উনাশিতে অনেক মন্দ কিছু ঘটেছে, মন্দের মধ্যে আমাকে নিঃস্ব করে ইয়াসমিনের চলে যাওয়াটিই সবচেয়ে মর্মান্তিক। তখন আমি বিষণ্নতার গভীরে আকণ্ঠ ডুবে আছি। চেনা চারপাশ থেকে অচেনা কোথাও যেতে চাই। আমার এত প্রিয় শহর ময়মনসিংহ, অথচ মনে হতে থাকে যেন এ শহরটি আমার জন্ম জন্মান্তরের শত্রু। এত খাঁ খাঁ অন্য কোনও শহর করে না। অবকাশে ইয়াসমিনের হারমোনিয়ামটির ওপর ধুলো জমতে থাকে। হারমোনিয়ামের ওপর গীতবিতানটি পড়ে থাকে অসহায়। আমার সয় না। সয় না ওর জামা কাপড়, ওর শখের এটা সেটা, ওর কবিতার বইগুলোর উদাস পড়ে থাকা। শহর থেকে পালাই আমি। শীতলক্ষার তীরে উদাস বসে থাকি আমি তখন, সঙ্গে ইমদাদুল হক মিলন। গল্প উপন্যাস লিখে জনপ্রিয় হওয়া মিলন প্রেম-প্রেম চোখে তাকায় আমার দিকে। মিলনের সঙ্গে পরিচয় আমার আজকের নয়। সেই সেঁজুতি ছাপার সময় তার সঙ্গে চিঠি লেখালেখি ছিল। সুন্দর সুন্দর রোমান্টিক চিঠি লিখত মিলন। প্রেমের জলে ডোবানো এক একটি থর থর শব্দ। মিলন আমাকেই নয় শুধু, যে কোনও মেয়েকেই ওরকম করে লিখত। একবার সে টাঙ্গাইলে একটি অনুষ্ঠানে গিয়ে মুক্তিকে দেখে, বিশেষ করে মুক্তি যখন আমার মুক্তি আলোয় আলোয় গানটি গাইল, প্রেমে পড়ে গেল। মুক্তি কবিতা লিখত। মিলন আর মুক্তির প্রেম দীর্ঘদিন ধরে দুজনের মিলন ঘটিয়ে দুজনকে একসময় মুক্তি দিয়ে দিল। মিলন, মুক্তি আর লিমা নামের একটি চরিত্র নিয়ে সন্ধানীর নিকষিত হেম এ কান্না পায় পায় এমন একটি বিরহের গল্প লিখেছিলাম। সেই গল্পটি অনেকে পড়ে ভেবে নিয়েছিল লিমা চরিত্রটি আমিই। মনে মনে নিজেকেই কি আমি কল্পনা করিনি লিমা চরিত্রে! করেছি। মিলনের জন্য সেই কিশোরী বয়সে আমার একধরনের রিনিকি ঝিনিকি সাধ ছিল, রোমান্টিক কোনও যুবকের জন্য যেমন থাকে যে কোনও প্রেমোন্মুখ কিশোরীর। রুদ্রর সঙ্গে বন্ধুত্ব ছিল মিলনের, রুদ্রর সঙ্গে পরে মুক্তির আরও ভাল বন্ধুত্ব হয়েছিল। রুদ্রর সঙ্গে সম্পর্ক থাকাকালীন মিলনের সঙ্গে বইমেলায় আমার দেখা হত। দুচারটে মামুলী কথাবার্তা হত। সেই মিলন। সেই আমি। মিলন যেন তেন এক গোবেচারা মেয়েকে বিয়ে করে সংসার করতে শুরু করেছে আর আমি সংসারের খাঁচা ভেঙে বেরিয়ে আসা ডানায় করে একাকী একটি জীবন নিয়ে ঠিকানাহীন ঘুরে বেড়ানো আহত ক্লান্ত পাখি। মিলন আমাকে সাত সমুদ্দুর তেরো নদীর ওপারে এক জগত আছে, সেই জগতের কথা বলে। তখনই আমার ইচ্ছে হয় দূরে বহু দূরে কোথাও চলে যেতে। কতদূর গেলে খুব দূরে যাওয়া হয় আমি জানি না। এই ভূবনে স্বর্গ বলে একটি জায়গা আছে কোথাও, তাপে শাপে দগ্ধ প্রকৃতি থেকে চোখ সরিয়ে বলি, ‘চল কাশ্মীর চল।’ মিলন সঙ্গে সঙ্গে রাজি। ‘চল।’
শীতলক্ষার শীতল জলে শীতল চোখ রেখে মিলন বলে, ‘শোন, তিরিশ পয়ত্রিশ হাজার টাকা কিন্তু লাগবে যেতে হলে।’
অত টাকা নেই আমার কাছে। মাস গেলে দু হাজার টাকা মাইনে পাই। জমানো যা ছিল তা বই বের করতে গেছে। টাকা ধার করে নিজেকে হারিয়ে যাওয়ার যোগ্য করি, দূরে কোথাওএর যোগ্য করি। দুঃখ ভোলার যোগ্য করি। স্বাধীনতার স্বাদ নেওয়ার যোগ্য করি। আমাকে বিমান বন্দরে পৌঁছে দিয়ে যান ছোটদা। সবাই জানে আমি একাই যাচ্ছি ভারতে, কলকাতায় অতসী নামের এক বন্ধু আছে আমার, ওর বাড়িতে থাকব, ওকে নিয়ে ঘুরে বেড়াব। গোপন ব্যপারটি আমি পুষে রাখি নিজের ভেতর। প্রকাশ করলে সর্বনাশ। যদি বলি মিলন নামে আমার এক বন্ধুর সঙ্গে যাচ্ছি, দূরে হারাতে যাচ্ছি, আমার পায়ে শেকল পরাতে ব্যস্ত হবে সবাই। পরপুরুষের সঙ্গে দেশের ভেতর ঘুরি ফিরি ক্ষতি নেই, সীমানা ডিঙোনো চলবে না। শীতলক্ষার পাড়ে যদি দুজন বসে থাকতে পারি, গঙ্গার ধারে নয় কেন! গঙ্গার ধারে নয়। শীতলক্ষা আর গঙ্গা এক নয়। শীতলক্ষায় সাঁতার কাটো আর যাই কর, রাত্তিরে ঘরের মেয়ে ঘরে ফিরবে, গঙ্গার ধারে হাওয়া খেলে রাত ভেসে যাবে হাওয়ায়। রাতকে সবার ভয়। রাতকে আমারও ভয়। তাই কলকাতায় হোটেলে পৌঁছে আমি আলাদা ঘরের কথা বলি। দুজনের দুটো ঘর। কলকাতার হোটেলে দুঘরে দুজন। দিল্লির হোটেলেও, আগ্রাতেও। টই টই করে দু বন্ধু ঘুরে বেড়াচ্ছি সবখানে। পর্যটকের মত দেখে আসছি ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল, লাল কিল্লা, ইন্ডিয়া গেট, তাজমহল। হাতে হাত ধরে বিকেলের মিঠে হাওয়ায় হাঁটতে হাঁটতে একদিন বেশ ভাল বুঝি যে যে মিলনকে আমি ভালবাসি। ভালবাসি বলেই রাজধানী এক্সপ্রেসে অমন করে নিজের গলার সোনার চেইনটি খুলে মিলনের গলায় পরিয়ে দিই। ভালবাসি বলে এমন মনে হতে থাকে যে সে যদি আমাকে বলে হিমালয়ের চুড়ো থেকে লাফ দাও, তাই দেব। মিলনকে আমি আমার কষ্টের গল্পগুলো, সুখের গল্পগুলো বলতে চাই, বড় ইচ্ছে করে তার চোখে চোখ রেখে, চোখের পাতায় আলতো চুমু খেয়ে তাকে যে ভালবাসি তা বলি। আমার বলা হয় না কিছুই। কিন্তু আমি কিছু বলার আগেই জম্মুতে আমাকে গভীর করে স্পর্শ করে মিলন, যে স্পর্শ আমাকে আমূল কাঁপায়। শ্রীনগরের ডাল লেকে রাজকীয় একটি হাউজবোটে চেনা শহর থেকে চেনা মানুষের ভিড় থেকে বহু দূরে আগুন পোহাতে পোহাতে ভালবাসার জলে ডুবি। রুদ্রর সঙ্গে সম্পর্ক অনেকদিন শেষ হয়েছে আমার। দীর্ঘকাল পুরুষস্পর্শহীন এই শরীরে এত তৃষ্ণা ছিল, বুঝিনি। আমার শরীর জেগে ওঠে শুভ্র বিছানায়। সে শরীরকে সুখের চাদরে ঢেকে দেয় মিলন। ভেতরে যে সংষ্কার ছিল আমার, স্বামী নয় এমন কারও সঙ্গে মৈথুন সঙ্গত নয়, সেটি শালিমার বাগানের ঝড়ো হাওয়ায় তুলোর মত উড়ে যায়। মিলনের চেয়ে আপন এ জগতে কেউ নেই আমার, এরকম মনে হয়। আমি ভুলে যেতে থাকি মিলনের আলাদা একটি জীবন আছে। কলকাতায় ফিরে সে কথা স্মরণ হয় যখন সে তার বউ বাচ্চার জন্য ট্রেজার আইল্যান্ড থেকে শাড়ি গয়না কিনতে যায়। মিলনের আলাদা একটি জগত আছে, সে জগতে আমি কেউ নই তা স্মরণ হয় যখন সে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের বাড়ি যাবে বলে এবং একা যাবে বলে এবং যায়। ইয়াসমিন বাড়ি ছেড়ে চলে যাবার পর যেমন একা লেগেছিল, মনে হয়েছিল খাঁ খাঁ করছে পুরো শহর, পুরো পৃথিবী, তেমন লাগে আবার।