দ্বিতীয়বার অবকাশে তাঁর আর থাকা হয়নি, কারণ হচ্ছে ছোটদা। সৈয়দ হকের পদধূলি অবকাশে পড়ার পর যে ধন্য ধন্য ভাব ছিল বাড়ির সবার মধ্যে, একদিন ছোটদা সেই ধন্যভাবের দুধে পাঁচ ফোটা চোনা ছিটিয়ে দিলেন। বলে গেলেন ‘সারা ঢাকা শহর জানে হকুর কীর্তিকলাপ, মেয়েমানুষ লইয়া ফুর্তি করার ওস্তাদ এই হকু। লুইচ্চা।’ ব্যস, সৈয়দ হক নিষিদ্ধ অবকাশে, নিষিদ্ধ বলে তিনি যে ময়মনসিংহে আসা বন্ধ করে দিয়েছিলেন তা নয়, এসেছেন, সার্কিস হাউজের অতিথিভবনে থেকেছেন। তিনি, সারা দেশই, বলেছেন, ঘুরে বেড়ান। ঘুরে বেড়ালে অভিজ্ঞতা বাড়ে। মানুষ দেখতে হয়, মানুষ। মানুষের চেয়ে চমৎকার কিছু আর জগতে নেই। মানুষ কী করে কথা বলে, কী করে হাসে, কী করে লজ্জা পায়, কী করে ভয় — সবই হচ্ছে দেখার বিষয়। সৈয়দ হকের প্রায় পদতলে বসে আমি হাঁ হয়ে শুনে গেছি তাঁর দর্শন। ঢাকায় নয়াপল্টনে ছোটদার বাড়িতেও তিনি এসেছিলেন আমার সঙ্গে দেখা করতে, ছোটদা সামান্য সৌজন্যও দেখাননি। ছোটদার ওপর রাগও হয়েছিল আমার বিষম। সারা ঢাকা শহর জানে বলে তিনি যে মন্তব্যটি করেছেন, তা তাঁর নিজের নয়, অন্য একজনের, যে অন্যটি বিমানের কোনও কর্মচারি অথবা কোনও ভুতপূর্ব চিত্রালী-লেখক। সারা ঢাকা শহর জানে এই কথার পেছনে কোনও যুক্তি নেই। ঢাকা শহরের বেশির ভাগ লোক, সাহিত্য জগতে যাদের পদচারণা নেই, সৈয়দ হককে চেনেই না, সাহিত্যজগতে যাদের আছে, তাদের বেশির ভাগই সৈয়দ হককে শ্রদ্ধা করেন। যাই হোক, দুধচোনাটিকে বিশুদ্ধ দুধ করা আমার পক্ষে সম্ভব হয়নি। অবকাশে সৈয়দ হক নিষিদ্ধ হয়েই রইলেন, নিষিদ্ধ হয়েছিলেন বলে তাঁর প্রতি পক্ষপাত আমার বেশি ছিল। তিনি ডাকলেই আমি দেখা করতে গিয়েছি, সে সার্কিট হাউজে হোক, রেস্তোরাঁয় হোক, ঘুরে বেড়াতে মুক্তাগাছা হোক। কুদ্দুস বয়াতির ওপর তথ্যচিত্র বানাতে যখন তিনি নদীর পাড়ে ব্যস্ত, সেখানেও তাঁর ডাক পেয়ে ছুটে গিয়েছি।
সৈয়দ হকের সঙ্গে আমার সম্পর্কটি স্নেহ শ্রদ্ধার সম্পর্ক ছিল। একজন বড় লেখকের, মাঝে মাঝে কবিতা টবিতা লেখার অভ্যেস আছে এমন সাহিত্য অনুরাগী ছেলে মেয়েদের প্রতি যে সহমর্মিতা থাকে, আমার প্রতি তা-ই ছিল তাঁর। সেটি ক্রমে ক্রমে বাক্তিগত হয়ে উঠল, বিশেষ করে তিনি যখন রুদ্রর সঙ্গে কেন আমি বিচ্ছেদ ঘটাতে চাইছি তার কারণটি জানতে চেয়েছিলেন এবং সে কারণে ময়মনসিংহ অবদি এসেছিলেন। সাহিত্যিক বা অসাহিত্যিক যে কথাই হত তাঁর এবং আমার মধ্যে, মূল বক্তা ছিলেন তিনিই। তাঁকেই বক্তা হিসেবে মানায়। ইয়াসমিনকেও তিনি ‘এই কি করছিস কেমন আছিস, কাছে আয় তো, বোস এখানে’ বলে লজ্জায় লাল হয়ে থাকা ইয়াসমিনকে কাছে বসিয়ে রাজ্যির গল্প শোনাতেন। উপদেশও দিতেন। উপদেশ আমাকেও দিতেন, কি করে কবিতা লিখতে হয়, কি করে ছন্দের জন্য শব্দ না গুনে কানকে সজাগ রাখতে হয় বলতেন। মন দিয়ে আমার সব কবিতাই তিনি পড়েছেন, প্রায় প্রতিটি কবিতা নিয়ে কিছু না কিছু বলেছেন, কোনটি ভাল হয়েছে, কোনটি কী হলে ভাল হত, কোন শব্দটি না বসিয়ে কোন শব্দটি বসালে বেশ শোনাতো — এসবে তাঁর কোনওরকম কৃত্রিমতা ছিল না। ইয়াসমিনের হঠাৎ অবকাশ থেকে অদৃশ্য হয়ে যাওয়ার খবর পেয়ে আমি যেমন ভেঙে পড়েছিলাম, সৈয়দ হকও তেমন। সৈয়দ হক আমাকে তাজ্জব করে দিয়ে কাঁদলেন হাউ মাউ করে, কাঁদলেন ইয়াসমিনের জন্য। পরে ইয়াসমিনের নতুন বাড়িতে তিনি বেশ কবার গেছেন নেমন্তন্ন খেতে। একবার, আমি তখন ঢাকায়, তিনি তাঁর অল্প বয়সী এক প্রেমিকাকে নিয়ে ইয়াসমিনকে দেখতে গেলেন। সারাদিন ইয়াসমিনের ঘরে মেয়েটির সঙ্গে খুনসুঁটিতে মেতে ছিলেন। জড়িয়ে ধরা, চুমু টুমু সবই চলেছে। নতুন বাড়িতে ইয়াসমিনের অস্বস্তির শেষ নেই, ওর বয়স্ক অতিথি একটি বাচ্চা মেয়ে নিয়ে খালি ঘরে কী করছে বাড়ির অনেকে এই প্রশ্ন ছুঁড়ে দিচ্ছিল ওর দিকে। এই মেয়েটিকে আমি আর ইয়াসমিন দুজনই দেখেছিলাম সৈয়দ হকের অনুবাদে টেম্পেস্ট নাটক যেদিন হয়েছিল ব্রিটিশ কাউন্সিলে। আমরা তিনজন পাশাপাশি বসেছিলাম, পেছনের আসনে সৈয়দ হক। পেছন ফিরে ক’বার দেখেছি তাঁর চোখ নাটকে নয়, চোখ মেয়েটিতে। এই মেয়েটি পাঁচতলার ছাদ থেকে পড়ে আত্মহত্যা করতে নিয়েছিল এমনই গভীর ছিল তার ব্যক্তিগত শোক, সেই শোক থেকে তিনি তাকে উঠিয়ে এনে জীবনের এক দ্যূতিময় রূপ দেখিয়েছেন, মেয়েটির ভেতর সঞ্জীবিত করেছেন ভালবাসার বোধ — তিনি আমাকে বলেছেন সব।
কখনও সৈয়দ হক অবিকল বাবার মত, ভাল ভাল উপদেশ বর্ষণ করছেন, কখনও বড় ভাইয়ের মত আগলে আগলে রাখছেন, কখনও সমবয়সী বন্ধুর মত সরস কথাবার্তা বলছেন, কখনও আবার তাঁর দুটো চোখে হঠাৎ ঝলসে ওঠে নেকড়ের নীল হাসি। মাঝে মাঝে মনে হয় ঝলসে উঠছে, আবার কখনও মনে হয় না উঠছে না। রাঙামাটি আর কাপ্তাই এ এক ঘরে ঘুমোবার ইচ্ছে করার সময় তাঁর ভেতরের বাবর আলীটি জেগে উঠেছিল, আরেক বার মনে হয় না জেগে ওঠেনি। ঘনিষ্ঠতার শুরু থেকে সৈয়দ হক আমাকে দোদুল দোলায় দুলিয়েছেন। রুদ্রকে কেন আমি আমি ত্যাগ করতে চাই তা জেনে আমার বেদনার্ত মনে তাঁর সমবেদনা বুলোতে তিনি যখন আমার পিঠে হাত রেখেছিলেন ময়মনসিংহের এক রেস্তোরাঁয় খেতে বসে, ঠিক ব্রার হুকের ওপর হাতটি পড়েছিল তাঁর, পিঠ আমার ধনুকের মত বেঁকে গেছে মুহূর্তে, সরিয়ে দিতে চেয়েছি তাঁর ওই সমবেদনার কোমল হাতটি। মনে হয়েছিল খেলারাম বুঝি আমার সঙ্গে এত দূর অবদি এসেছেন খেলতে। সৈয়দ হকের জন্য আমার শ্রদ্ধা যেমন অগাধ, তাঁকে নিয়ে আমার সংশয়ও তেমন অপরিসীম। এই সৈয়দ হক আমাকে মুগ্ধ করেছেন সকাল কবিতা পরিষদের অনুষ্ঠান এবং আমার সাহিত্যকর্ম নিয়ে দৈনিক পত্রিকায় একটি চমৎকার কলাম লিখে। আবার এই সৈয়দ হকই তাঁর বাড়িতে আমাকে আমন্ত্রণ জানিয়ে, খালি বাড়িটির আগপাশতলা দেখাতে গিয়ে তাঁর ছবি আঁকার ঘরটিতে নিয়ে ঘরটির বন্ধ দরজায় দাঁড়িয়ে থাকেন, যেন এই আমাকে আটকেছেন, এখন তাঁর আকাঙ্খার তুলিতে আমার সাদা শরীর রঙিন করবেন। মূহূর্তে আমার মাথা একটি ঠান্ডা ভয় ছড়িয়ে যায় সমস্ত শরীরে, তাঁকে পাশ কাটিয়ে দ্রুত দরজা খুলে বেরিয়ে যাই। এই সৈয়দ হকই হদপিন্ডে অস্ত্রোপাচারের সামান্য আগে লন্ডনের হাসপাতাল থেকে, বলেছেন যে, প্রথম যে মানুষকে ফোন করেন দেশে, সে আমি। এই সৈয়দ হকই আমার কবিতা পড়ে মুগ্ধ হয়ে ঢাকায় তাঁর প্রকাশককে চিঠি লিখে দিয়েছেন যেন আমার বই ছাপে। এই সৈয়দ হকই খবরের কাগজে আমাকে দিয়ে কলাম লেখানোর জন্য নাইমকে পরামর্শ দিয়েছেন। এই দেবতার মত মানুষটিকে তারপরও সবসময় দেবতার মত বলে মনে হয়নি আমার। কিন্তু সে কেবল মনে না হওয়ার ব্যপার, তাঁর কোনও অশ্লীলতা,ভাল, যে, আমার কখনও দেখতে হয়নি। মাঝে মাঝে মনে হয়েছে এ আমার অহেতুক সংশয়, এ আমার অমূলক ভয়, জগত না দেখা জীবন না চেনা ভীরু কিশোরীর মত যেখানেই পা দিই ভাবি বুঝি ফাঁদ পাতা, এ তাঁকে বোঝার ভুল, আসলে সৈয়দ হক যেমন উদার, তেমন উদারই, যেমন বড় তিনি, তেমন বড়ই। অথচ এই সৈয়দ হকই তাঁর কলামগুলো যখন বই হয়ে বেরোয়, ময়মনসিংহে তসলিমা নাসরিনের সাহিত্যানুরাগ এবং তার সকাল কবিতা পরিষদ নিয়ে যে প্রশংসা টুকু ছিল, আলতো করে বাদ দিয়ে দিয়েছেন। সে পরের দিকের ঘটনা, আগে উনআশির প্রথম দিকের কথা বলি।