কলকাতা থেকে ফিরে অবকাশে একা বসে থাকি। কেউ নেই যার কাছে কোথায় গিয়েছি কি করেছি সব গল্প শোনাবার। কেউ নেই যাকে নিয়ে বসে কলকাতা থেকে আনা গানের আর আবৃত্তির ক্যাসেট গুলো শুনব। আমার সুটকেস পড়ে থাকে সুটকেসের মত, কেউ ঝাঁপিয়ে খোলে না, কেউ বলে না কি কি আনছ দেখি, আর পছন্দ হলে এইটা আমারে দেও ওইটা আমারে দেও আবদার করার। শান্তিদেব ঘোষের খালি গলায় আমি কান পেতে রই গানটি শুনতে শুনতে উদাস শুয়ে থাকি অবকাশের একলা বিছানায়। ইয়াসমিন যদি অবকাশে থাকত, সেই আগের মত থাকত, গানটি শুনে ও পাগল হয়ে যেত। সেই মন খারাপ করা বিকেলে ফোন করি মিলনের বাড়িতে, ফোনের ওপাশে ইয়াসমিনের গলা শুনে রিসিভারটি পেতে রাখি আমি কান পেতে রই গানটির কাছে। গানটি শেষ হলে নিঃশব্দে কান পেতে থাকি ওদিক থেকে নিঃশ্বাসের শব্দ ভেসে আসে কি না, ওদিকেও কান পেতে আছে কি না ও। আছে, কান পেতে আছে, ওদিক থেকে কান্নার শব্দ ভেসে আসছে। এদিকে বুক ভেঙে যাওয়ার শব্দ। একটি হু হু করা সুর বুঝি সত্যিকার গানের শিল্পীকে না কাঁদিয়ে পারে!
বিয়ে যখন করেছেই, যখন ফেরানোই যাবে না, অবকাশের সবাই ইয়াসমিনের সঙ্গে যোগাযোগ শুরু করল। এক আমি ছাড়া। ইয়াসমিনও হঠাৎ হঠাৎ অবকাশে আসে পাজামা পাঞ্জাবি পরা মিলনকে নিয়ে। অতিথির মত আধঘন্টা একঘন্টা থেকে চা বিস্কুট খেয়ে ফিরে যায় শ্বশুর বাড়িতে। ও এলে আমি ঘরের দরজা বন্ধ করে বসে থাকি। বাবা যেদিন দীর্ঘ দীর্ঘ শ্বাস ফেলে মার ক্রমাগত অনুনয়ের পর মেনে নিলেন বিয়েটি এবং ইয়াসমিনকে লাল বেনারসি আর সোনার গয়না গাটি কিনে দিয়ে মিলনের কিছু আত্মীয় স্বজনকে খাইয়ে বিয়ের ঘরোয়া অনুষ্ঠানটি করে দিলেন অবকাশ থেকে, সেদিনও আমার ঘরের দরজা বন্ধ ছিল। এই ইয়াসমিন অন্য ইয়াসমিন, আমি পারিনি ওর সামনে সহজ হতে, ও নিজেও পারেনি। ও এখন যে কোনও গৃহবধু, ও এখন বিয়ে হয়ে যাওয়া যে কোনও মেয়ে। খবর পাই শ্বশুর বাড়ির কড়া নিয়ম কানুনের মধ্যে আছে ও। শাশুড়ি, ভাসুর, ভাসুর বউ, স্বামী, স্বামীর আরও আত্মীয় স্বজনের মধ্যে ও নিজেকে মিশিয়ে ফেলেছে। ওদের সুখ দুঃখই এখন ওর সুখ দুঃখ। ওরাই এখন সবচেয়ে ওর কাছের মানুষ। বাইশ বছর যার সঙ্গে কাটালো তার চেয়ে বেশি আপন এখন বাইশ দিনের পরিচিত মানুষ। ও এখন বিয়ে হয়ে যাওয়া যে কোনও মেয়ে। শ্বশুর বাড়ির মুরব্বিদের দেখলে মাথায় আঁচল তুলে দেওয়া মেয়ে। তাদের আদেশ নির্দেশ নতমস্তকে পালন করা মেয়ে। ও এখন শ্বশুরবাড়ির বয়সে বড়দের পায়ে পায়ে কদমবুসি করা মেয়ে। ও এখন রান্নাঘরে বসে শাশুড়ির কাছ থেকে কি করে রান্না করতে হয় শিখছে, কি করে স্বামীর পাতে মাছ মাংস দিতে হয় শিখছে, কি করে ঘরে বসে স্বামীর জন্য অপেক্ষা করতে হয় শিখছে, কি করে মাথায় ঘোমটা টেনে ভাসুরের সামনে নত মুখে দাঁড়াতে হয় শিখছে, কি করে শ্বশুর বাড়ির সবার সঙ্গে নরম সূরে, নরম স্বরে কথা বলতে হয় শিখছে। কি করে ঘর গুছোতে হয়, কি করে কিছু আসবাবপত্র আর হাঁড়িপাতিলের স্বপ্ন দেখতে হয় শিখছে। কি করে নিজের স্বপ্নগুলো ভুলে যেতে হয় শিখছে। কি করে গান ভুলতে হয় শিখছে, কবিতা ভুলে যেতে হয় শিখছে। কি করে নিজের জীবনের সব সুরগুলো ভুলে যেতে হয় শিখছে।
০৮. বাহিরে অন্তরে
নির্বাসিত বাহিরে অন্তরের প্যাকেটগুলো নিয়ে গেল নাইম। খবরের কাগজএর পরিবেশকদের কাছে পাঠিয়ে দিয়েছে বই, ওরা বই বিক্রি করার দায়িত্ব নিয়েছে। ঘাড় থেকে মস্ত বোঝা নামার মত বইগুলো নেমে যায় নাইমের হাতে। বই নিজের পকেটের পয়সা দিয়ে বেশ সুন্দর ছাপা যায়, গুণে মানে বই ফাসকেলাস হতে পারে, কিন্তু ডিস্ট্রিবিউটর নেই তো মরেছো। এই ব্যপারটি আমার হাড়ে হাড়ে বোঝা হয়েছে। ছুট্টি দিয়ে দিই ছুট্টি, বই ছাপার কম্মটি আমি আর নিজে করছি না। মনে মনে জুৎসুই একটি নাকে খতও হয়ে যায়। বইটি, পরে শুনেছি, মেলায় বিক্রি হয়েছিল, মেলায় সময়মত এলে হয়ত আরও বিক্রি হত। শেষদিকে আমলা কবি মোহাম্মদ সাদিক মন্ত্রণালয়ের গোপন একটি খবর জানালো আমাকে , বইটি নাকি নিষিদ্ধ করার পাঁয়তারা চলছে ওপর মহলে। অভিযোগ নিয়তি নামের কবিতাটি অশ্লীল। বইটির সবগুলো কবিতাই রুদ্রর সঙ্গে সম্পর্ক ভাঙছে ভাঙছে সময়ে। নিয়তি কবিতাটিও রুদ্রর এক সময়ের আচরণ নিয়ে।
প্রতিরাতে আমার বিছানায় এসে শোয় এক নপুংশক পুরুষ
চোখে
ঠোঁটে
চিবুকে
উন্মাতাল চুমু খেতে খেতে
দুহাতে মুঠো করে ধরে স্তন।
মুখে পোরে, চোষে।
তষ্ণায় আমার রোমকূপ জেগে ওঠে
এক সমুদ্র জল চায়, কাতরায়।
চুলের অরণ্যে তার অস্থির আঙুল
আঙুলের দাহ
আমাকে আমূল অঙ্গার করে লোফালুফি খেলে
আমার আধেক শরীর তখন
সেই পুরুষের গা গতর ভেঙে চুরে
এক নদী জল চায়, কাতরায়।
শিয়রে পৌষের পূর্ণিমা
রাত জেগে বসে থাকে, তার কোলে মাথা রেখে
আমাকে উত্তপ্ত করে,
আমাকে আগুন করে
নপুংশক বেঘোরে ঘুমোয়।
আমার পুরোটা শরীর তখন তীব্র তৃষ্ণায়
ঘুমন্ত পুরুষটির স্থবির শরীর ছুঁয়ে
এক ফোঁটা জল চায়, কাঁদে।
কবিতাটি রোববার পত্রিকায় ছাপা হয়েছিল, তখন সেই রোববার পত্রিকাকে নিষিদ্ধ করা হয়নি, বই নিষিদ্ধ হওয়ার কথা কেন ওঠে! কোন জিনিসটি অশ্লীলতা এবং কোনটি নয় তা বিচারের ভার কার ওপর! আমার তো কবিতাটিকে মোটেও অশ্লীল মনে হয়নি। শাহরিয়ার বলে, তোমার ওই মুখে পোরে, চোষে লাইনটি বাদ দিয়ে দাও। কেন বাদ দেব! কারণ মুখে পোরে চোষে ব্যপারটি অশ্লীল। হা! ছলে বলে কৌশলে যে শাহরিয়ার আমার স্তন মুখে পুরতে, চুষতে, চেয়েছিল, সে আমাকে শ্লীলতা শেখাচ্ছে! কোনও কারণ আমি খুঁজে পাই না লাইনটি বাদ দেবার। তৃষ্ণায় রোমকূপ কাঁপার কারণটি বর্ণনা করতে হলে লাইনটির প্রয়োজন, এরকম মনে হয়েছে। আমার মনে হওয়া অনেক পুরুষ বন্ধুর পছন্দ হয় না, যদিও সে পুরুষেরা যে কোনও রমণীয় রমণীর স্তন মনে মনে মুঠো করে ধরে, মুখে পোরে, চোষে এবং তকেক তকেক থাকে মনে মনের ব্যপারটি কখন কার ওপর সত্যিকার ঘটিয়ে ফেলা যায়। মোজাম্মেল বাবুর কথাই বলি। রূপে গুণে ধনে মানে অনন্য। আমার চেয়ে বয়সে ছোট। আপা ডাকে। কয়েক বছর ধরে প্রেম করছে এক সুন্দরী মেয়ের সঙ্গে। কাল বাদে পরশু সেই মেয়ের সঙ্গে তার বিয়ে। সেই বাবুই এক রাতে আমাকে একা পেয়ে উষ্ণ শ্বাস ফেলছিল আমার সারা গায়ে। তাকে আমি আমার নাগাল পেতে দিইনি।