে যেমন কাঁদে, আমার কান্নাও তেমন। তবে এ ঈশ্বর বটে, কল্পিত নয়। না, আমি কোনও পাপ মোচনের অনুরোধ করে কাঁদি না। এ কান্না কোনও সুখের নয়, দুঃখের নয়। এ কান্না রবীন্দ্রনাথকে তীব্র করে অনুভব করার কান্না। আমার কান্নার কোনও কারণ নাইমের পক্ষে বোঝা সম্ভব হয়নি। সে আমার পিঠে হাত রাখে, পিঠের হাতটি একটু একটু করে নিচের দিকে নামে। হাতটি আমার সন্দেহ হয় যে আমার প্যাণ্টের বোতামের দিকে নামতে চাইছিল। আমি দ্রুত সরিয়ে দিই নাইমের হাত। সম্ভবত সে ভেবেছে, আর সব পুরুষের মত, যে, যে মেয়ে কোনও পুরুষ নিয়ে অনেকদিনের জন্য হাওয়া হয়ে যায়, হোটেলে রাত কাটাতে দ্বিধা করে না, তার কাছে নিশ্চয়ই শারীরিক সম্পর্ক নিতান্তই ডালভাত। নাইমকে আমি ভেবেছিলাম সবার থেকে আলাদা। কিন্তু তার হাতটি আমার পিঠ থেকে নিচের দিকে নামছিল বলে ইচ্ছে না হলেও তাকে আমার তাদের কাতারেই ফেলতে হয় যারা মেয়েমানুষের শরীর দেখলে লোভ সংবরণ করতে পারে না। কিন্তু এরকম কি কোনও পুরুষ আছে হাতের কাছে কোনও রমণী পেয়েও কামগন্ধহীন রাত কাটাতে পারে! নেই হয়ত। নাইমের চরিত্রের অন্য দিকগুলো আমার ভাল লাগে বলে আমি ক্ষমা করে দিই তার ওই কুৎসিত হাতটিকে। তাকে একটুও বুঝতে দিই না যে আমি বুঝেছি তার হাত যে নামছিল, নাইমও এমন ভাব করে যে হাতটি সে পিঠেই কেবল রেখেছিল, মোটেও তার হাতটির গন্তব্য অন্য কোথাও ছিল না।
কলকাতা থেকে ফিরে আসার পর নাইম আমাকে তার পত্রিকায় আমাকে কলাম লেখার আমন্ত্রণ জানায়। এ পর্যন্ত যা কিছু লিখেছি পত্রিকায় তা কবিতা আর গল্প। কোনওদিন কলাম বলে কোনওকিছু লিখিনি। আমি ‘ধুর কলাম কি করে লিখতে হয় আমি জানি না,’ বলে উড়িয়ে দিতে চাইলে সে বলে, ‘তোর যা ইচ্ছে করে তাই লেখ, ঘাবড়ানির কিছু নাই।’ ঘাবড়ানির কিছু নাই হয়ত, কিন্তু আমি ঘাবড়ে যাই। কলাম লেখার অভ্যেস অভিজ্ঞতা না থাকলে কি করে লিখব! নাইম জোর করে, ‘লিখতেই হবে। হক ভাই বইলা দিছে তোরে যেন কলাম লিখতে বলি।’ সৈয়দ হক আমাকে স্নেহ করেন জানি, নিজে তিনি আমার কবিতা পড়ে তাঁর বইয়ের প্রকাশক বিদ্যাপ্রকাশএর মালিক মজিবর রহমান খোকাকে বলেছেন আমার বই ছাপতে। একটি চিঠিও লিখে দিয়েছিলেন যেন সেই চিঠি আর আমার কবিতার বইয়ের পাণ্ডুলিপি নিয়ে খোকার সঙ্গে দেখা করি। করেছিলাম, খোকা বলেছেন, ‘আমরা তো নতুন কবির কবিতার বই ছাপি না। তবে আপনি যদি টাকা দেন, তাহলে ছাপতে পারি।’ রাগ করে চলে এসেছিলাম। টাকা দিয়ে যদি বই ছাপতে হয় তাহলে নিজেই ছাপতে পারি। খবরের কাগজ পত্রিকাটি সম্পূর্ণ অন্য ধরনের একটি কাগজ। সাপ্তাহিক পত্রিকার যে চরিত্র বিচিত্রা তৈরি করেছিল, বিচিত্রার পথ অনুসরণ করে সন্ধানী আর রোববার বেরিয়েছে, কিন্তু সব চলতি ধরন ভেঙে নতুন চরিত্রে খবরের কাগজ দেখা দিয়েছে। নিউজপ্রিণ্টে ছাপা। পঈচ্ছত নিউজপ্রিণ্টে। দাম কম। যে কারও কেনার সামর্থ আছে। কোনও কবিতা গল্প নেই, সিনেমার খবর নেই। খবরের মধ্যে এক রাজনীতির খবর। বাকি লেখাগুলো কলাম, রাজনীতি সমাজ সাহিত্য নিয়ে বড় বড় লেখক বুদ্ধিজীবী আর রাজনীতিবিদদের কলাম। যে লেখকরা আগে কোনওদিন কলাম লেখেনি, এই প্রথম তারা খবরের কাগজের জন্য কলাম লেখা শুরু করেছে। এত জনপ্রিয় লেখকদের এক সঙ্গে এক পত্রিকায় জড়ো করা নতুন একটি ঘটনা বটে। পত্রিকা জগতে খবরের কাগজ একটি আন্দোলনের মত।