নির্বাসিত বাহিরে অন্তরের দুধরাজ কবি নিয়েও কথা হয়। দুধরাজ কবিটি হচ্ছে রুদ্র, কানাকানি চলে। যাকে উদ্দেশ্য করেই লিখি না কেন, কবিতা কেমন হল, আদৌ হল কী হল না, সেটিই বড়। শব্দের আড়ালে মানুষ ক্রমশ ম্লান হয়ে আসে। এ কবিতা কি আমি রুদ্রকে উদ্দেশ্য করে লিখেছি! যাকে উদ্দেশ্য করেই লিখি না কেন, এটি কবিতা। কবিতার পেছনে কে লুকিয়ে আছে, এটি আমার কাছে আর গবেষণার বিষয় নয়।
তার চে কুকুর পোষা ভাল
ধূর্ত যে শেয়াল, সেও পোষ মানে,
দুধ কলা দিয়ে আদরে আহলাদে এক কবিকে পুষেছি এতকাল,
আমাকে ছোবল মেরে
দেখ সেই কবি আজ কিভাবে পালায়।
এই কবিতার শোধ নিতে গিয়ে রুদ্র নিজে একটি কবিতা লেখে।
তুমি বরং কুকুর পোষো,
প্রভু ভক্ত খুনসুটিতে কাটবে তোমার নিবিড় সময়।
তোর জন্য বিড়ালই ঠিক,
বরং তুমি বিড়াল পোষো
খাঁটি জিনিস চিনতে তোমার ভুল হয়ে যায়,
খুঁজে এবার পেয়েছো ঠিক দিক ঠিকানা।
লক্ষ্মী সোনা, এখন তুমি বিড়াল এবং কুকুর পোষো।
শুকরগুলো তোমার সাথে খাপ খেয়ে যায়,
কাদা ঘাটায় দক্ষতা বেশ সমান সমান।
ঘাটাঘাটির ঘনঘটায় তোমাকে খুব তৃপ্ত দেখি,
অুমি বরং ওই পুকুরেই নাইতে নামো,
ঊংক পাবে, জলও পাবে।
চুল ভেজারও তেমন কোনো আশঙ্কা নেই,
ইচ্ছে মত যেমন খুশি নাইতে পারো।
ঘোলা পানির আড়াল পেলে
কে আর পাবে তোমার দেখা!
মাছ শিকারেও নামতে পারো
তুমি বরং ঘোলা পানির মাছ শিকারে
দেখাও তোমার গভীর মেধা।
তুমি তোমার স্বভাব গাছে দাঁড়িয়ে পড়ো,
নিলিঝিলির স্বপ্ন নিয়ে আর কত কাল?
শুধু শুধুই মগজে এক মোহন ব্যাধি
তুমি বরং কুকুর পোষো, বিড়াল পোষো।
কুকুর খুবই প্রভুভক্ত এবং বিড়াল আদরপ্রিয়,
তোমার জন্য এমন সামঞ্জস্য তুমি কোথায় পাবে?
রুদ্রর এই কবিতা পড়ে আমার মন খারাপ হয়। হয় কিন্তু তারপরও আমার জানতে ইচ্ছে হয় রুদ্র কেমন আছে, কি করছে, ভাল আছে তো! এই ইচ্ছেটি যখনই ময়মনসিংহ থেকে ঢাকায় যাই, অন্তত একবার হলেও অসীম সাহার ইত্যাদিতে আমাকে নিয়ে যায়। ওখানে নির্মলেন্দু গুণ আর অসীম সাহার সঙ্গে আমাকে অনেকক্ষণ বসিয়ে রাখে। মোংলা থেকে এখনও ফেরেনি অথবা শিমুলকে নিয়ে ব্যস্ত এরকম খবর জোটে। পায়ের অসুখ সেরেছে কি? হাঁটতে পারছে? হাঁটে তবে থেমে থেমে। শুনি আমি, কোনও ক, খ, গ, ঘর পায়ের খবর শোনার মত শুনি। ভেতরে প্রাণ ফেটে যায় জানতে আরও কিছু, আরও অনেক কিছু। রুদ্র কি আমার কথা ভাবে, কিছু বলে! এসব এখন আর জিজ্ঞেস করা মানায় না। দীর্ঘ শ্বাস ফেলাও মানায় না, দীর্ঘ একটি শ্বাস তাই গোপন করি। বিয়ে ভেঙে গেলে অনেকে পরস্পরের শত্রু হয়ে যায়। আমি রুদ্রর শত্রু হব বা রুদ্র শত্রু হবে আমার, এমন আমি কখনও কল্পনাও করি না। এমন কি যে বন্ধুরা আমি বিয়ে ভাঙা একলা মেয়ে বলে অন্ধকার সুযোগ খুঁজেছে আমার শরীরের দিকে শরীর বাড়াতে, তাদের আমি নিজগুণে ক্ষমা করে দিই, বন্ধুত্ব নষ্ট করে দেওয়ার কথা ভাবি না।
খবরের কাগজে নাইম নির্বাসিত বাহিরে অন্তরের কিছু বিজ্ঞাপন ছেপে দেয়। একদিন বলে পরিবেশকরা খবর দিচ্ছে, বই বিক্রি হচ্ছে ভাল। এটুকু শুনেই আমি খুশি। নাইমের উদারতা আমাকে এমন বিনয়ী করে তোলে যে বই বিক্রির টাকার কথা তাকে আমি জিজ্ঞেস করি না। নাইমের আরও একটি উদারতা আমাকে চমকিত করে, কলকাতা যাওয়ার আগে তাকে আমি বলিনি যে আমি মিলনের সঙ্গে যাচ্ছি, কিন্তু সে যখন জানতে পারে যে আমি একা যাইনি, মোটেও সে এ নিয়ে তামাশা করেনি।
কলকাতা থেকে ফিরে আসার পর বইমেলায় আমাকে পেয়ে শাহরিয়ার বেশ ভালমানুষের মত প্রশ্ন করেছে, ‘কেমন কাটালে ভারতে?’
আমিও ভালমানুষের মত উত্তর দিয়েছি, ‘ভালই।’
‘কোথায় কোথায় গেলে?’
‘গিয়েছি অনেক জায়গায়। অতসীর সঙ্গে দেখা হয়েছে। চমৎকার মেয়ে অতসী।’
এরপরই ভালমানুষের মত আরেকটি প্রশ্ন, ‘এসটর হোটেলে মিলনের সঙ্গে রাতগুলো ভাল কেটেছে তো!’
খানিকটা চমকাই। খবর তাহলে জানা হয়ে গেছে শাহরিয়ারের। খবরটি যে অতসীর কাছ থেকে পেয়েছে, তা বুঝি। কলকাতা যাচ্ছি শুনে শাহরিয়ারই আমাকে অতসীর ঠিকানা দিয়েছিল, বলেছিল যেন দেখা করে বলি যে আমি শাহরিয়ারের বন্ধু। দেখা করেছিলাম, খুব ভাল সময় কেটেছিল অতসীর সঙ্গে, অতসী কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের মেয়ে। সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে তো বটেই, বাড়ির আর সবার সঙ্গেও চমৎকার একটি সম্পর্ক গড়ে উঠেছে আমার। আমি একা যাইনি, আমার সঙ্গে মিলন গিয়েছে, এ খবরটি শাহরিয়ার অন্য রকম করে বলতে পারতো, কিন্তু তা না করে বোলতার মত এসে হুল ফুটিয়ে দিল। শাহরিয়ার এমনই। নির্বিকার হুল ফুটিয়ে যায়। অথচ নাইম কিন্তু হুল ফোটায় নি, যে কোনও সাধারণ খবর দেওয়ার মত বলেছে যে আমি কলকাতা যাওয়ার পর সে মিলনের বাড়িতে গেছে, মিলনের বউ জানিয়েছে যে মিলন কলকাতা গেছে, তখনই সে ধরে নিয়েছে মিলন আর আমি একসঙ্গে গিয়েছি। দুজন না গিয়ে আমি তো একাও যেতে পারতাম! পারতাম না কি! পারতাম। ভারতের যেখানে যেখানে ঘুরেছি, অনায়াসে সে জায়গাগুলোয় একা ঘোরা যেত। তবে একা ঘুরলে হয়ত ভাল লাগত না। অনেককিছু একা করতে ইচ্ছে হয় না। কোথাও যেতে হলে সঙ্গে একজনকে নেওয়া চাইএর অভ্যেস আমার অনেকদিনের। ইয়াসমিন মাঝে মাঝে রাগ হয়ে বলত, ‘তোমার বান্ধবীর বাসায় যাইতাছ, একলা যাও, সব সময় আমারে নিয়া যাইতে হইব কেন!’ অথবা রুদ্র ময়মনসিংহে এলে তার সঙ্গে দেখা করতে গেলেও ইয়াসমিনকে নিয়ে যেতাম। ইয়াসমিন হাতের কাছে না থাকলে সুহৃদকে। রুদ্র অনেকদিন রাগ করে বলেছে, তুমি একা আসতে পারো না! নিশ্চয়ই পারি, কেন পারবো না! একা কলেজে যাচ্ছি, কলেজ থেকে একা বাড়ি ফিরছি। সবই হচ্ছে। কিন্তু সঙ্গে কেউ একজন থাকলে ভাল লাগে। আপন কেউ থাকলে ভাল লাগে। সবে মাস পেরোলো কলকাতা থেকে ফিরেছি, হঠাৎ একদিন নাইমের আবদার, ‘চল কলকাতা যাই, সাত দিনের জন্য।’ কেন? কেন তা নাইম বলে না। কেন সে যাবে কলকাতা তা খুব করে যখন জানতে চাই, সে বলে পত্রিকার জন্য কিছু ব্যবসায়িক কাজ আছে তার, তাই সে যাচ্ছে। সে তার কাজ নিয়ে ব্যস্ত থাকবে, আমার যদি কলকাতায় ঘুরে বেড়াতে ইচ্ছে হয়, আমি অনায়াসে তা করতে পারি। এমনিতে নাচুনে বুড়ি, তার ওপর ঢোলের বাড়ি। নাইমের প্রস্তাবে আমার রাজি হওয়ার আরও একটি কারণ ছিল, ময়মনসিংহের বাড়ি আমার কাছে বড় দুর্বিষহ হয়ে উঠৈছিল। সুহৃদ নেই, ইয়াসমিন নেই। বাড়িটিতে যতক্ষণ থাকি মরার মত শুয়ে থাকি। এক অসহ্য নিঃসঙ্গতা আমাকে ছিঁড়ে খাচ্ছিল, তার পরও যদি ডাক্তারির চাকরিতে সামান্য স্বস্তি থাকত, ওখানেও অলস অবসর জুড়ে রাজ্যির ভাল না লাগা আমাকে ঘিরে ধরে। কলকাতা রওনা হই। তবে যাবার আগে মোটেও ভুলি না সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের জন্য গরুর মাংস নিতে। তিনি গরুর মাংস খেতে চেয়েছিলেন। কথা দিয়েছিলাম এর পর কখনও এলে নিশ্চয়ই নিয়ে আসব।