‘মানে আর কী!’
‘কী, হাত ধরতে চায়?’
‘হ।’
কানের ঝাঁ ঝাঁ কমতে থাকে। ‘হাত না হয় ধরলই। হাত ধরা তো এমন কিছু না।’ ইয়াসমিন সরে যায় সামনে থেকে। শরীর প্রসঙ্গে আমাদের কথপোকথন কখনও খুব এগোয় না কারণ একটি অদৃশ্য সুতোয় আমাদের ঠোঁটজোড়া বাঁধা। সেদিনের প্রশ্নের উত্তর হাত থেকে কোথাও প্রসারিত হয় না বা হতে চায় না।
ইয়াসমিন আমাকে বলে না সফিকের মত শিক্ষিত সজ্জন মূল্যবান রুচিবান সংস্কৃতিবান ছেলেকে এমন হেলা করছে কেন ও! অনেক অনেক বছর পর যখন স্বামী সন্তান নিয়ে সংসার করছে ইয়াসমিন তখন সফিকের প্রসঙ্গ উঠলে ও হেসেছে, হাসতে হাসতে বলেছে, দেবতার ভেতরের ভয়ংকর এক দানব দেখেছে ও। সেদিনের সেই অক্ষমতা আর কাউকে কিছু বোঝাতে না পারার অস্থিরতা ওকে যে যন্ত্রণা দিয়েছে, সেই যন্ত্রণার কথা মনে করে একটি কালো রেখা ফুটে উঠছিল ওর ফর্সা কপালে। ওর প্রতি সফিকের আগ্রহ ওকে অন্তত এইটুকু নিশ্চিতির উদ্ধার দিয়েছিল যে সফিকের সঙ্গে ওর বিয়ে হলে সংসারের সকলের মুখে হাসি ফুটবে, চুনকালির আশঙ্কা জন্মের মত দূর হবে। কিন্তু যখন সফিকের বলার কথা তোমাকে ভালবাসি, দুজনে কথা বলতে বলতে কোথাও কোনও খোলা বাগানে পাশাপাশি হাঁটার কথা, একসময় হাঁটতে হাঁটতে হাতে হাত রেখে নদীর ওপারের না ফুরোনো সবুজের দিকে তাকিয়ে আগামী দিনের স্বপ্নের কথা বলার কথা— তখন সফিক একটি খালি ঘরে ওকে নিয়ে হুড়োহুড়ি করে ওর বুক খামচে ধরতে চায়। কেবল তাই নয়, এরপর অবকাশ এক বিকেলে খালি পেয়ে ইয়াসমিনের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েছিল সে, টেনে জানা খুলতে চেয়েছে, টেনে পায়জামা। ইয়াসমিন চিৎকার করে বারান্দায় ঘুমিয়ে থাকা সুফিকে জাগিয়ে তুলেছে, গালাগাল করে সফিককে বাড়ি থেকে বের করে শোবার ঘরের দরজা বন্ধ করে বালিশে মুখ গুঁজে জন্মের কান্না কেঁদেছে। কেঁদেছে ভাবতে ভাবতে যে কেউ ওকে সত্যিকার ভালবাসে না, কেবল এই শরীরটির ওপর সবার লোভ, আর কিছু নয়। এই শরীর খুব সস্তা শরীর। যার কিμছু নেই ভালবাসার, তার শরীর বুঝি হাত বাড়ালেই পাওয়া যায়। কবিতা লেখে ছেলে কাজল শাহনেওয়াজ, যার হোস্টেলের ঘরে সফিক ইয়াসমিনকে নিয়ে গিয়েছিল, সেই কাজল অবকাশে আমার সঙ্গে সাহিত্যের আলাপ করে চা বিস্কুট খেয়ে যাবার সময় ইয়াসমিনকে একদিন চোখ টিপে বলে গেছে আবার যেন ও একা তার হোস্টেলের ঘরে যায়। আবদুল করিমের কথাও ওর মনে পড়েছে। হাসিনার দুলাভাই আবদুল করিম অবকাশের ঘনিষ্ঠ আত্মীয় হয়ে উঠেছে, প্রায়ই বউ ছেলেমেয়ে নিয়ে বেড়াতে আসে, মা সবাইকে যত্ন করে খাওয়ান দাওয়ান, সেই হাতির মত দেখতে আবদুল করিম ইয়াসমিনকে একা পেয়ে ফিসফিসিয়ে বলেছে সপ্তাহে একবার যদি শোয় ও আবদুল করিমের সঙ্গে এক হাজার টাকা করে পাবে, তাহালে মাসে চার হাজার টাকা কামাই হবে ইয়াসমিনের। ব্যাটার স্পর্ধা দেখে ইয়াসমিন তাজ্জব হয়ে গিয়েছিল। তাজ্জব হয়েছে কিন্তু বলেনি আমাকে। বলেনি এইজন্য যে কেন আমার ওপর এই ঝঞ্ঝাট আসে না, কেন ওর ওপরই শুধু, এ যদি আমাকে বিষণ্ন করে, ভাবায়! যদি আমি ওকেই দোষী বলে ভাবি। অথবা এতে যদি আরও ও যে কুরূপা-নির্গুণ তা স্পষ্ট হয়ে ওঠে, ওই শঙ্কায় সম্ভবত অথবা লজ্জায় ও বলেনি, অন্যের অন্যায় দেখে নিজেরই যে লজ্জা হয় সেই লজ্জায় অথবা বলেনি কারণ আমি যে ওকে শুদ্ধ সুন্দর মেয়ে বলে মনে করি, সেই মনে করাকে ধাককা দিয়ে নোংরা ডোবায় ফেলতে চায় না, আমি যে ওকে নিয়ে চমৎকার স্বপ্ন দেখছি, সেই স্বপ্ন ও গুঁড়ো করে দিতে চায় না, আমার আদরের আহলাদের আকাঙ্খার বোনটিকে যেমন আমি জানি চিনি ভালবাসি, তেমনই থাকতে চায়, আমার প্রিয় প্রিয় গানগুলি গাইতে চায়, আমার প্রিয় প্রিয় কবিতা আবৃত্তি করতে চায় ওর আশ্চর্য সুন্দর কণ্ঠে, ওকে নিয়ে আমার গৌরবের ওপর একতাল গোবর ফেলে দিতে চায় না। আমাকে ভালবাসে তাই ওর কোনও কষ্ট আমাকে দেখাতে চায় না যা দেখলে আমার কষ্ট হবে। আমার স্বপ্নকে গানে কবিতায় বাড়তে দেয়। আমার ইচ্ছের সুতোয় রঙিন ঘুড়ি বেঁধে দেয়। বেঁধে দিয়ে আড়ালে গিয়ে গোপনে চোখের জল মোছে।
মাস গড়াতে থাকে। জীবন গড়াতে থাকে জীবনের মত। ছোট খাটো সুখ দুঃখে বয়স বাড়তে থাকে অবকাশের। অবকাশের মানুষ তাদের সুখগুলো ছড়িয়ে ছিটিয়ে দেয়, দুঃখগুলো একা একা গোপনে লালন করে। মার ডালিম গাছে ডালিম ধরেছে। মা খুশিতে বাগ বাগ করে বাড়ির সবাইকে খাওয়ালেন, একটি নিয়ে গেলেন নানির বাড়িতে ভাগ করে খাওয়াতে, সকলে খেয়ে বাহ বাহ করেছে মার গাছের ডালিমের। আনন্দে মা আরও দুটো ডালিম গাছের চারা এনে লাগালেন উঠোনে। মার আনন্দই দেখেছে সবাই, কেউ মার কষ্টগুলো দেখেনি। ইয়াসমিন অনার্স পরীক্ষায় খুব ভাল ফল করেছে। কলেজের প্রফেসর নিশ্চিত, মন দিয়ে পড়লে ইয়াসমিন মাস্টার্সেও ফার্স্ট ক্লাস পাবে। বাড়ি এসে ইয়াসমিন সবাইকে জানিয়ে দিল ওর ভাল ফলের খবর। আনন্দ ভাগ করে দিল সবাইকে। সবাই বসে পরীক্ষার ভাল ফলের আনন্দ খেল। কেবল ইয়াসমিনের ভেতরের কষ্টগুলোর দিকে কারও নজর পড়ল না। কষ্টগুলো ওর একার। তারপর তো সেই দিনটি এল, ভয়াবহ সেই দিনটি। যে দিনটিতে আমি ময়মনসিংহে নেই, দুদিন আগে গিয়েছি ঢাকায় বই এর খবর নিতে। ফিরে এসে দেখি ইয়াসমিন বাড়িতে নেই। গতকাল ভোরবেলায় চলে গেছে, কোথায় গেছে কেউ জানে না। একটি চিরকুট আমার টেবিলের ওপর।