অনেক অনেক বছর পর ইয়াসমিন যখন স্বামী সন্তান নিয়ে সংসার করছে, বলেছে সেদিন ভোরবেলা আলমারি থেকে আমার একটি কালো শাড়ি পরে বেরিয়েছিল মনের দুঃখে। বাবার ওই নিষ্ঠুর চাবুক ওর নিজের ওপর ধিককার এত বেশি বাড়িয়ে তুলেছিল যে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গিয়েছিল। কলেজে গেছে, ক্লাস করেছে, ক্লাস শেষে প্রবীরদের বাড়িতে গিয়ে অনেকক্ষণ বসে থেকে অবকাশে ফিরে গিয়েছিল, কালো ফটকের সামনে দাঁড়িয়ে থেকেছে কিছুক্ষণ। ভেবেছে ঢুকে যাবে, কিন্তু আবারও অভিমান এসে ওকে আবৃত করেছে। রিক্সা নিয়ে তখন সোজা নানির বাড়িতে গেছে, রাতে ঘুমিয়েছে, অপেক্ষা করেছে অবকাশ থেকে কারও আসার, কেউ এসে ওকে নিয়ে যাবে বাড়িতে। কেউ আসেনি। ওর ইচ্ছে করেছিল ঢাকা যেতে, কিন্তু হাতে ঢাকা যাওয়ার টাকা ছিল না, কারও কাছ থেকে টাকা ধার চাইতেও ওর লজ্জা হয়েছে। রাত কাটিয়ে পরে কলেজে গেছে, ওখানে থেকে আবার গেছে অবকাশে। আবারও দাঁড়িয়ে থেকেছে কালো ফটকের কাছে। ঢুকবে। শেষ অবদি ঢোকেনি। কোথায় যাওয়া যায়! ভাবতে ভাবতে শেষে কলেজস্ট্রিটে জামান নামে ক্লাসের একটি ছেলে থাকে, গ্রামের ছেলে শহরের কলেজে পড়ে, ছোট একটি ঘর ভাড়া নিয়ে থাকে, তার ঘরে গিয়ে অনেকক্ষণ বসে থাকে। কি হয়েছে কী ঘটেছে কিছু কাউকে বলে না। কি করবে বুঝে পায় না। কোথায় যাবে বুঝে পায় না। বাড়িতে না ফিরতে হলে একটি জিনিসই করতে হবে ওর, বাবার নিষ্ঠুরতার প্রতিশোধ একটি কাজ করেই ও নিতে পারে সে হল বিয়ে। আত্মহত্যার কথা ভেবেছে, কিন্তু ভয় লাগে আত্মহত্যা করতে। তাছাড়া বিষ যোগাড় করাও ঝামেলা। সুতরাং ওই একটি উপায়ই আছে, মেয়ে মানুষ যখন, মেয়ে মানুষের বাবার বাড়ি ছাড়া আরও একটি যাওয়ার জায়গা থাকে, সে হল স্বামীর বাড়ি। কিন্তু কাকে বিয়ে করবে ও! কাকে প্রস্তাব দেবে বিয়ের! কাকে লজ্জার মাথা খেয়ে বলবে, আমাকে বিয়ে কর! যার কথাই মনে আসে ওর, ভয় হয় হয়ত ফিরিয়ে দেবে। হয়ত ওকে কেউ বিয়ে করতে চাইবে না। তখনই অনেকদিনের ভুলে যাওয়া মিলনের কথা ভাবে ও। মিলনকে খুঁজতে বের হয় ইয়াসমিন। পায় রাত্তিরে। কোনও রাখ ঢাক না করেই বলল, আমি বিয়ে করব এবং আজই। বিয়ে করতে চাইলে এক্ষুনি কর। তা না হলে আর আমাকে পাবে না। মিলন হতভম্ব। মিলন বলে, বাড়ি থেকে নাকি তোমার বিয়ের ব্যবস্থা করেছে! ইয়াসমিন পুরোনো কথায় ফিরতে চায়নি। সে রাতেই ওরা চলে গেছে শহর ছেড়ে জামানকে নিয়ে। জামান ফুলপুরে নিজের বাড়িতে দুজনের থাকার ব্যবস্থা করেছে। পরদিন ফুলপুরে বিয়ের মত ব্যপারটি ঘটাতে ভয় ছিল ইয়াসমিনের, যদি কেউ ওকে চিনে ফেলে যে ও ডাক্তার রজব আলীর মেয়ে! যদি খবর রটে যায়! জামান ওদের নিয়ে হালুয়াঘাটে গিয়েছে, ওখানে রেজিস্ট্রি আপিসে নিয়ে দুজনকে দিয়ে বিয়ের কাগজে সই করিয়ে নিয়ে এসেছে। এটিও সহজ ছিল না। মেয়ে ভাগিয়ে নিয়ে এসেছে বলে মিলন আর জামানকে সন্দেহ করা হয়। সন্দেহ মোচন করার জন্য দারোগাকে ঘুস দিয়ে কাজ সারতে হয়েছে।
আমি বাড়ি ফিরে মাকে বার বার বলেছি, কেঁদে ভেসে বলেছি, ‘কেন তুমি সেই রাতে নানির বাসায় খুঁজতে গেলা না ওরে!’ মা নিজের অপরাধের জ্বালায় ছটফট করেছেন, পাগলের মত কেঁদে কেঁদে বলেছেন, ‘আমি যদি জানতাম! আমি তো জানি না যে ওর নানির বাসায় ও আছে।’
‘তুমি গিয়া যদি নিয়া আইতা, তাইলে তো হইত না এইসব কাণ্ড!’
অঝোর ধারায় ঝরে মার চোখের জল। ‘আমি যদি জানতাম.. ভাবছি ফিইরা আইব। রাগ কইমা গেলে ফিইরা আইব। আমার কোলটা খালি হইয়া গেল..’
ইয়াসমিনের জীবন সম্পূর্ণই পাল্টো গেছে, আর ও আগের ইয়াসমিন নেই, আর ও আগের মত এই অবকাশ জুড়ে হাঁটবে না, গান গাইবে না, গাইবে না ওর প্রিয় গানটি আর, আমরা এমনি এসে ভেসে যাই, আর ও আগের মত আবৃত্তি করবে না, আর ও এ বাড়ি থেকে কলেজে যাবে না, কলেজ থেকে এ বাড়িতে ফিরবে না, আর বিকেল হলেই আমার সঙ্গে রিক্সায় চড়ে শহর ঘুরে বেড়াবে না, ওর অফুরন্ত সম্ভাবনার আর স্বাধীনতার জীবনে ইতি টেনেছে ও। ইয়াসমিন অবকাশ ছেড়ে চলে গেছে, বিয়ে করেছে একই ক্লাসে পড়ছে এক ছেলেকে, যে ছেলে কোনও একটি বাক্য শুদ্ধ করে বলতে জানে না, এ খবরটি আর ইয়াসমিন মরে গেছে খবরের মধ্যে আমার মনে হয় না কোনও ফারাক আছে। যে আমার ছায়ার মত আমার পাশে থাকত, সে নেই, সে মরে গেছে। সবচেয়ে আপন কেউ সবচেয়ে কাছের কেউ সত্যিকার মরে গেলে যেমন কষ্ট হয় আমার ঠিক তেমন কষ্ট হতে থাকে। আচমকা আমার সব তছনছ হয়ে যায়। এত একা আমার জীবনে কখনও আমি বোধ করিনি। পুরো জগতটি আমার এত খালি খালি কোনওদিন লাগেনি। নিজের জন্য যত কষ্ট হয় তার চেয়ে সহস্রগুণ হয় ইয়াসমিনের জন্য। অবকাশ খাঁ খাঁ করে। পুরো শহর খাঁ খাঁ করে। আমি ছুটি নিয়ে চলে যাই ঢাকায়। মা দুঃখ বেদনা যা আছে ভেতরে নিয়ে ইয়াসমিনকে দেখতে যান মিলনদের বাড়িতে যখন ও ফিরে আসে। ইয়াসমিনের অমন হারিয়ে যাওয়ার খবর পেয়ে সৈয়দ শামসুল হক ময়মনসিংহে ছুটে আসেন। সার্কিট হাউজে একদিন থাকেন, ওখান থেকে ফোনে কথা বলেন ইয়াসমিনের সঙ্গে। ওকে ফিরতে বলেন আগের জীবনে, রাগ করে এত বড় সর্বনাশ যেন না ঘটায়। ও ফেরে না। আমারও আশা ছিল ফিরবে, এরকম তো হয় মানুষের জীবনে, রাগ করে বিয়ের মত কাণ্ড ঘটিয়ে দেখে যে ভুল করেছে, তখন ফেরে। কত কেউ ফেরে, ইয়াসমিন ফেরে না।